বেঁচে থাকার স্বামী

কলমে  – স্মরজিৎ দত্ত

এম/৫, বেচারাম চ্যাটার্জী রোড, পো- বেহারা, থানা- পর্ণশ্রী

 

সঞ্চারী শেখর পাশাপাশি দুই গ্রামের দুই ছেলে মেয়ে তারা একই সাথে স্কুলের দোরগোড়ায় প্রবেশ করে। স্কুলের টিফিনের থেকে, খেলাধুলা সবকিছুতেই ওই ছোট বয়সেই শেখরের অভিভাবক হয়ে উঠেছিল ঘরের বাইরে সঞ্চারী। শেখর তার স্কুলের কাজ করেছে কিনা? শরীর ভালো না থাকলে স্কুল থেকে যে কাজ দিচ্ছে তাই যত্ন করে গুছিয়ে শেখরের বাড়ি পৌঁছে দেওয়া ,এমন সকল কাজের দেখভাল সঞ্চারী সেই ছোট থেকেই পালন করে আসছে।

সঞ্চারী আজ একটু বড়। বয়সে বড় হবার সাথে সাথে অন্যদিকেও তার অভিভাবকত্ব বেড়েছে। সারাদিনে একবার সে শেখরের বাড়ি যাবেই শেখরের খাওয়া হয়েছে কিনা? শেখর স্কুলের হোম টাক্স সমস্ত কিছু করেছে কিনা তার সব খোঁজ নিয়েই সে বাড়ি ফেরে। ছুটির দিনে শুধু শেখরের খোঁজ নয়, শেখরের বাড়ি গিয়ে শেখরের মায়ের সাথে কিছু কাজ আগুপিছু করে দেওয়া; সাথে আবার খোঁজও নেয় কাকু অর্থাৎ শেখরের বাবা সেই ভোরে ক্ষেতে চলে গেছে চাষের কাজে; দুপুর পেরোতে যায় তার খিদে লাগবেই তাই শেখরের মায়ের কাছ থেকে তার খাবার গুছিয়ে নিয়ে ছুটে যায় ক্ষেতে। সেখানে শেখরের বাবাকে যত্ন করে খাইয়ে আবার সে ফিরে আসে বাড়িতে। শেখরের বাবাও নিজের অজান্তেই সঞ্চারীকে নিজের মেয়ের মতনই ভালোবাসে। দূর থেকে মাঝেমধ্যে যখন সঞ্চারীকে খাবার নিয়ে আসতে দেখে নিজের কাজ ছেড়ে দূর থেকে দুহাত তুলে আহ্বান করে ওই মেয়ে সঞ্চারীকে।

সঞ্চারীও তার বাবা-মার একমাত্র মেয়ে, তাদের অবস্থা শেখরের থেকে একটু অবস্থাপন্ন। বাবা তার উত্তরাধিকার সূত্রে একটি মুদি দোকানের মালিক । মা প্রথম অবস্থায় সংসারের হাল ফেরাবার জন্য টুকটাক হাতের কাজ করে দুপয়সা কামালেও এখন সে নিখাদ গৃহবধূ।

দেখতে দেখতে সঞ্চারী কিংবা শেখর উভয়েই মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসবার উপযোগী হয়ে উঠলো। স্কুলে তারা একসাথে পড়লেও প্রতিবারই সঞ্চারী শেখরের থেকে বেশি নাম্বার পেয়েই পাশ করতো। তার জন্য শেখরকেও অনেক কথা শুনতে হতো । আড়ালে দাঁড়িয়ে সঞ্চারী শুনে কিছুটা কষ্ট পেলেও, পরে লুকিয়ে এসে শেখরকে বোঝাতো, বাবা-মা অমন বলেই ; দুঃখ পেয়ো না। দেখবে কোনদিন তুমি আমার থেকে বেশি নাম্বার পাবে।

যথাসময়ে তারা মাধ্যমিক পরীক্ষায় দিল। ফল বেরোবার পর সত্যিই অবাক হল সবাই। পরীক্ষার ফলে এবার শেখর সঞ্চারীর থেকে বেশি নাম্বার পেয়েছে। শেখরের মা সঞ্চারীকে বলেই বসলো মা, যে সারা জীবন শেখর এর থেকে বেশি নাম্বার পেল, সে কখনোই মাধ্যমিকে শেখর এর থেকে কম পেতে পারেনা। তুই বরং খাতাটা একটু রিভিউ করা। সঞ্চারী হেসে শেখরের মাকে বলে, কাকিমা আমি যা লিখেছি তাতে শিক্ষক-শিক্ষিকারা কেউই আমাকে নাম্বার দিতে কার্পণ্য করেনি। শেখরের মা জিজ্ঞাসা করে কেন রে মা, তুই এবার এমন খারাপ পরীক্ষা দিলি কেন? সঞ্চারী হেসে বলে খারাপ পরীক্ষা দেয়নি কাকিমা । সেই ছোট্টবেলা থেকে দেখে এসেছি শেখর আমার থেকে কম নাম্বার পায়; আর কেবলি বকা খায়। আমি তাই এবার পরীক্ষায় সব প্রশ্নের উত্তর দেইনি। আমি যা দিয়েছি তাতে আমি ভালই নম্বর পেয়েছি। শেখরের মা, মেয়ে সঞ্চারীকে আদর করে বলে ওঠে এমন ভালোবাসা যেন তোদের সারা জীবন থাকে।

উচ্চ মাধ্যমিক ওরা পড়বে গ্রামের স্কুলেই । সঞ্চারী শেখর উভয়েই ভর্তি হয় কলা বিভাগে। পড়াশুনার সাথে হাতের কাজে বেশ ভালোই পারদর্শী ছিল শেখর। নরম মাটির ঢেলা হাতে পড়লে তা দিয়ে কি তৈরি হয়ে যাবে, অতি অল্প সময়ে তা অপরে বোঝার আগেই তৈরি করে উপহার দিতে একটুও দেরি হতো না শেখরের। সঞ্চারী নরম মাটির তালকে কোন মূর্তিতে বা কোন ফলে বা বস্তুতে পরিণত করতে সক্ষম না হলেও তার তুলির টানে কিংবা পেন্সিলের আঁচড়ে অনেক অজানা অচেনা দৃশ্যই কিংবা বাস্তবের কোন ব্যক্তি জীবন্ত হয়ে উঠতো অনায়াসেই।

উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হয়ে স্থির হল ওরা কলেজে ভর্তি হবে। সঞ্চারীর মনে মনে ইচ্ছে ছিল শেখর কলকাতায় যাক। ওখানে পড়াশোনার সাথে সাথে ওই আর্ট তারও তালিম আরো একটু হোক।

এই গুণ গুলি ছাড়াও এই দুই ছেলে মেয়ের আরো কিছু গুন ছিল। পাশাপাশি দুই গ্রামে কারো কোন শরীর খারাপ, কারো কোন বিপদ তার পাশে গিয়ে কাউকে না পেলেও, পাওয়া যেত সঞ্চারী আর শেখরকে। ওই বয়সেই নার্সিং ট্রেনিং না নিয়েও দুই গ্রামের প্রায় অধিকাংশ লোকই জানতো তাদের একমাত্র নার্স মা ওই সঞ্চারী।

যথাসময়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর শেখর ইতিহাসে অনার্স নিয়ে কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হল । কলেজের পাশেই একজনের বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল সেই সঞ্চারী। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে তার খোঁজ করে সঞ্চারী , তার বাবাকে দিয়ে সমস্ত ফাইনাল করে তবেই সে পাঠিয়েছিল শেখরকে কলকাতায় পড়াশুনা করবার জন্য।

শেখর কে কলকাতায় পাঠালেও তাদের দুজনের স্বপ্ন ছিল তারা একটা সংস্থা তৈরি করবে। সেই সংস্থার মাধ্যমেই গরিব, অসহায়ের মানুষের সেবা হবে। গ্রামের নাম ছিল তমালি । আর সেই নাম থেকেই তারা গড়ে তুলেছিল তমালিকা সেবা নিকেতন। যাবার তারিখ যখন স্থির হয়, শেখর সঞ্চারীকে বলে আজ থেকে তুমি একা। আমাদের সেই স্বপ্ন আমাদের সেবা নিকেতন কেমন করে এগোবে?  সঞ্চারী মিষ্টি হেসে বলে তুমি যত্ন করে পড়াশুনা করে এসো এইতো গুটি কয় বছরের ব্যাপার ; তারপর আমরা একসাথে আমাদের ওই স্বপ্নকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাব। আমি একা বলে তুমি চিন্তা করোনা। আমি ঠিক পারব।

কলকাতায় পড়াশোনার জন্য যাবার পর প্রায় প্রতিদিনই ওই মোবাইল ফোনে খোঁজ নিতে ভুল হয় না সঞ্চারীর। মাঝেমধ্যে অভিযোগের সুর, যে বাড়িতে ছিল সেই বাড়ির কাকিমার কাছে শেখরের খাবার খাওয়ার সম্বন্ধে অভিযোগ শুনে শেখর কে ধমকানো তাতেও কোন ত্রুটি হতো না। শেখরের মা বাবাও জানতো তারা ধমকের সুরে ছেলেকে যতনা শাসন করতে পারবে, তার থেকে সঞ্চারীর ধমক অনেক বেশি কার্যকরী।

পূজোর ছুটিতে শেখর বাড়িতে এলে শুধু সঞ্চারী নয় সকলের কাছে কম বেশি বকা খেতে হল তার স্বাস্থ্য নিয়ে । স্বাস্থ্য নিয়ে বকা খেলেও গুটি কয়েকদিনের ছুটিতে এসেও শেখর সঞ্চারী তাদের স্বপ্নের বাতায়নকে আরো কিছুটা পরিপুষ্ট রূপ দেবার জন্য পরিশ্রমে কোন ত্রুটি রাখলো না শেখর সঞ্চারী। কিন্তু ছুটি তো অনন্ত নয় তাই আবার ফিরে যেতে হল শেখরকে তার পঠন পাঠন স্থলে।

স্বাস্থ্যের দিক থেকে শেখর তেমন ভালো কোনদিনই ছিল না । ইমিউনিটি পাওয়ার তেমন গড়ে তুলতেও সক্ষম নয়। পুজোর সময় যখন শেখর বাড়িতে এসেছিল তখন তার স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তার বক্তব্য প্রকাশ করেছিল যেমন বাড়ির লোক ,যেমন সঞ্চারী, তেমনি গ্রামের অনেকেই। জানুয়ারি মাসের শুরুতেই খবর আসে শেখরের অসুস্থতার। বাড়িতে তেমন কেউ না থাকায় শুধুমাত্র অর্থ যোগে সাহায্য করা ছাড়া উপায়ান্তর থাকেনা শেখরের বাবা-মার। সঞ্চারী একসময়ে অবাধ্য হয়েই ছুটে যেতে চায় কলকাতায়। বাধার সম্মুখীন হয় । একদিকে শেখর সঞ্চারীর স্বপ্ন তমালিকা সেবা নিকেতন গড়ে তোলার কাজ আর অন্যদিকে তার সাথী তার প্রিয়তমার এমন শরীর খারাপের কথায় নিজেকে স্থির রাখতে পারেনা সঞ্চারী। গ্রামে পরিচিত এক পরিবারের সাথে কথা বলে একটা ঘরেরও ব্যবস্থা করেছে সঞ্চারী। তাতেই ব্যানার টানিয়েছে তমালিকা সেবা নিকেতনের। সেখান থেকেই প্রাথমিকভাবে গ্রামের বিভিন্ন সেবার কাজ পরিচালিত হয়। স্থির হয়েছে এখানেই আগামীতে কোন শুভদিনে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হবে শেখরের উপস্থিতিতে এই সেবা নিকেতনের।

এক রকম সকলের অবাধ্য হয়েই চার দিনের মাথায় ভোরে সঞ্চারী রওনা দেয় কলকাতার উদ্দেশ্যে। ইতিপূর্বেই শেখর যে বাড়িতে পেয়িং গেস্ট ছিল , সে বাড়ির লোক শেখরকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিল। সঞ্চারী তাদের বাড়িতে গিয়ে ওঠে প্রথম। যথাসময়ে হাসপাতালে বেডের পাশে গিয়ে সঞ্চারী দাঁড়াতে শেখর যেন তার নতুন উদ্যম খুঁজে পায় সঞ্চারীকে দেখে। গ্রামের স্কুল জীবন থেকে শুরু করে শেখর কিংবা তার পরিবার কিংবা গ্রামের ভিন্ন জনের অভিভাবক রূপে যেমন কাজ করে আসছে সঞ্চারী;  আজ শেখরের অসুস্থতার খবর পেয়ে হাসপাতালে এসেও তার ব্যতিক্রম দেখা গেল না। ডাক্তারবাবু তাকে দেখে সমস্ত রিপোর্ট তার হাতে তুলে দিলেন। তবে বললেন শেখরকে ওর পরিবারের সঙ্গ দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। সাথে এ কথা বললেন দেখুন কেউই আমরা অনন্ত জীবন নিয়ে আসিনি তবে তার মধ্যেও কেউ আগে কেউবা পরে যায় এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে। ডাক্তার বাবুর এই কথা তাৎক্ষণিক মেনে নিলেও সঞ্চারীর মাথা থেকে কথাটা সরে না। টানা ১০-১২ দিন অক্লান্ত পরিশ্রমে শেখরকে সুস্থ করে বাড়িতে নিয়ে আসার প্রস্তুতি যখন তৈরি। ঠিক রওনা দেবার আগের দিন শেখর সঞ্চারী কে বলে, আগামী ৬ই জানুয়ারি তোর জন্মদিন মনটা খুব ব্যাকুল ছিল যে এবারের জন্মদিনে তোর সাথে সাক্ষাৎ হবে কিনা?  ভগবান তার ব্যবস্থা করে দিল। তোকে এবার জন্মদিনে আমার একটা বিশেষ উপহার দেব। যত্ন করে রাখবি সারা জীবন। যেদিন আমি থাকবো না সেদিন ওই উপহারই তোকে সঙ্গ দেবে। সঞ্চারীও ভাবে সত্যিই 6 জানুয়ারি হয়তো দুজনকেই দুই প্রান্তে শুধুই মোবাইলে ভিডিও কলে একে অপরকে দেখে সন্তুষ্ট থাকতে হতো। কিন্তু শেখরের অসুস্থতার কারণে একরকম বাধ্য করিয়েছিল সঞ্চারীকে তার সাথে মেলাতে। পরের দিন সকালে শেখর কে কলেজের বিশেষ ছুটিতে সঞ্চারী তাদের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে এলো। সেদিনই ছিল 6 জানুয়ারি সঞ্চারীর জন্মদিন। ভোরবেলা সঞ্চারীর আগে শেখর ঘুম থেকে উঠে তার এতদিনের পরিশ্রমের শিল্প সঞ্চারীর আবক্ষ মূর্তিতে তুলির শেষ আচর মারতে থাকে। সঞ্চারী ঘুম থেকে উঠে শেখরের ঘরে গিয়ে বিছানায় শেখরকে না দেখে হঠাৎই চমকে ওঠে। ঘুরতেই দেখে শেখর তারই হাতের তৈরি মূর্তিতে, তুলিতে রঙের ছোঁয়ায় ব্যস্ত। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সে। হঠাৎই তার মনে পড়ে যায় শেখরের সেই কথা। তবে কি শেখর তাকে এই উপহার দেবে! তাদের হারানো ছোটবেলাকার অনেক স্মৃতি তাকে নতুন করে ভাবিয়ে তোলে। অসুস্থ শেখরকে অভিভাবকের সুরে ধমক দেবে ভেবেও কাছে গিয়ে শেখরকে জড়িয়ে ধরে খুব সাবধানে। শেখরও বলে ওঠে, যা তুই চলে এলি। ভেবেছিলাম পুরো কাজটা সম্পূর্ণ করেই তোকে সারপ্রাইজ দেব । তবে হ্যাঁ , তুই তো জানতিস না তাই সারপ্রাইজ টা এখনো রইলো। বেশ কিছুক্ষণ পরেই তাদের রওনা দিতে হবে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে। তাদের খাবারের ব্যবস্থা করছে শেখরের কলকাতার অস্থায়ী অভিভাবক অর্থাৎ যার বাড়িতে শেখর পেয়িং গেস্ট আছে , সেই বাড়ির অভিভাবিকা। তিনিও জানতেন না শেখরের এই মূর্তি তৈরীর ইতিহাস। শুধু জানতেন একটি মূর্তি তৈরি হচ্ছে; শেখর গ্রামে তা নিয়ে যাবে এবং উপহার হিসেবে তা দেবে, এই অবধি। তাদের খাবার প্রস্তুত হয়েছে এবার তা দিতেই শেখরের ঘরে এসেছিলেন তিনি ,অরুন্ধুতী ম্যাডাম। তুলির টানে যে আবক্ষ মূর্তি জীবন্ত হয়ে উঠেছে তারই পাশে দাঁড়িয়ে আছে চিন্ময়ী রুপি সে নিজেই। শেখরের হাতের কাজ কতটা নৈপুণতা প্রকাশ করে আজ নিজের চোখে অরুন্ধতী দেখে অভিভূত হয়ে পড়ে। নিজেই ছুটে গিয়ে শেখরকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমার ছেলে নেই মেয়ে শ্বশুর বাড়ি চলে গেছে। কিন্তু সাময়িক অতিথী হিসেবে যাকে দেখেছি আমার বাড়িতে সে সাক্ষাত ঈশ্বরই বটে। অরুন্ধুতী কাকিমার উপস্থিতিতেই শেখর সঞ্চারীর আবক্ষ মূর্তি সঞ্চারীর হাতে তুলে দেয়। কাকিমা তাদের খাবার প্রস্তুত করে সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে তাদেরকে নিয়ে রওনা দিল হাওড়া স্টেশনের উদ্দেশ্যে তারা গ্রামের বাড়িতে যাবে বলে।

ফিরেও আসে গ্রামে সঞ্চারী ও শেখর। ট্রেনে আসতে আসতে সঞ্চারী শেখরকে তার হাতে তৈরি নিজের মূর্তির প্রশংসা করতে থাকে সঞ্চারী। শেখর বারবার সঞ্চারীকে বলে যেদিন আমি থাকবো না সেদিন আমার এই মূর্তি তোর বাঁচার রসদ জোগাবে। সঞ্চারী বলে তুমি এমন কেন বলো বারবার? কি হয়েছে তোমার?  আমিও বাড়ি ফিরে তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেব।

সারা রাস্তা পরিশ্রমের পর স্বভাবতই ক্লান্ত দেহে দিনের শেষ কাটলো। দিন কয়েক ভালো কাটার পর হঠাৎই আবার আক্রমণ হয় এক অজানা জ্বরে। স্থানীয় ডাক্তার, কিংবা কিছুটা দূরে থাকা হাসপাতালের চিকিৎসকের দৌলতেও সেই জ্বর থেকে মুক্তি পায় না শেখর। ডাক্তারের পরিভাষায় চিকুনগুনিয়া। ইতিপূর্বেই একবার বেশ শরীর খারাপ থেকে ওঠায় শরীর তেমন দখল সইতে পারল না। দিনকয়েকের লড়াইয়ে অবসন্ন হয়ে বাড়ি ফিরে সাত দিনের মাথায় হঠাৎই চলে গেল শেখর। যে ভালবাসার বন্ধন এত বছর ধরে তিল তিল করে তৈরি করে উঠেছিল দুটি ভালোবাসার প্রাণ, দুটি পরিবার আজ নিঃস্ব হয়ে গেল তারা।

সঞ্চারী আজ নিঃস্ব অভিভাবকে পরিণত হলো। যে সঞ্চারীর প্রাণবন্ত হাসি, উদ্ভাবনী মন , প্রাণ উচ্ছল  উদ্দম, সবই হারিয়ে ফেলল সে। দুই পরিবার যথাযত নিয়ম নিষ্ঠা মেনে শ্রাদ্ধ কাজ সম্পূর্ণ করল তারা। গ্রামে ফিরে আসার পর নিজের হাতে সঞ্চারী উপহার দিয়েছিল শেখরকে তারই হাতে ক্যানভাসে আঁকা শেখরের ছবি। সেদিন তারা দুজন তাদের দুটি আত্মার এক অজানা মিলন ঘটিয়েছিল তাদের ভাবাবেগে। কিন্তু তারা কোনদিন কেউ কাউকে এই কয়েক মাসে বলেনি তারা তাদের অবয়ব এভাবে তুলি কিংবা মাটিতে স্থান দিয়েছে একে অপরে। শেখরের মা বাবা তার ছেলের কাজে তাই তাদেরই হৃদয়ের মেয়ে সঞ্চারীর হাতে আঁকা সেই ছবিতেই তাদের শ্রাদ্ধ কাজ সম্পন্ন করেছিল।

এতদিন ধরে সঞ্চারী যে কাজ তিল তিল করে একটু একটু করে এগিয়ে রাখবার চেষ্টা করেছিল তাদের স্বপ্নের তমালিকা সেবা নিকেতন। আগামী ১২ই জানুয়ারি যার উদ্বোধনের দিন ধার্য হয়েছিল হঠাৎই সঞ্চারী কাগজ-কলমে ব্যস্ত হয়ে ওঠে পরিচিত বিশিষ্ট উকিল কাকুর সাথে পরামর্শ করে সেবা নিকেতনের নাম পরিবর্তন করে তার নাম দেয় শেখর সেবা নিকেতন।

শুভ অক্ষয় তৃতীয়ার, শুভ লগ্নে স্থানীয় রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজের উপস্থিতিতে শেখরের অনুপস্থিতিতেই সঞ্চারী উদ্বোধন করে শেখর সেবা নিকেতনের। যে সেবা নিকেতনের জন্ম হয়েছিল তমালিকা সেবা নিকেতন । যেখানে স্থান পেয়েছিল অসহায় কিছু ছেলে মেয়ে, স্থান পেয়েছিল গুটিকয় বৃদ্ধ বাবা মা, সেই তমালিকা সেবা নিকেতন আজ বলিষ্ঠভাবে গ্রামের সদরে নবরূপে প্রকাশ পেল স্থানীয় রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজের শুভ উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে। আজ সেই শেখর সেবা নিকেতনে 50 শয্যার একটি স্থানীয় হাসপাতাল যার উদ্বোধনে আসছেন রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজ স্বামী দিব্বানন্দজি। আজ নির্মল সজ্জায় ভূষিত হয়েছে সঞ্চারী। স্থানীয় সারদা-মা রূপেই আজ সকলের কাছে চিরবন্দিত সঞ্চারী ঘোষ।

সকলের অলক্ষে সঞ্চারী ছুটে যায় হাসপাতালের উদ্বোধনী ঘরে যেখানে তারই হাতে আঁকা শেখরের আবক্ষ অবয়ব। পারেনা ধরে রাখতে সঞ্চারী, এত দিনের জমে থাকা কষ্ট। আপন মনে বলে ওঠে আমার এতদিনের লড়াই তুমি শূন্য করে চলে গেলে। আমি জানি এতে তোমার কোন দোষ, তোমার কোন অপরাধ নেই। জান শেখর তুমি চলে যাবার পর তেমন করে শাসন আমি আর কোনদিন কাউকে করি না। শেখর তুমি জানো আমার প্রতিদিন এই হাসপাতালের প্রথম সকালটা শুরু হয় তোমাকে প্রণাম করেই। তুমি যখন আমার সাথে আর্ত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে; ছোট্ট ব্যান্ডেজের পরেও তার পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে যখন বলতে বারবার; ভয় নেই তোমাদের মা আছে ওই যে সঞ্চারী। সেদিন আমার বুকটা ভরে যেত আনন্দে । তেমনভাবে বলার আর কেউ রইল না আমার। আজ বহু বছর পর পেছন থেকে শেখরের মা জড়িয়ে ধরল সঞ্চারীকে। বলল জানিরে তোর এই কষ্টের নিবারণ আমি শেখরের মা হয়েও পারবোনা কোনদিন। আজ অন্তত এই শুভ দিনে তুই আরো একটু কেঁদে নে মা। আমি জানি তাতে আর কিছু না হোক তোর কিছুটা লাখোব হবে কষ্টের। বাইরে হঠাৎই এক বৃদ্ধ ছুটে এসে সঞ্চারির সামনে সস্ট্রাঙ্গে শুয়ে পরে। হঠাৎই সে চিৎকার করে বলতে থাকে তুমি সাক্ষাৎ ভগবান মাগো ।  আজ সাত দিন পরে আমার সন্তান মা বলে ডেকে উঠেছে গো। ডাক্তার ওষুধ দিলেও ডাক্তার নিজেও বারবার বলেছে যে দুর্ঘটনা তার ছেলের উপর দিয়ে গেছে তাতে দিনরাত সঞ্চারী মায়ের সেবা ছাড়া তোমার ছেলে তার জীবন ফিরে পেতো না। সঞ্চারী সকলের অলক্ষে আবার ছুটে যায় শেখরের ছবির সামনে । চিৎকার করে  বলে শেখর , আমাদের একটি স্বপ্নপূরণ হয়নি সেটা তুমি বা আমি, আমরা উভয়ে জানি তোমার সন্তানের মা শব্দটা আমি আর কোনদিন পাব না জানি। তবু তোমার অনুপ্রেরণায় আমি যে মন্দির যে সেবা নিকেতন আগলে রেখে চলেছি সেখানে ওই অসহায় মানুষগুলোর সকলের মা হতে পেরেছি আমি। পেছন থেকে শেখরের মা আবার জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে মারে! আমিও তো সন্তানহারা মা , আর আমার একমাত্র অভিভাবক তুই যে। মা আমাকে  তুইই বাঁচিয়ে রেখেছিস আজও, সেবার মধ্য দিয়েই। বাইরে আবার ডাক আসে । ওরা সবাই সঞ্চারী মায়ের সেবা পেতে চায়। সঞ্চারী আঁচল দিয়ে চোখের কোন পুছেঁ বাইরে অনেক প্রতীক্ষা মান সেবা প্রাপক সকলের সামনে গিয়ে হাত জোড় করে বলে, আমি সামান্য মানুষ। আপনারা সবাই ধৈর্য ধরুন আমি সবার কাছে যাব। শুধু আজ নয় আমার জীবনের শেষ ক্ষণ পর্যন্ত আমি আপনাদের পাশে ছিলাম যেমন , তেমন ভাবেই থাকবো। কারণ এই সেবা, এই শেখর সেবা নিকেতন আমার বেঁচে থাকার স্বামী।

 

Loading