মেঘের দেশের হাতছানি
নির্জন সেই দাওয়াই পানি
স্বরূপ গোস্বামী
বাঙালির জীবনে দাদার অভাব নেই। ফেলুদা, ঘনাদা, টেনিদা, ভজাদা, ব্রজদা। এমন কত দাদা ছড়িয়ে আছে সাহিত্যে। আর পাড়ায় পাড়ায় তো বিচিত্র সব দাদার সমাহার। কিন্তু বাঙালির বেড়ানোর কথা উঠলেই আরও এক দাদা চলে আসে। সে হল দীপুদা। তার মানে হল, দীঘা–পুরী–দার্জিলিং। বাঙালি রেস্তোরাঁয় গিয়ে মেনু কার্ড খুঁটিয়ে দেখে। কোনটা কেমন, তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করে। ওয়েটারকে নানা প্রশ্ন করে। কিন্তু অর্ডার দেওয়ার সময় শেষমেশ সেই চিলি চিকেন। তার বাইরে আর বেরোতে পারে না। বেড়ানোর ক্ষেত্রেও তাই। নানা জায়গা নিয়ে গবেষণা করবে।
পাড়ায়, অফিসে, চায়ের দোকানে নানা লোকের মতামত নেবে। ইদানীং আবার অনেকে ফেসবুকে এক লাইন লিখে দিচ্ছেন, পাহাড়ে তিনদিনের জন্য কোথায় যাওয়া যায়? ঘনঘন কমেন্ট উপচে পড়ছে। কে কত জানেন, এই সুযোগে উজাড় করে দিচ্ছেন। কিন্তু যিনি মতামত চাইলেন, তিনি শেষমেশ কোথায় গেলেন? খোঁজ নিয়ে দেখুন, সেই দীঘা, পুরী বা দার্জিলিং। এই বৃত্তেই তিনি আটকে পড়েছেন।
এই তিনটে জায়গাই অনেকবার গেছি। তাই ঠিক করেই নিয়েছিলাম, এবার এই তিনটে জায়গা বাদ দিয়ে অন্য কোথাও। পাহাড়েই যাব। কিন্তু দার্জিলিং নয়। এক বন্ধু সন্ধান দিল দাওয়াই পানি। সে নাকি মাস খানেক আগে ঘুরে এসেছে এই পাহাড়ি জনপদ থেকে। কয়েকটা হোম স্টের ফোন নম্বরও দিয়ে দিল। মনে হল, যাওয়ার আগে অন্তত হোম স্টে গুলোর সঙ্গে একবার কথা বলে নেওয়া যাক। কবে ফাঁকা আছে, কীভাবে বুকিং করব, এগুলো জেনে রাখতে তো ক্ষতি নেই। ফোন করে ফেললাম
বীরেন রাইকে। খুব গুছিয়ে কথা বলেন, এমন নয়। কিন্তু অল্প কথায় আন্তরিকতা মন ছুঁয়ে গেল। চলো পানসি, দাওয়াই পানি। কিন্তু এমন নাম কেন? দাওয়াই মানে তো ওষুধ। আর পানি মানে জল। ওষুধ আর জলের কী সম্পর্ক? জানা গেল, অনেক আগে এখানে এক ইংরেজ সাহেব থাকতেন। তাঁর পায়ে একটা ক্ষত তৈরি হয়েছিল। অনেক ডাক্তার দেখানোর পরেও ঠিক হয়নি। কিন্তু কাছেই একটা ঝর্না ছিল। স্থানীয় একজনের টোটকায় সেই ঝর্নার জল নিয়মিত পায়ে লাগানোর পর নাকি সাহেবের পা ভাল হয়ে যায়। সেই সাহেব সেই ঝর্নার জলের নমুনা নিয়ে ল্যাবরেটারিতে পরীক্ষা করালেন। দেখা গেল, দুর্লভ কিছু গুণ রয়েছে সেই জলে। যা অনেকটা ওষুধের কাজ করে। অর্থাৎ, এমন পানি যা আসলে দাওয়াইয়ের কাজ করে। সেই থেকে লোকমুখে নাম হয়ে গেল দাওয়াই পানি।
আমরা ছিলাম দুই বন্ধু। একজন নিখাদ ব্যাচেলর। আর এই অধম সংসারে থেকেও কিছুটা সন্ন্যাসী গোছের। মাঝে মাঝেই বেরিয়ে পড়ি। এনজেপি তে নেমে চাইলে ভাড়া গাড়িও নেওয়া যায়। কিন্তু আমাদের বড় বাহিনীও নয়। আবার বেশি মালপত্তরও নেই। অগত্যা দার্জিলিংগামী শেয়ার গাড়িতে নেমে গেলাম জোড়বাংলোয়। সেখান থেকে রিজার্ভ করে দাওয়াইপানি। জোড়বাংলো থেকে মোটামুটি এক ঘণ্টা। গিয়ে পৌঁছে গেলাম বীরেনজির আস্তানায়।
মেঘের দেশে তো আগেই পৌঁছে গিয়েছি। রোহিনী পেরিয়ে একটু একটু করে পাহাড়ে উঠতেই গাড়ির জানালা দিয়ে মেঘ ঢুকে পড়ছে। হালকা একটা হিমেল হাওয়া যেন অন্য এক মাদকতা এনে দিচ্ছে। আগামী কয়েকদিন এই মেঘই আমাদের সঙ্গী, এটা ভেবে পরতে পরতে একটা রোমাঞ্চ যেন তাড়া করছে। গাড়ি থেকেই বীরেনজির সঙ্গে বেশ কয়েকবার কথা হয়ে গেছে। আমরা ট্রেন থেকে নামলাম কিনা, কতদূরে আছি, কোন পথে আসছি, খোঁজ নিলেন। পৌঁছে যেতেই একগাল হাসি। বুঝলাম, আগামী তিনদিন আতিথেয়তায় কোনও ত্রুটি হবে না।
বাড়ির সামনেই একটা বেঞ্চ পাতা। ঘরে ঢোকার আগেই সেদিকে চোখ চলে গেল। সামনে একেবারে খোলা জায়গা। সামনে কোনও বাড়ি নেই। কোনও জনপদ নেই। একেবারে খোলা পাহাড়। দূরে নাম না জানা সব পাহাড়ের সারি। আহা, এই বেঞ্চে বসেই তো অনন্ত সময় কেটে যায়। গেয়ে উঠলাম, ‘আমার আর কোথাও যাওয়ার নেই। কিচ্ছু করার নেই।’ আসার পথে কার্শিয়াংয়ের কাছাকাছি একপ্রস্থ ব্রেকফাস্ট হয়ে গেছে। ফলে, পেটে তেমন টান নেই। একটু বেরিয়ে পড়লে মন্দ হয় না। ব্যাগ রেখে, একটু ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পাইনের জঙ্গল তো আছেই। নাম না জানা গাছের ভিড়। সেই গাছের ফাঁকেই আপনমনে মেঘ খেলে যাচ্ছে। এই রাস্তা দিয়ে অনন্ত পথ হেঁটে যাওয়াই যায়। একটু চড়াই উতরাই আছে। তাই নামতে গেলে মনে হচ্ছে, এই পথে আবার উঠে আসতে হবে।
পায়ে পায়ে চলতে চলতে আরও একটা হোম স্টে চোখে পড়ল। নামটা ভারী সুন্দর— আড্ডা হাট। খোঁজ নিয়ে জানলাম, এক বঙ্গসন্তান নাকি এটি তৈরি করেছেন। বেশ গোছালো। কিন্তু মুশকিলটা হল, রাস্তা থেকে অনেকটা পথ উঠতে হয়। আমাদের হয়ত সমস্যা হবে না। তবে বয়স্ক লোকেদের পক্ষে এতটা পথ বারবার ওঠা–নামা করা মুশকিল। একটু নীচেই চোখে পড়ল আরও একটা হোম স্টে— রোভার্স স্টে।
সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে আপন মনে হেঁটে গেলাম। অনেকটা উদ্দেশ্যবিহীনভাবেই। আমাদের তো কোনও তাড়া নেই। আমরা তো গায়ে মেঘ মেখে আপন মনে হেঁটে বেড়াতেই এসেছি। সোয়া একটা নাগাদ একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন। বীরেনজির ডাক, ‘সাব লাঞ্চ রেডি। আপলোগ কাঁহা হ্যায়।’ চাইলে আরও অনেকদূর হাঁটাই যেত। কিন্তু মনে হল, খাবার ঠাণ্ডা হয়ে গেলে খেতে ভাল লাগবে না। তাছাড়া, বীরেনজি এত যত্ন নিয়ে বানিয়েছেন, অহেতুক ঠাণ্ডা করতে যাবই বা কেন? ফিরে এলাম হোম স্টে–তে। কিন্তু এখনও তো স্নান হয়নি। সফরসঙ্গী বন্ধু বলল, রোজ তো স্নানের পর খাই। এই পাহাড়ে না হয় উল্টোটাই হোক। তথাস্তু। ডাইনিংয়ে গিয়ে দেখলাম, দারুণভাবে টেবিল সাজিয়েছেন বীরেনজি। গরম ভাত, পাহাড়ি ডাল, ফুলপি–আলুর সবজি, স্যালাড, রাই শাক, ডিমের ঝোল সঙ্গে পাপড়। এই পাহাড়ে কে আর ক্যালরির হিসেব কষে! বাইরে গেলে ওই খাদ্য সংযম শিঁকেয় তুলে রাখাই ভাল। বীরেনজি মাঝে মাঝেই এসে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছেন, ‘স্যার, অর কুছ চাহিয়ে! খানা ঠিকঠাক হ্যায় তো?’ এমন সুস্বাদু খাবার। তার সঙ্গে এমন আন্তরিকতা। মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতোই।
খাওয়ার পর স্নান সেরে কিঞ্চিত বিশ্রাম। পরে মনে হল, আরও এক রাউন্ড ঘুরে এলে কেমন হয়। বাইরে এসে শুয়ে–বসে দিন কাটাব? একটু পরেই তো ঝুপ করে সন্ধে নেমে যাবে। তখন তো আর কোথাও যাওয়ার থাকবে না। এমনকী ঠান্ডায় বাইরে বসাও মুশকিল। তাই, মিস্টি রোদ থাকতে থাকতে আরও এক রাউন্ড হেঁটে আসা যাক। বীরেনজি দেখিয়ে দিলেন অন্য একটা রাস্তা। সিঞ্চোল ফরেস্টের ভেতর দিয়ে। সেই রাস্তাটাও ভারী চমৎকার। আপনমনে সেই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে গেলাম। যতদূর মন চায়। ফিরে এলাম সন্ধে নামার মুখে। আকাশ দুপুরদিকে মেঘলা ছিল। তাই শ্রীমান কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন দেননি। গোধূলির লাল আভা গিয়ে পড়ল সেই কাঞ্চনজঙ্ঘায়। আহা, কী অপূর্ব ক্যানভাস।
উল্টোদিকের পাহাড়গুলোয় একে একে জ্বলে উঠছে আলো। মানচিত্রটা একটু বোঝার চেষ্টা করলাম। কোনদিকটা দার্জিলিং, কোনদিকটা লেবং, কোনদিকটা তাকদা। কী আশ্চর্য, এখান থেকে সিকিমের নামচির আলোও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এসব দেখেই বোধ হয় বিশ্বকবি লিখেছিলেন, তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা। দূর পাহাড়ের ওইসব চেনা–অচেনা জনপদ যেন আলোর মালা জ্বেলে হাতছানি দিচ্ছে। ওদিক থেকেও হয়ত আমাদের মতো কোনও টুরিস্ট দেখছে দাওয়াই পানি। এদিকের আলোগুলোও কি ওদিক থেকে দেখা যাচ্ছে? রাত বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঠাণ্ডা হাওয়াও। শীতবস্ত্র গায়ে চাপিয়েও কাঁপুনি এড়ানো যাচ্ছে না। তারই মাঝে সন্ধের টুকটাক স্ন্যাক্সের পর রাতের খাবারও তৈরি। পাহাড়ে তাড়াতাড়ি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার রেওয়াজ। কিন্তু আমরা তো এত সুবোধ বালক নই। এত তাড়াতাড়ি খাওয়ার অভ্যেস নেই। যস্মিন দেশে যদাচার। যেখানকার যা নিয়ম, তা মেনে চলাই ভাল। আমরা রাত জাগি বলে এই পাহাড়ি সহজ–সরল মানুষগুলোকে অহেতুক জাগিয়ে রাখার কোনও মানে হয় না। সাড়ে আটটার মধ্যে ডিনার কমপ্লিট। আবার ঠাণ্ডায় বাইরে বসাও মুশকিল। মাঝে মাঝেই এসে বসছি সেই বেঞ্চে। আবার ঠাণ্ডায় কখনও ফিরে যাচ্ছি ঘরে। মোবাইলে অনেক সিনেমা, নানা রমক ভিডিও ডাউনলোড করাই আছে। চাইলেই দেখা যায়। কিন্তু এই পাহাড়ে এসে মোবাইল থেকে যত দূরে থাকা যায়, ততই ভাল। এভাবেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম, কে জানে!
ঘুম ভেঙে গেল বেশ ভোরের দিকেই। সাত সকালেই অন্য একটা রাস্তা ধরে আরও এক রাউন্ড হেঁটে এলাম। একটু একটু করে ঘুম ভাঙছে পাহাড়ের। চেনা মোরগের ডাক তো আছেই। সেইসঙ্গে নাম না জানা কত পাখির কিচির মিচির। একটু একটু করে রোদও উঠছে। এখানে ভিউ পয়েন্টের জন্য মাইলের পর মাইল হাঁটতে হয় না। একেকটা বাঁকে দাঁড়িয়ে পড়ুন। সেটাই যেন ভিউ পয়েন্ট। আর আমরা যে হোম স্টে–তে উঠেছি, সেটা নিজেই তো এই এলাকার সেরা হোম স্টে। ঝকঝকে আকাশ থাকলে বিছানা থেকেই দিব্যি দৃশ্যমান হয় কাঞ্চনজঙ্ঘা। আর উঠোনের ওই বেঞ্চিতে গিয়ে বসলে তো কথাই নেই। একটু উঁকি দেওয়া নয়, অনেকটা রেঞ্জজুড়ে তার বিস্তার। সূর্যের আলো গিয়ে ঠিকরে পড়ছে ওই বরফঢাকা শ্বেতশুভ্র পাহাড়ের ওপর। পরতে পরতে বদলে যাচ্ছে সেই পাহাড়ের রং। এমন স্নিগ্ধ ভোর কতদিন দেখিনি। এ কোন সকাল যা জীবনের সব গ্লানি মুছে দিয়ে যায়। এমন সুন্দর সকালই তো একটা সুন্দরতর দিনের জন্ম দিয়ে যায়। আরও একটা দিন। তারপর পাহাড়জীবন শেষ। কিন্তু এই সকালের রেশটা যদি বাকি দিনগুলোতেও ধরে রাখতে পারতাম! দাওয়াই পানি, এই অনুভূতিটুকু সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি। তোমার আপত্তি নেই তো!