অ্যাটেম টু মার্ডার
– স্বপ্না মজুমদার
পুনে, মহারাষ্ট্র
আদালত কক্ষ
জজ সাহেব বসে আছেন। বিচার হবে এখন। শ্রীমতি সুধা রানীকে আ্যটম টু মার্ডারের অভিযোগে স্বামী চারুচরণ হাজরাকে আদালত গৃহে আনা হয়েছে।
ডাক এলো—- আসামি হাজির।
চারুচরণ দূরে দাঁড়িয়ে হাতের নখ দাঁতে কাটছে।
আবার ডাক —-আসামি হাজির।
চারুচরণের হেলদোল নেই।
কিছুক্ষন পরে হুস ফিরল।বলে— আমারে ডাকতিছেন?
উকিল—— সে তো কখন থেকেই ডাকছি। শুনতে পাওনা না কি? কানে কি খাটো?
চারুচরণ —- আজ্ঞে , আমার নাম তো আসামি লয় গো।
উকিল—— এখন তোমাকে এখানে মহামান্য আদালতের সামনে অভিযোগ ভিত্তিক আনা হয়েছে।
চারুচরণ —- তাতে কি? তাই বলে আমার বাপ মায়ের দেওয়া নাম বদলে দেবেন?
উকিল—– নাম কোথায় বদলালাম? শুধু আসামি বললাম।
চারু—— ওইটাই তো বলছি। আমি চারুচরণ হাজরা। নাম বদলাবার চেষ্টাও করবেন না। তাহলে একদম। ঘুষি পাকিয়ে দেখায়,বলে— একটা আ্যটম টু মার্ডার,কেস্ আছে,,না হয় দুটো হবে। কিন্তু নাম বদলাতে দেবো না।
আমার বাপ মায়ের দেওয়া নাম। এই নামেই তো একদিন ভালোবেসেছিল আমাকে,সুধারানী। আজ সব ভুলে গেছে। একেবারে নেমখারাম।
উকিল—–এখানে বেশি কথা একদম নয়,বুঝলে।যা জিজ্ঞাসা করা হবে সেটুকুর উত্তর দেবে।
চারু —- আজ্ঞে। আমি মিছে কথা বলি না। আমার মা মিছে কথা বলা পছন্দ করে না।
উকিল—- আবার কথা বলে।
নাও,,এখন গীতায় হাত রেখে বলো,,যাহা বলিব সত্য বলিব।সত্য বই মিথ্যা বলিব না।
চারু—– ও আবার কি জিনিষ? লাল কাপড়ে মোড়ানো। না না,ওসব ছুঁতি পারব নি। আমার মা,পরের জিনিষ ধরতে বারণ করেছে।
উকিল এবার ধমক দিয়ে বলে— যা বলছি বলো। এটা ধর্ম গ্ৰন্থ। মানে বই।
চারু—- ও আমি পড়তে পারবনি। লেখাপড়া শিখিনি। পয়সা ছেল না।
উকিল এবার মাথায় হাত দিয়ে রেগে বলে—- এটা কে রে। কোথা থেকে এলো।
চারু—– আমি কোথায় এলাম। ঘরেই তো বসে টিভিতে সিরিয়াল দেখছিলাম।আর হবিষ্যির ফল খাচ্ছিলাম। পুলিশ গিয়ে টানতে টানতে আমাকে নিয়ে এলো। আমি তো আসতেই চাইনি। আমার কি দোষ।
উকিল —- এই তুই এবার একটা সোজা কথা বল্
তো,,,তোর বৌকে গলা টিপে মারতে গেলি কেন?
চারু—- অ,,এই ব্যাপারে কথা কেন শুধোচ্ছেন হুজুর। আমি তো আমার বৌকে মারতে চেয়েছিলুম। আপনার বৌকে তো মারতে চাইনি। সুধা আমার বে করা একমাত্র বৌ।অরে আমি খুব ভালোবাসি।
উকিল হতচকিত হয়ে বলে—- এখানে আমার বৌয়ের কথা তোমাকে কে বলতে বলেছে।
চারু —- বা বা বা, আমার বৌয়ের কথা আপনারা বলছেন।তাতে দোষ হয় না। আমি একটু বোঝাবার জন্য আপনার বৌয়ের কথা বলতেই, আপনার গায়ে একবারে ফস্ করে ফোস্কা পড়ে গেল।
উকিল —যাক গে যাক। এখন বল্, এতোই যখন সুধারানীকে ভালোবাসিস ,,তাকে মারতে গেলি কেন?
চারু—- বেশ করেছি। আপনার কি? আমার বে করা বৌ,আমি মারতে চেয়েছি। তাও তো বৌ মরলো না। দিব্যি বেঁচে থেকে আমার পিছনে পুলিশ লেলিয়ে দিল। ঐ টেঁপিকে বে করলেই ভালো হতো। এখন বুঝতে পারছি।
উকিল —- তাহলে বোঝা যাচ্ছে ,,টেঁপিকে বিয়ে করার জন্যই তুমি তোমার স্ত্রী সুধারানীকে হত্যা করতে চেয়েছিলে। এটা তুমি মহামান্য আদালতে দাঁড়িয়ে স্বীকার করলে।তাইতো?
চারু—– এটা আমি কখন বললাম? দেখেন উকিল মশাই, আমার মা আমাকে মিছে কথা বলতে শেখায় নাই।
উকিল —– তাহলে আর কি কারণ আছে,,সেটা বলো।
চোখ গোল গোল গোল করে বললে চারুচরণ— কি বলেন আপনি? জানেন না বৌ মরলে বৌ আসে। মা মরলে আর মা আসে না।
উকিল——- হ্যাঁ ,এমন প্রবাদ বাক্য শুনেছি। তাতে এই কেসের সম্পর্ক কি?
চারুচরণ অবাক হয়ে বলে—- কি যে বলেন। তাহলে ভালো করে শুনুন।মা,,, আমার একমাত্র মা। কতো কষ্ট করে আমাকে বড় করেছে, জানেন?আমার বিয়েতে আপত্তি করেনি। আমার মায়ের কতো পছন্দ ছিল, মায়ের বন্ধুর মেয়ে ওই টেঁপিকে আমার সাথে বে দেয়। জানেন, ধর্মাবতার,, আমার মা আমার ভালোবাসা দেখে,টেঁপিকে মন থেকে সরিয়ে,ওই সুধাকে মেনে নিয়ে সম্পূর্ণ হাসি মুখে আমার আর সুধার বে দিয়েছে।
উকিল—– বেশ। বুঝলাম। তাতে এমন কি হয়েছে। আজকাল ঘরে ঘরে বাবা মায়েরা সব মেনে নিয়ে ছেলে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছে।
আগে বলো, তুমি সুধারানীকে মারতে গেলে কেন?
চারুচরণ—– ওরে বাবা রে। কিছুই বোঝেন না। আর এইখানে দাঁইড়ে আছেন। আপনারা না কি বেচার করবেন। হরি হরি।
শোনেন, হুজুর একটু ভালো করে শোনেন। মা,, মানে,ওই আমার একমাত্র মা। খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল। অনেক ডাক্তার বদ্যি দেখালাম। সুস্থ আর হতে পারলে না। সেদিন বদ্যি কাকা আমারে বললে— চারু,, পারলি নে রে,আর মা কে ধরে রাখতি। তোর মায়ের অবস্থা বিশেষ ভালো না। শুনে আমি কাঁদতে শুরু করলুম। বুঝলেন কিনা, আমার ওই একমাত্র মা। সুধা আমার পাশেই ছেল। একটুও কাঁদলে না। এমন পাষানী বৌ।আমারে জড়ায়ে ধরে বলে কি না,মন খারাপ করোনি। মা কি কারো চেরকাল থাকে। আমি তো তোমার কাছেই আছি।
সেই শুনে,আমি আরো হাউমাউ করে কাঁদতি লাগলাম।
হুজুর আপনি বলেন,বৌ যতোই কাছে থাকুক,অরে কি আমি মা বলতে পারি?
অর সঙ্গে আমার ওই,মানে ওই সম্পর্ক। সে কি আর সুধা বুঝে কথা বলে। আমি বললাম — সুধা তুমি তো আমারে প্যাটে ধরো নাই। ক্যামনে আমার মা হবা। অবশ্য প্যাটে ও বেশি বেশি খাবার,ফুচকা,আলুকাবলি, সন্ধ্যা হলেই আলুর চপ, সিঙাড়া জিলিপি,,,এসব ছাড়া কিছুই ধরতে পারে না। দ্যাখছেন না এখনো একটা বাচ্চা হলো না। আমার মায়ের এই নিয়ে কতো দুঃখ। বলে—- বাপ,তোর ভালোবাসা দেখে বিয়া দিলাম। নাতির মুখ দেখতে পেলাম না এখনো। ওই টেঁপিরে বৌ করে আনলে এক বছরে দুই পা বাচ্ছা বিয়াতো। জানেন,এই কথা শুনে শুনে কাণ আমার ঝালাপালা হইয়া গেছে। তবুও আমি সুধাকেই ভালোবেসেছি। তবে একটা সত্যি কথা বলি আপনাকে,,, মিথ্যা বলব না।
উকিল—– এটা আদালত কক্ষ। এখানে সত্য ছাড়া মিথ্যা বলা যায় না।তাহলে শাস্তি কঠিন থেকে কঠিন হয়।
চারুচরণ —- জানি গো জানি।উকিল মশাই। এতো বেশি কথা কন্ কেনো?
উকিল—– ঠিক আছে। ঠিক আছে।এবার সব বলো। সুধা রানীকে মারতে গেল কেন?
চারুচরণ —- এইটাই তো বলতে চাই। বলেন আমারে দেখে কি আপনার খুনী বলে মনে হয়? সত্যি করে বলবেন।
উকিল—— দেখে তো মনে হয়,ভাজা মাছটি উল্টেও খেতে জানো না। যত্তোসব।
চারুচরণ —- না না,উকিল মশাই। ওটা আমি পারি। ছোটো বেলায় মা গরম তেলে কড়কড়া করে মাছ ভেজে দিতো। আহা,,কি স্বাদ। এখনো মুখে লেগে আছে। আমি গরম ভাতের সাথে উল্টে পাল্টে কাঁটা বেছে খেতাম। এখন বৌ মাছ ভাজে। আমারে বড়টাই দেয়। বড় ভালোবাসে কি না। সুধা এমনিতে বড় ভালো মেয়ে।
—– এসব কথা কে জিজ্ঞাসা করেছে?
মুখ বিকৃত করে বলেন—- এতো বড় মাছ খেয়েও তো সেই বৌকেই মারতে গেলে। সে কি টেঁপির জন্য?
চারুচরণ হে হে হে হে,, একটু হেসে বলে— এটা মহামান্য আদালত। হুজুর বয়ে রইছেন। মিছে কথা বলব না। একটু মাথা চুলকে,নেড়ে বলে,,, সত্যি কথা বলতে,টেঁপি রে আমি আগে দেখিনি। মা ,কতো করে বলেছিল।
এই সেদিন অরে দেখলুম। হেব্বি দেখতে জানেন। খুব মনে ধরে গেল।
উকিল —– মনে ধরে গেল বলেই সুধাকে গলা টিপে হত্যা করতে চাইলে। বুঝেছি এইবার।
চারু—- না,,একদম এটা সত্যি নয়। আমি মিছে কথা বলি না।
উকিল —– তুমি কিন্ত আদালতের সময় নষ্ট করছো। সোজা কথা বলো।একটাই প্রশ্ন,,, সুধা রানীকে হত্যা করতে চেয়েছিলে কেন?
চারু—— বলছি।শোনেন তাহলে। আমার মা তো মর মর। শেষ নিঃশ্বাস পড়বে পড়বে করছে। বদ্যি কাকা চলে গেলেন। সারা রাত মায়ের পাশে বসে রইলাম সুধাও আমার পাশেই ছেল। দুজনেরই চোখটা একটু ঘুমে বুজে আসছিল। এমন সময় স্বপ্নে দেখলাম যমরাজের দূত এলেন।
আমাকে বললেন,,, সরে যা চারু, তোর মায়ের যাবার সময় হয়েছে। আমি নিতে এসেছি।
আমি এই কথা শুনে তৎক্ষণাৎ বললাম — এমন করোনি গো যমরাজের দূত। আমি আমার মাকে খুব ভালোবাসি। মাকে নিয়ে যেওনি। চারিদিকে দেখো আজকের ছেলেরা বৌ আসলে আর মাকে ভালোবাসে না সন্মান করে না।
আমি আমার মাকে খুব ভালোবাসি। মাকে নিয়ে যেও না।
তখন দেখলাম যমরাজের চোখে জল।
যমরাজের দূত আমাকে বললে—- তোমার মায়ের প্রতি এতো ভালোবাসা দেখে আমার মায়ের কথা মনে পড়ছে।
যাইহোক,,আমি তো যমরাজের চাকরি করি। আমাকে একটা মৃতদেহের আত্মা নিয়ে যেতে হবে। এখন তাহলে আমাকে একটা মৃত আত্মা দাও।
আমি তখন ভাবলাম,, বৌ মরলে বৌ আসবে। মা মরলে তো মা আর আসবে না। মাকে বাঁচানোর একটাই উপায়।
সুধাকে মেরে ফেলে ওর আত্মা দিয়ে দেওয়া।
সেই ভেবে ঘুমন্ত সুধাকে আমি নিজে হাতে গলা টিপে মারতে চেষ্টা করি। কিন্তু খুব শক্ত গলা,, পারলাম না।
উল্টে এতো চেঁচামেচি করলো,যে কি বলবো হুজুর।
ওকে বোঝালাম।তাও বুঝলো না। এদিকে আমার মাও মারা গেল। ঐ দূত একগাল হেসে আমার চোখের সামনে দিয়ে আমার একমাত্র মা কে নিয়ে চলে গেল।
সুধা পুলিশ ডাকবে বললে। আমি বললাম — মায়ের শেষ কাজটা করতে দাও। ও শুনলে না।
আ্যটম টু মার্ডার কেস করলে।।
সমাপ্ত
……………………………………………………………………………………………………
28 total views , 1 views today