কুলি
রচনা – মহামায়া রুদ্র
থানা: নিশ্চিন্দা, বালী , জেলা: হাওড়া
ধনী আর দরিদ্রের দৈনন্দিন জীবনের দূরত্ব বা পার্থক্য নিয়ে সারা পৃথিবী যতই চিৎকার করুক বা গলা ফাটাক না কেন এই বিভেদ চিৱন্তন।
সমগ্র অতীত ও বৰ্তমানেৱ ইতিহাস বয়ে নিয়ে চলেছে তার ধারাবাহিক বিবরণী। এই দুঃখ যন্ত্রণার মাঝে হঠাৎ একটা প্রত্যক্ষ ঘটনা মন কে নাড়া দিয়ে গেল। স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি এমন সময় চোখে পড়লো চোখের সামনে ঘটে যাওয়া এই মর্ম বিদারক ঘটনা।
সম্ভবত স্কুলে গরমের ছুটি পড়ে গেছে!
ছেলে ,মেয়ে ,ও স্ত্রী কে সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছেন আপাত দৃষ্টিতে মনে হওয়া এক সম্ভ্রান্ত বাবু মশাই।
কয়েক দিনের জন্য পরিবারের সঙ্গে আনন্দের শরিক হতে।
প্ল্যাটফর্মে এসে প্রথমে কুলি খুঁজতে শুরু করলেন বাবু মশাই।
কুলি এই কুলি এইদিকে- এইদিকে- আরে ডাকছি শুনতে পাচ্ছিস না? অনেকের মধ্যে একজন
কুলি ছুটে এলো বাবুর কাছে। ওখানেও প্রতিযোগিতা। সারাদিনের পরে কে কতটা ঘাম ঝরিয়ে নিজেদের বিক্রি করতে পেরেছে তার আর্থিক মূল্যায়ন উপার্জনের পরিমিত অর্থ। যায় হোক কুলি ছুটে এসে
বাবু মশাই কে বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো বলুন বাবু কোন ট্রেন ধরবেন।
বাবু মশাই ভীষণ তাচ্ছিল্য ও বিরক্তের সাথে বললেন চেন্নাইএক্সপ্রেস । ২৩ নম্বর প্লাটফর্ম থেকে ছাড়বে
শিগ্রি চল , ট্রেনের টাইম হয়ে এসেছে। হাতে বেশি সময় নেই।বাড়ি থেকে বেরুতে দেরি হয়ে গেছে।
তার উপরে প্রচন্ড গরম!
চল, চল তাড়াতাড়ি চল
পা চালা খাসনি নাকি?
কুলি বলে খাওয়ার সময় পায়নি বাবু। খেতে যে সময় লাগে সেই সময়ে যদি একটা কাজ করে নিতে পারি…….। গতরের বিনিময়ে তো রোজগার।
খুব তৃষ্ণা পাচ্ছে ,শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত ও লাগছে ।
বাবুমশাই সেই কথায় কোনো কর্ণ পাত না করে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বললেন
কটাই বা ব্যাগ আছে, দুটি ট্রলি ব্যাগ ,আরও তিনটে ছোট ব্যাগ, ব্যাস এটুকুই।
চল চল জোরে চল, টাকাটা নেওয়ার সময় তো হাত পেতে নিবি !
তখন তো বলবি না পাঁচ টাকা কম দিন, আবার হোঁচট খাচ্ছিস –তোর মাথা থেকে আমার ব্যাগ যদি পড়ে জিনিস নষ্ট হয় তাহলে বুঝে দিতে পারবি তো? যা আছে এমন দামি জিনিস কখনো চোখে দেখেছিস?
কুলি কোন উত্তর দিল না। অভাব , দারিদ্র প্রতি মুহূর্তে মানুষ কে বুঝিয়ে দেয় তার বেঁচে থাকার মূল্য , তার ব্যক্তি জীবনের দায়বদ্ধতা। অথচ তার প্রতি সমাজের কারো কোনো দায়বদ্ধতা নেই। বাবুমশাই কুলির না খাওয়া তৃষ্ণার্ত দুর্বল ক্ষমতার আর্থিক মূল্যায়ন করে ধমকের সুরে বলেলন ঠিক আছে ,ঠিক আছে আরো ১০ টাকা বাড়িয়ে দেব, তবে দুটো জলের বোতল কিনে দিস”
হাতে সময় বড্ড কম।
কি হলো তোর ? ট্রেন টা ধরতে হবে তো? কাজ না পারলে কেন যে স্টেশনে ঘুরে বেড়াস এই রকম ক্যাটকেটে শরীর নিয়ে?
কুলি বলে বাবু আজ আমার শরীরটা ভালো নেই। কিন্তু কি করবো, বাড়িতে বাচ্চাটা অসুস্থ। ডাক্তার দেখানোর পয়সা নেই। তাই বাধ্য হয়ে কাজে এসেছি। সন্ধ্যে বেলা ফিরে গিয়ে বাচ্চাটাকে ডাক্তার দেখাবো।
বাবু মশাই ধমক দিয়ে বললেন আমার সাথে এই সব ছেঁদো কথায় কাজ হবে না। চালাকি অন্য কোথাও দেখাস। আমি জানি আরও টাকা চাস তুই, তাইতো? ন্যায্য টাকা নিবি, আবার মুখে মুখে তর্ক করবি, আমি কোন পোস্টে চাকরি করি জানিস –?
আমি তোর এখানে কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারি,
আমাকে দেখলে সবাই স্যালুট দেয়। আসলে বিশেষ কিছু সময়ে মানুষের একটা বিশেষ মনস্তত্ত্ব কাজ করে। যেমন যে কোনো পুরুষ মানুষ তার স্ত্রী, ও সন্তানের কাছে তার অস্তিত্ব টাকে বিশাল আকাশের মত দেখাতে চায়। স্ত্রী ও স্বামীকে বিশেষ হোমরা চোমরা কিছু এবং সন্তানেরা তার বাবাকে অসীম শক্তি বা ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে জানতে চায়। যাই হোক প্লাটফর্ম এসে যাওয়ায় বাবু সপরিবারে
ট্রেনে উঠে পড়লেন,
ট্রেন ধীর গতিতে চলতে শুরু করল।
তখন কুলি বললো
বাবুমশাই আমার টাকা! বাবুমশাই তখন ট্রেন থেকে টাকাটা ছুঁড়ে দিলেন প্লাটফর্মের উপরে,কুলি টাকাটা তুলে মাথায় ছুঁয়ে প্রণাম করলো।
মনের একটা দ্বিধা সর্বক্ষণ কেমন কচলাতে থাকলো …সত্যি কি কুলির এই ব্যবহারটা পাওয়া উচিত ছিল?
মানুষের প্রয়োজনে মানুষকে লাগে,
যার যেমন কর্ম সে সেটা করে তার জীবনের প্রয়োজন মেটায়। কুলি না থাকলে, বাবুমশাই কি ঠিক সময়ের মধ্যে ট্রেন ধরতে পারতো ? অথচ এই উপকারের প্রতিদানে কেন তার এত অবহেলা বা অপমান? সভ্য সমাজের সভ্যতার ধ্বজা ধরা এই সব তথা কথিত সভ্য উঁচু স্তরের মানুষ কি এভাবেই দুর্বল ও নিরীহ মানুষ কে এমনি করেই শোষণ আর অপমান করে যাবে? এর প্রতিকার কোথায়? হয়তো যেদিন সমগ্র নীচু তলার মানুষ একসঙ্গে জেগে উঠবে সেদিন হয়তো কিছু প্রতিকার হলেও হতে পারে। কিন্তু আর্থসামাজিক বৈষম্য পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো কালেই মোছার নয়।
………………………………………………………………………………………………….
-
-
-
-
__________________________________________________________
-
-
-
-
-
-
-
__________________________________________________________
-
-
_______
-
-
-
-
-
-
-
-
-
-
-
-
-
-
-
-
-
-
-
-
-
-
-