ঈশ্বর সাকার বা নিরাকার ?
কলমে:- সোমনাথ মন্ডল
১) বেদ অনুসারে ও সামান্য দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে ঈশ্বর নিরাকার। যদি ঈশ্বর সাকার হন তবে সব জায়গায় থাকতে পারবে না। কেননা আকারবান বস্তুর কোন না কোন তো পরিসীমা হবেই। এই জন্য যদি ঈশ্বর আকারবান হয় তবে সে তার পরিসীমার বাইরে হবেনা।
২) ঈশ্বরের আকারকে দেখতে পাওয়া তখনই সম্ভব যখন সে স্থূল হবে। কেননা প্রকাশকে পরিবর্তনকারী পদার্থগুলির দ্বারা সূক্ষ্ম পদার্থগুলিকে দেখা কোনদিন সম্ভব নয়। কিন্তু বেদে ঈশ্বরকে স্পষ্টরূপে সূক্ষ্মতম ছিদ্র রোহিত ও একরস বলা হয়েছে (যজুর্বেদ 40/8)। এইজন্য ঈশ্বর সাকার হতে পারে না।
৩) ঈশ্বর সাকার হওয়া মানেই তাকে কেউ না কেউ বানিয়েছে। কিন্তু এটা কি করে হতে পারে? কেননা তিনি তো সবাইকে বানিয়েছেন। তাহলে তাকে কেউ কি করে বানাতে পারে? আর যদি এটা বলি যে তিনি নিজেই নিজের আকার বানিয়েছেন তাহলে এর মানে হবে এর আগে তিনি নিরাকার ছিলেন।
৪) আর যদি আপনি এটা বলেন যে ঈশ্বর সাকার ও নিরাকার দুটোই হন। তাহলে এটা কোনভাবেই সম্ভব নয়। কেননা এই দুটো বিরুদ্ধ গুন একই পদার্থে সম্ভব হতে পারে না।
৫)আর যদি আপনি এটা বলেন যে ঈশ্বর সময়ে সময়ে দিব্য রূপ ধারণ করেন, তাহলে কৃপা করে এটা বলুন কার দিব্য রূপ ধারণ করেন? তবে আপনি ঈশ্বরীয় পরমাণু ও অনীশ্বরীয় পরমাণুর সীমা কিভাবে নির্ধারণ করবেন? কেননা যেহেতু ঈশ্বর সর্বত্র এক রস = এক সমান আছেন; তাহলে আমরা মানবীয় ঈশ্বর ও শেষ সংসাররুপী ঈশ্বরের মধ্যে অন্তর কি করে করব? আর যদি সব জায়গায় একই ঈশ্বর হয় তাহলে আমরা তার সীমা কি করে দেখছি?
৬) বাস্তবে যে মানব শরীর কে আমরা দেখছি এটি হল দ্রব্য ও উর্জার শেষ সংসারের সঙ্গে নিরন্তর স্থানান্তরণ। কোন পরমাণু বিশেষের জন্য এটি নিশ্চিত রূপে বলা সম্ভব নয় যে এটি মানব শরীরের অথবা বাকি শেষ সংসারের? এইজন্য মানবীয় ঈশ্বরের শরীর পর্যন্ত কে আলাদা করা সম্ভব নয়। উদাহরণ স্বরূপ তার মলমূত্র, ঘাম, থুতু আদিও কি তবে দিব্য হবে?
৭) বেদের মধ্যে কোথাও সাকার ঈশ্বরের আরাধনা নেই। আর এমন কোন কাজ নেই যাকে করতে হলে বিনা শরীরে সম্ভব হবে না, আর যে জন্য তাকে শরীর ধারণ করতে হবে।
৮) যাকে আমরা ঈশ্বরের দিব্য রূপ মানি। যেমন রাম ও কৃষ্ণ বাস্তবে তারা মহাপুরুষ ছিলেন। তারা দিব্য প্রেরণায় কাজ করতেন। সমস্ত মহাপুরুষ নিরাকার ঈশ্বরের উপাসনা করতেন। এবং তারা সকলেই ঈশ্বর অতিরিক্ত অন্য কারোর উপাসনার নিষেধ করতেন। এই জন্য তাদের মূর্তি গড়ে পূজা করার থেকে তাদের আদর্শ গুলির অনুকরণ করা দরকার।
৯) যদি ঈশ্বর অবতার নিত এবং সেই অবতারের মূর্তি গড়ে পূজা করলে মুক্তি হয়ে যেত তবে বেদগুলিতে সে বিষয়ে বর্ণনা অবশ্যই হতো। কিন্তু বেদে এমন কোন সংকেত নেই। বেদের যে মন্ত্রটিকে পৌরাণিকগন অবতারবাদ কে সিদ্ধ করার ক্ষেত্রে বলে সেই মন্ত্রটির ঋষিকৃত অর্থ হল সম্পূর্ণ আলাদা।
প্রজাপতিশ্চরতি গর্ভে অন্তরজায়মানো বহুধা বিজায়তে।
তস্য য়োনিং পরি পশ্যন্তি ধীরাস্তস্মিন্ হ তস্থুর্ভুবনানি বিশ্বা ।।
——- (যজুর্বেদ ৩১/১৯)
পৌরাণিক ভাষ্য:—- প্রজাদের পতি ভগবান গর্ভের ভেতরে বিচরণ করে। সেতো নিজে জন্ম রহিত হয় কিন্তু অনেক প্রকারে জন্মগ্রহণ করে থাকে। বিদ্বান পুরুষ তার উদ্ভব স্থানকে দেখতে পায় এবং বুঝতে পারে।
মহর্ষি দয়ানন্দ ভাষ্য:—- যে এই সর্ব রক্ষক ঈশ্বর নিজে উৎপন্ন না হয়ে নিজের সামর্থ্য দ্বারা জগতকে উৎপন্ন করেন এবং তাতে প্রবিষ্ট হয়ে বিচরণ করেন; যে অনেক প্রকারের প্রসিদ্ধ। সেই ঈশ্বরকে বিদ্বান লোকই জানতে পারেন। সেই জগতের আধাররূপ সর্বব্যাপী পরমাত্মাকে জেনে মানুষকে আনন্দ ভোগ করা উচিত।
ঈশ্বর সাকার না নিরাকার—– বৈদিক সিদ্ধান্ত
যর্জুবেদে (অধ্যায়_40,মন্ত্র_8) খুব স্পষ্টভাবে বলা আছে যে,ঈশ্বর শরীর ধারণ করেন না অর্থাৎ ঈশ্বরের অবতার বা সাকার রূপ হওয়া সম্ভব নয়।
ঈশোপনিষদ্, যর্জুবেদের 18টি মন্ত্র নিয়ে গঠিত। যর্জুবেদের,40/8 মন্ত্রটি পাওয়া যায়,ঈশোপনিষদের,8 নং মন্ত্রে।এই মন্ত্রের, শংকারাচার্য যা ভাষ্য করেছেন,তা মূল সংস্কৃত ভাষ্যসহ বাংলা অনুবাদ ও পদের অর্থ সহকারে দিলাম—————-
স পর্যগাচ্ছুক্রমকায়মব্রণ-
মস্নাবিরং শুদ্ধপাপবিদ্ধম্।
কবির্মনীষী পরিভূঃ স্বয়ম্ভূ-
র্যাথাতথ্যতোহর্থান্ ব্যদধাচ্ছাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ।।
ঈশোপনিষদ:মন্ত্র:8
যর্জুবেদ:অধ্যায়_ 40,মন্ত্র নং_8
ব্যাখ্যা:(অন্বয়)——
সঃ (সেই পরমাত্নাই), পর্যগাৎ ( সর্বত্র গিয়েছেন অর্থাৎ সর্বব্যাপী), [সঃ] (তিনিই), শুক্রম্ (জ্যোর্তিময়), অকায়ম্ (শরীরহীন), অব্রণম্ (ক্ষতহীন), অস্নাবিরং (স্নায়ু বা শিরাবিহীন), শুদ্ধম্(পবিত্র), অপাপবিদ্ধম (পাপ দ্বারা অবিদ্ধ বা ধর্ম অধর্মাদি রহিত), কবিঃ (ক্রান্তদর্শী), মনীষী (সর্বজ্ঞ), পরিভূঃ (সর্বোপরি বিদ্যমান), স্বয়ম্ভূঃ (নিজেই নিজের কারণ), [সঃ] (তিনি), শাশ্বতীভ্যঃ সমাভ্যঃ (নিত্যকাল ধরে), [সংবৎসরাখ্য প্রজাপতিদের জন্য], অর্থান্ ( বিষয় সমূহ বা কর্তব্য পদার্থসমূহ), যাথা-তথ্যতঃ (লোকের যথাযথ কর্মফল ও সাধনা অনুসারে), ব্যদধাৎ(বিধান করেছেন)।
অনুবাদ—–
তিনি অর্থাৎ পরমাত্মা, সর্বব্যাপী, জ্যোতির্ময় ও অশরীরী(অশরীর শব্দে পরমাত্মার লিঙ্গ শরীরের নিষেধ) ক্ষতরহিত, শিরাহীন, স্নায়ুহীন, (ক্ষতরহিত ও শিরাহীন শব্দে, স্থূল শরীরের নিষেধ), নির্মল (নির্মল শব্দে, কারণ শরীরের নিষেধ করা হল) ও অপাপবিদ্ধ।তিনি, সর্বদর্শী, সর্বজ্ঞ, সর্বোপরি বিদ্যমান ও স্বয়ম্ভূ।পরমাত্না, চিরকাল ধরে, লোকের যথাযথ কর্মফল অনুসারে কর্তব্য বিধান করছেন।
বিঃ দ্রঃ – এইবার নিজের যুক্তি দিয়ে ভাবুন। অসীম বস্তু সবসময় নিরাকার হয়।যেমন,মহাকাশ। ঈশ্বর তো সব জায়গায় আছেন অর্থাৎ জগতের সমস্ত অণু-পরমাণু ব্যাপ্ত করে আছেন। দেহধারণ করলে,ঈশ্বরের সর্বব্যাপকতা লোপ পায়। কারণ দেহধারী কখনোই সব জায়গায় থাকতে পারবেন না।
যাঁরা বলেন, ঈশ্বর সর্ব শক্তিমান তাই সাকার হতে পারেন,তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি, যেখানে স্বয়ং ঈশ্বর বেদবাণীতে বলছেন, তিনি স্থুল,সূক্ষ্ম ও কারণ শরীর ধারণ করেন না, সেখানে আপনি ও আপনাদের গুরুরা কি, ঈশ্বরের চেয়ে বেশি জ্ঞানী হয়েছেন নাকি?!!!
কিছু অতিজ্ঞানী মূর্খ বৈষ্ণব বলেন, ঈশ্বরের শরীর অপ্রাকৃত!! ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেছেন, প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে।তাহলে নিজের অপ্রাকৃত শরীর কোন উপাদান দিয়ে সৃষ্টি করেছেন?!! এই অপ্রাকৃত শরীরের উপাদান, ঈশ্বর মনে হয়, বৈষ্ণবদের ঘর থেকে সংগ্ৰহ করেন!!!
এইজন্য বলা হয়, বেদ বিরোধী নাস্তিক সম্প্রদায়ের নাম হল বৈষ্ণব।