ছোট গল্প – রূপনগর

কলমে – মধুমিতা দেব

আমি তখন বেশ ছোট, পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি।এখনকার মত টিভির হাজার চ্যানেল,মোবাইল এইসব বিনোদন তখন ছিল না। পড়াশোনার ফাঁকে গল্পের বই, খেলাধুলা এগুলোই ছিল আমাদের বিনোদন। আমাদের পাড়ার পাঁচিলের উল্টো দিকেই একটা বেশ পোড়ো রাজবাড়ী ছিল। সেখানে দীর্ঘ দিনের অযত্নে,চারদিকে জঙ্গল হয়ে ছিল। আমাদের বাড়ী থেকে সবসময়ই দেখা যেত বাড়ীটা। ছোট থেকেই জেনে এসেছি, ওটা একটা রাজবাড়ি, এক দুষ্ট ডাইনির অভিশাপে, রাজমহলের সবাই পাথর হয়ে আছে।জঙ্গলে ডাইনি বুড়িটা নাকি রাতে ঘুরে ঘুরে পাহাড়া দেয়। পাঁচিলের একটা অংশ  খানিকটা ভাঙা ছিল।আমরা লুকোচুরি খেলার সময় প্রায় ওখানে লুকিয়ে যেতাম, যদিও বাড়ীর বড়দের চোখের আড়ালে। হয়ত জঙ্গলে বিষাক্ত পোকা-মাকড়, সাপ-খোপের ভয়েই এই নিষেধাজ্ঞা ছিল কিন্তু সে সব কথা কানে নিলে তো…

আমি অনেকবার বিকেলের দিকে ঐ জঙ্গলে লুকাতে গেছি,তবে লুকোনোর বাহানায় ঐ রাজবাড়ির রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টাই করতাম বেশী। রাজবাড়ির চারদিকে লাল রঙের শানবাঁধানো জায়গার বেশীরভাগ  রঙচটা,শ্যাওলাধরা, জঙ্গলীলতায় ভরা। পাশে এক জায়গায় রংবেরঙের একটু বড় আর উঁচু বেদী,হয়ত এখানেই রাজনর্তকী নাচ করত।দীর্ঘ অযত্নে গাছ-লতাপাতায় জঙ্গল হয়ে থাকত।একটু দূরে একটা পুকুরও ছিল,তার পাশে বেশ বড় বড় গাছ আর লতা পাতায় ভরা।রাজবাড়ির বাইরের বেদীটায় উঠে দাঁড়ালে,পুকুর বলে বোঝা যেত,নইলে জঙ্গলই মনে হয়।আসলে এটাই মায়া পুকুর, ঐ দুষ্ট ডাইনিটা এখানেই থাকে,রাতের বেলা রাজবাড়িতে ঘোরাফেরা করে। বাড়িটার সামনে বিশাল এক দড়জায় প্রকান্ড তালা ঝুলত।বন্ধ দড়জার ওপারে যাওয়ার তো কোন উপায় নেই। কিন্তু একতলার অনেকগুলো ভিতর থেকে বন্ধ জালনার মধ্যে একটা জালনা খানিকটা ভাঙা ছিল।আমি মাঝে মাঝেই এই জালনায় উঁকি দিয়ে দেখার দেখার চেষ্টা করতাম, বন্ধ-দড়জার ওপারে পাথর হয়ে যাওয়া রাজা- রানীকে।রাজা-রাণীকে তো দেখা যেত না,তবে অন্ধকারে খুব অস্পষ্ট দেখতে পেতাম, পালঙ্কে রাজকন্যা পাথর হয়ে ঘুমিয়ে আছে।আর এই রাজকন্যাকে দেখার লোভেই, মাঝে মাঝেই সকলের চোখের আড়ালে,চলে যেতাম সেখানে।

একদিন, বিকেলবেলা ওখানে লুকোতে গেছিলাম,শীতের বিকেল,সন্ধ্যে প্রায় হয় হয়। হঠাৎই শুনলাম খটাখট, খটাখট আওয়াজ। দেখতে পেলাম, ঘোড়ায় চড়ে, এক অপূর্ব সুন্দর রাজকুমার রাজবাড়ির দিকেই আসছে। তাই দেখে আমি ওই উঁচু বেদীটার আড়ালে গিয়ে বসলাম। রাজকুমার ততক্ষণে,তলোয়ার দিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করতে করতে, সেই বিশাল সিংহ দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বন্ধ দড়জার উপর জমে থাকা,লতাপাতা সাফ করে এক বিরাট চাবি বের করে যেই না তালাতে ছোঁয়াল, তখনই চিচিংফাঁক। ঘড়ঘড় শব্দে দড়জাটা খুলে গেল আর চারদিক আলোয় আলোয় সেজে উঠল। দেখলাম,আর সেই পুরোন রাজবাড়ি আর নেই, এক অপূর্ব রাজপ্রাসাদ,যার সোনার থামগুলোয় চুনি-পান্নার কাজ করা। রাজকুমার ঘোড়াটাকে, একটা বড় গাছে বেঁধে রেখে,ঢুকে পড়ল রাজবাড়িতে,আর তার পিছু নিলাম আমি। দেখি, পালঙ্কে অপূর্ব সুন্দরী রাজকন্যা পাথর হয়ে ঘুমিয়ে আছে। রাজপুত্র কন্যার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই, রাজকন্যা তার পদ্ম আঁখি মেলে জেগে উঠল। রাজপুত্র বলল, “চল রূপমতী, আমরা আবার রূপ নগরকে জাগিয়ে তুলি।” রাজকন্যা রূপমতী সম্মতি জানিয়ে, রাজপুত্রের হাত ধরে যেই পালঙ্ক থেকে নেমেছে, তখনি এক বিদঘুটে হুঙ্কারে সারা বাড়ী কেঁপে উঠল।দেখলাম,কোথা থেকে ডাইনি বুড়িটা এসে দাঁড়িয়েছে দড়জার সামনে। তার মাথা ভর্তি জট পাকানো চুল, বড় বড় নখ, গজালের মত দু পাটি দাঁত আর লাল লাল ভাঁটার মত চোখ। সে বিচ্ছিরি খোঁনা গলায় চেঁচিয়ে বলে উঠল,

“জঁটিবুঁড়ির বন্ধ দড়জা,

কেঁ খুঁলল আঁজ?

চিঁবিঁয়ে খাঁব মুঁন্ডুটা তাঁর,

কঁরল যেঁ এই কাঁজ।।”

এই না বলে যেই, রাজকন্যার সামনে যেতে গেছে, সাথে সাথেই আমি, সামনে এসে এক ধাক্কা মারলাম ডাইনিটাকে, আর চেঁচিয়ে বললাম,” পালাও রাজকুমার, রূপমতী আর রূপ নগরকে রক্ষা কর।”

আমার কান্ড দেখে ডাইনি তো রেগে টং।সে আবার বলে উঠল,

“পোঁড়াঁরমুঁখী, শঁয়তাঁনী রে

বঁয়স বুঁঝি দঁশ,

তোঁর গাঁয়েতে ঘঁষবোঁ এঁবাঁর,

জঁলবিঁছুটির রঁস।”

এই বলে, সে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে,বিছুটি পাতার রস লাগিয়ে দিল আর আমার চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাতে লাগল।আমি চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলাম যন্ত্রনায়। চোখ মেলে দেখি,আমার মা, চুলের মুঠি ধরে আমাকে জাগাচ্ছে। সামনে দাঁড়িয়ে আছে,বাবা আর পাড়ার কয়েক জন কাকু।আমি, রাজবাড়ির বেদীটাতে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছিলাম। মা রেগে গিয়ে বলল,” কতবার বলেছি,এখানে আসবি না,সাপ-খোপ কত কিছু আছে,সারা গায়ে কি সব কামরেছে,চল্ বাড়ী,দেখাচ্ছি মজা…”

আমি অবশ্য জানতাম, গায়ে কিছু কামরায়নি, ওটা বিছুটির রস।এ কথা বললে তো আর কেউ বিশ্বাস করবে না।

পাড়ার কাকুরাও, বড়দের কথা শোনা সংক্রান্ত একপ্রস্থ জ্ঞান দিল।বাড়ি ফেরার পর কি হল, তা বলাই বাহুল্য।

এরপর,কড়া প্রহরা এড়িয়ে আর রূপনগরে যাওয়া হয়নি।এর কিছুদিন পরেই,পাড়ার বড়দের উদ্যোগে পাঁচিল মেরামত করা হয়ে গেল।

জালনা দিয়ে জঙ্গল ঘেরা রাজবাড়িটা চেয়ে দেখতাম  আর ভাবতাম, রাজকুমার আর রূপমতীর কি হল কে জানে,ওরা কি পালাতে পারল?না ডাইনিবুড়িটা,আবার ওদের পাথর করে দিল?রাজকুমার কি আবার রূপ নগরের রূপ ফিরিয়ে দিতে পারবে?রাজবাড়ির বন্ধ দড়জা কি আবার খুলতে আসবে রাজকুমার?

এভাবেই কেটে গেল অনেকগুলো বছর।আমার বিয়ের কয়েক বছর পরে একবার বাড়ী এসে, অভ্যাস বশত জালনা দিয়ে, জঙ্গল ঘেরা রাজবাড়ি,আমার রূপনগরটা দেখতে গিয়ে চমকে উঠলাম।

ঝাঁ চকচকে বিশাল উঁচু উঁচু ফ্ল্যাট ওখানে,পুকুরের জায়গার সুইমিং পুল, উপরে বড় বড় করে লেখা ‘দিগন্তিকা’।

Loading