ছোট্ট অচিন
✍️ – কলমে: স্মরজিৎ দত্ত
বেহালা, পর্ণশ্রী, কলকাতা
ছোট্ট মেয়ে অচিন ছোটবেলা থেকেই স্কুলে যাবার বয়সের আগেই, সকলের দেখাদেখি সেও বই বগল দাবা করে রাস্তার দিকে হাঁটা দিত স্কুলে যাবে বলে। এক সময় বাবা তাকে বয়সের আগেই স্কুলে ভর্তি করাতে বাধ্য হয়েছিল। সেই দিন থেকে কোনদিন অচিন, অচিন পাখি হয়ে অন্যকোনো জায়গায় হারিয়ে যায়নি। বাবার ছোট্ট মুদি দোকানে কেউ কোন বই বিক্রির জন্য দিয়ে গেলেও সেখান থেকে অচিন তার পছন্দের ছোট্ট বই বেছে নিয়ে জমা করত তার একান্ত আপন একটি বাক্সে।
ছোটবেলায় রং দেখে বই দেখে তার পছন্দ হয়ে যেত যে সকল বই, যা কোন এক সময় রেখে দিয়েছিল তার একান্ত বাক্সে ; আজকে কিশোর বয়সে এসে সেগুলোই তার অবসর সময়ের খোরাক।
বাবা মা তেমন পড়াশোনা না জানলেও মেয়ের পড়াশোনার উৎসাহে তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে, মেয়েটিকে মানুষ করবার। মেয়েও ছোটবেলা থেকে এত বই পাগল, ভাবাই যায় না।
স্কুলের দিদিমণি একদিন তাকে বলেছিল হাঁরে! তোর নাম অচিন কেন রে? সরল মনে সেদিন সে বলেছিল জানিনা দিদি । তবে জান শুনেছি অচিন নামে একটা পাখি আছে। আমার খুব ইচ্ছে হয়, যদি এমন সত্যি আমি পাখি হতাম, তবে ওই নীল আকাশে ঘুরে বেড়িয়ে কত কিছু দেখা যায়, কত কিছু জানা যায়, কত কিছু শেখা যায়।
স্কুলের নিয়ম ছিল সেভেনে উঠলে তবেই লাইব্রেরির কার্ড হবে। কিন্তু অচিন সে তো অনেক ছোটবেলা থেকেই বই পাগল। বুঝি বা না বুঝি গল্পের বই পেলেই হল; তাকে পড়তেই হবে। শেষে বড়দিদির বিশেষ অনুমতিতে লাইব্রেরীর দিদি তাকে সেই বয়সেই সুযোগ করে দেয় ওই বই ঘাটার।
টিফিন বেলাটা অচিনের কাছে বিরাট পাওনা। ঘন্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে যায় লাইব্রেরীর পানে। সেখানে একটা বই নিয়ে বসে পড়ে গোগ্রাসে তার কাহিনী সংগ্রহ করবার জন্য। টিফিন খাওয়া, সেটা তার সাথেই চলে। গল্প পড়াই তার মুখ্য কাজ। টিফিন সেটা উপলক্ষ মাত্র। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাতে থাকে টিফিন শেষ হয়ে যাবে; কিন্তু গল্পতো শেষ হবেনা । বইটি অসমাপ্ত করেই ছুটে যায় লাইব্রেরির দিদির কাছে । বলে দিদি তুমি এই বইটা না কাউকে দিও না। আমি ছুটির বেলায় এসে শেষ করে দেব। তারপরে তুমি দিয়ে দিও। লাইব্রেরীর দিদি বলে, ওরে বোকা মেয়ে, এত তাড়াতাড়ি শেষ করবি কি করে? ছুটির পরে সত্যি সে গোগ্রাসে গিলে ফেলে সেই বই। দিদিও অবাক হয়ে যায় সেই ছোট্ট মেয়ের বইয়ের নেশা দেখে।
সিক্স থেকেই ধীরে ধীরে সবার নজরে পড়ে গিয়েছিল অচিন। একাধারে পড়াশোনার রেজাল্ট, সাথে গান, নাচ, আবার একটু একটু দেয়াল পত্রিকায় লেখার রেওয়াজ গড়ে তুলতেও ভোলেনি।
স্কুলের সকলের কাছেই বড় প্রিয় অচিন। ছোট, বড়, শিক্ষিকা অফিস স্টাফ, প্রধান শিক্ষিকা, সকলেই এক ডাকে চেনে তাকে,তবে ছাত্রী হিসেবে নয় সবাই স্কুলে চেনে বই পাগলী হিসেবে।
একসময়, এমন শব্দটা শুনলে অচিনের খারাপ লাগলেও আজকে অচিন, খুব সুখী, খুব আনন্দিত, ওই নামেই কেউ ডাকলে। যে বছর মাধ্যমিক দিয়েছিল , সে বছর ওর মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য যত না কষ্ট হয়েছিল; তার থেকে বেশি কষ্ট হয়েছিল স্কুল ছেড়ে তাকে চলে যেতে হবে বলে। নাইনে থাকতেই একদিন সেই কষ্টের কথা বড়দিদিকে বলেও ফেলে। বড়দিদি তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ওরে পাগলি মেয়ে, তোকে আমাদের ছেড়ে কোথাও যেতে হবে না আমরা এ বছরই উচ্চমাধ্যমিকের অ্যাপিলেশন্ পাব। ফাইনাল হয়ে গেছে। অচিন আনন্দে বলে উঠেছিল দিদি, আমরা উচ্চমাধ্যমিকে যখন পড়বো ওই লাইব্রেরির বই আমরা পড়তে পারব। সেদিন দিদি রসিকতা করে বলেছিল, না ওটা তো শুধুমাত্র ছোটদের । তুইতো তখন বড় হয়ে যাবি কি করে পড়বি? বিমর্ষ মুখের দিকে তাকিয়ে বড়দিদিকে এক সময় বলতে বাধ্য হতে হয়েছিল ওরে পাগলী, বইকি কেবল ছোটদের হয়! আমিও তো ফাঁক পেলে ছুটে যাই ওই লাইব্রেরীতে। তোকে বই না পড়ালে আমারও তো কষ্ট বেশি হবে। খুব আনন্দে কেঁদে ফেলেছিল সেদিন অচিন।
অচিন মাধ্যমিক পরীক্ষায় ওই জেলায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিল। অসহায় পরিবারের পাশে সেদিন স্কুলের দিদি, পাড়ার পরিজন, সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে ছিল ওই বই পাগলী অচিনের পাশে। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক তাতেও বেশ নাম রেখেছিল স্কুলের সে।
তারপর সেই অচিন যেদিন শেষবারের মতো স্কুলে তার উচ্চমাধ্যমিকের মার্কশীট নিয়ে বাড়ি ফিরবে; সেসময়ে বড়দিদিকে সে বলেছিল আমার এক কাকা আমাকে প্রেসিডেন্সি কলেজের ফর্ম তুলে এনে দিয়েছে। ওখানে পরীক্ষা হবে আমাকে একটু আশীর্বাদ করুন, যেন সেই পরীক্ষায় আমি সাফল্য পাই। শুনেছি ওখানের লাইব্রেরীটা খুব ভালো। আমাকে ওখানেই ভর্তি হতেই হবে। দিদি আমি ওখানে চলে গেলেও যদি কখনো স্কুলে আসি আমাকে লাইব্রেরীতে বই পড়তে দেবে?
সেদিন বড় দিদি তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল যতদিন তুই চাইবি আসবি; সবাই তোকে চেনে, লাইব্রেরীতে বই পড়বি তাতে আর অসুবিধে কি?
দীর্ঘ বছর পার হয়ে গেছে অচিন আজ আমেরিকা নিবাসী তবে তার স্কুলের লাইব্রেরির উন্নতির জন্য তার কর্মের পয়সা থেকে কিছু পয়সা বাঁচিয়ে, প্রতিবছর বেশ কিছু টাকা দান করে সে স্কুলে শুধু বইয়ের জন্য। অচিন , অচিন পাখি হয়ে উড়ে গেলেও তার পুরনো বইয়ের ঘরকে, মাধ্যমিকের স্মৃতি ঘেরা উচ্চমাধ্যমিকের স্মৃতি বিজড়িত সেই ঘরকে আজও সে ভোলেনি। অচিন, অচিন পাখি হয়ে যায়নি উড়ে