আঞ্জুম
সিরাজুল_ইসলাম
(কবি ও গল্পকার) বাংলাদেশ।
পাহাড়ের হাতছানিতে আমি পাগল। পাহাড় ডাকে আমায়। তাই ছুটে চলে যাই পাহাড়ের কাছে।
সাগর আমার বড্ড অপছন্দের। সাগরের লোনাজলে মিশে আছে আমার দুচোখের তপ্ত লোনাজল। সত্যি বলতে কি ওই রাক্ষুসে সমুদ্রের লোনাজল একদিন কেড়ে নিয়েছে আমার আদরের ভাইটাকে। সেই থেকে আমি ঘৃনা করি সাগরকে।
পাহাড়ের গা ঘেঁসে ছোট একটা গ্রাম গাবরা। গাড়োদের বসবাস। এখানে থেকে দূরের কালচে-সবুজ অনিন্দ্য সুন্দর গাড়ো-পাহাড়টাকে দেখি আমি অনিমেষ দুনয়নে। তাই মন উতলা হলে ছুটে আসি।
এলোমেলো জীবনে ছুটে চলার গতিতে বেঁচে অক্সিজেন নিতে।
ময়মনসিংহ রেলওয়ে জংশন থেকে নেত্রকোণা হয়ে বিরিসিরি যাবো। বিরিসিরির গাড়ো-পাহাড়ের আদিবাসী গাড়োদের গ্রাম গোবরা। আপাতত কদিন থাকবো।
নির্দ্ধারিত সময় থেকে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে ডাউন লোকাল ট্রেনের ট্রেনের। এখানে ক্রসিং হবে আপ মেন লাইনেের যমুনা এক্সপ্রেস।
আন্তঃনগর এক্সপ্রেসের চেয়ে আমার পছন্দ ঢিমেতালে দীর্ঘ বরষ মাস রজনী ধরে ধুকপুক করে চলা লোকাল ট্রেন।
লোকাল ট্রেনে চলার মজাটাই আলাদা। কত রকম স্টেশনে দাঁড়ায়। কত নিম্নবর্গের মানুষের যাওয়া আসা। কতরকম খিস্তিখেউড় শোনা যায়। শুধু টিকেট কেটে সুবিধাজনক জানালার পাশে একটা সীট হলেই ব্যাস। জম্পেশ যাত্রা।
বলে রাখা ভালো, আমার বেকার জীবন। ভবঘুরে মানুষ আমি। ভোজনাং যত্রতত্র শয়নাং হট্টমন্দির গোছের একটা জীবন আমার। পেট ভরানোর জন্য কোন নির্জনস্থানে গিয়ে ছবি আঁকি। সেগুলো বিক্রি করে চলে যায় কিছুদিন। ফুরিয়ে গেলে নতুন করে আঁকি। তাই নো চিন্তা।
স্টেশনে টিস্টল থেকে চা-বিস্কুট খাওয়ায় পর একটা সিগারেটে আগুন লাগিয়ে বুনকা-ধোঁয়া ছেড়ে দূরে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিতেই প্লাটফরমের ওদিকটায় দুচোখ আটকে গেলো।
কেউ একজন অনিন্দ্য সুন্দর ডাগরকালো হরিণচোখ মেলে আমার দিকে দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে। না কি আমার ভুল! অন্য কারো দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি!
দেখলেই বোঝার অসুবিধে হয় না, তিনি সত্যি অনিন্দ্যসুন্দর। দামী জড়োয়া গহনায় সুসজ্জিতা। বেশভূষায় কৌলিন্যের ছাপ।সুড়ৌল হাতের কব্জিতে সোনার কঙ্কন সুশোভিত হচ্ছে। ঠিক যতোটা না হলেই নয়, ঠিক ততোটাই মানানসই। একেবারে েকে অন্যের পরিপূরক। কে কার অলঙ্কার!
ধ্বক করে উঠলো বুকের ভেতর। “আঞ্জুম!”
এতদিন পরে হঠাৎ এভাবে দেখা হবে ভাবতে পারিনি। আর ভেবেই বা কি লাভ?
আমি গ্রাম থেকে উঠে এসেছি চারুকলায় পড়াশোনা করতে। ফাইনআর্টস এ। ময়মনসিংহ চারুকলায় ভর্তি হয়েছি। আর আঞ্জুম ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ্যাগ্রো-টেকনোলজিতে।
শহরের শিল্পকলা একাডেমির আর্টগ্যালারীতে আমার ছবির প্রদর্শণী চলছে সে সময়। বান্ধবীদের সঙ্গে নিয়ে একদিন সে গ্যালারীতে এলো আঞ্জুম।
আমার একটা ছবি দেখে সে ভীষণ মুগ্ধ। কিনে নেবার প্রচন্ড আগ্রহ প্রকাশ করলো। কিন্ত অতগুলো টাকা না থাকায় নিরাশ হলো।
বললাম, ওটা আপনার জন্য রেখে দিচ্ছি! দয়া করে ঠিকানা রেখে যান। পরে এসে নিয়ে যাবেন।
আঞ্জুমের সামনেই ছবিটাতে স্টিকার লাগিয়ে রাখলাম, “NOT FOR SELL! “
আমার প্রদর্শণীর সময় পার হয়েছে। সবগুলো ছবি বিক্রিও হয়েছে গেছে শুধু ওই “নৈসর্গিক!” ছবিটি বাদে। ছবিটা এতোটাই চমৎকার সুন্দর অনেক গুনমুগ্ধ ক্রেতা অ নে ক মূল্য দিয়ে নিতে চেয়েছেন। তবু বিক্রি করা হয়নি। কারণ ওটা আঞ্জুম চয়েস করে রেখে গেছে।
ফাগুনের এক অলস বিকেলে “নৈসর্গিক!” কে রেপিং পেপারে মুড়িয়ে নিয়ে চললাম আঞ্জুম এর রেখে যাওয়া ঠিকানা ধরে।
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোলোভা দৃষ্টিনন্দন ক্যাম্পাসে একজন সুস্থ মানুষকে ভাবুক দার্শনিক বানিয়ে দেবে নিঃসন্দেহে।
আঞ্জুমকে খুঁজে ফিরে না পেয়ে ফিরে আসছি। দেখি ক্যাম্পাসের ফুলেফুলে সাজানো রাস্তাটা ধরে শ্লথ গতিতে এলোচুলে একাকি ফিরে আসছে তার রুমের দিকে।
অপসৃয়মান গোধুলির আলোয় অপরুপ এক ছবির স্কেচ এঁকে নিলাম মনের জানালায়।
কাছাকাছি চলে এসেছি। বললাম, আপনার ছবিটা নিয়ে এসেছি।
লজ্জায় তার ফর্সা মুখটা আরও লাল হয়ে উঠলো তাৎক্ষণিকভাবে। অস্ফুটস্বরে জানালো, “সত্যি আমি লজ্জিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী। আসলে আমরা গরীব। সামর্থ নেই অত টাকা দিয়ে মূল্যবান পেইন্টিং কেনার। লজ্জায় তাই আর এক্সজিবিশনে যাওয়া হয়নি আর।ক্ষমা করবেন।”
কথাগুলো শুনে বুকের ভেতর ধ্বস নামলো। বিনাবাক্য ব্যয়ে “নৈসর্গিক!” কে আঞ্জুমের হাতে তুলে দিয়ে বললাম,
=এটা আপনার জন্য রেখেছিলাম, আপনারই পাওনা এটা।
= না না! এতো দামী পেইন্টিং কেন দেবেন? আমি তো দাম দিতে পারবো না। নিজেকে কায়ক্লেশের মধ্যে থেকে পড়াশোনা করতে হয়।গরীবের জন্য পেইন্টিং মানায় না। যাদের একবেলা খাবার জোগাড়ের হিমসিম খেতে হচ্ছে।
= মনে করুন এটা আমার কাছ থেকে আপনার জন্য উপহার!
অযথা অকারণ কথা বলতে বলতে সময় ফুরিয়ে এলো। পরে দেখা হবে প্রতিশ্রুতিতে যে যার গন্তব্য পথে পা বাড়ালাম।
এরপর সময়গুলো দুরন্তপনায় কেটে গেছে। আমার পেইন্টিং বিক্রির টাকা খরচ চলে যায় আঞ্জুমের হাতে। মোটামুটি আনন্দময় জীবনের গতিতে পড়াশোনা করতে লাগলো। সময়ে অসময়ে দুজনে চলে যাই পাহাড়ের কাছে। আদিবাসীদের গাঁয়ে। মাটির গন্ধ বুকে মেখে ফিরে আসি দু’জন।
আঞ্জুমের বিসিএস পরীক্ষা। তাই আগের মতন করে দেখা করা হয়ে ওঠে না আর। মেধাবী ছাত্রী। এই মূহুর্তে ডিস্টার্ব করার কোন মানেই হয় না। তাই বুকের কষ্ট বুকে রেখেই দূরে সরে থাকি।
আঞ্জুমের বিসিএস পরীক্ষা শেষ হলো কয়েক দফায়। দেখা করতে গেলে পাগলের মতন বুকে টেনে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। কেন এমন করে কষ্ট দিই। এক্সাম শেষ চলো বিয়ে করে ফেলি।
সেসব শুনে হাসি। বলি তোমার তো ক্যাডারের জব হবে। বেকার ছেলের সঙ্গে কি তোমার বাবা-মা বিয়ে দেবেন। দু’ঠোঁট ফুলিয়ে তখন তার সে কি অভিমান। ছলছল দুচোখের ভাষা পড়তে কষ্ট হয় আমার। বুকের ভেতর জড়িয়ে রেখে আদরে সোহাগে ভরিয়ে দিয়ে বলি, একটা চাকরি খুঁজে পেলেই তোমার বাবা-মাকে
আমার গ্রামের বাড়িতে বৃদ্ধা মা। কাকাদের দেখভালে চলে। পৈত্রিক কিছু ফসলী জমি পুকুরের মাছ চাষের বদান্যতায় কাকারা মায়ের সেবাযত্ন করেন।
মায়ের শরীর সংকটজনক। খবর পেয়ে গ্রামে গিয়ে দেখি ততক্ষণে বেঁচে থাকার অদম্য প্রচেষ্টা মায়ের শুধু আমাকে দেখার জন্য। আমার কোলে মাথা রেখে মা চলে গেলেন।
ছন্দবিহিন জীবনে আরও একবার ছন্দ পতন হলো আমার। তিনমাস পর আমার পৈত্রিক সম্পদের বিলিবন্টন ব্যবস্থা করে যখন আঞ্জুমের হোষ্টেলে খোঁজ নিতে এলাম। শুনলাম সে তাঁর গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে।
বেশ কদিন আগে তার বান্ধবীর ঠিকানায় দু’টো চিঠি এসেছে আমার। কেয়ার অফ সেই বান্ধবী।
চিঠি খুলে পড়তেই আমার দুচোখের কার্ণিশে তপ্ত লোনাজল টের পেলাম।
ভাষাটা মোটামুটি এরকম,
আমার জন্য অপেক্ষা করে শেষে গ্রামে গিয়েছে। গ্রামে প্রান্তিক কৃষক বাবা-মায়ের ঘরে আরও ক’জন পড়ুয়া সন্তান আছে। অর্থনৈতিক অস্বচ্ছল পরিবারে যেটা চরম দুর্ভোগ।
গ্রামের বিত্তবান পরিবারের সুশিক্ষিত সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ছেলে (লন্ডনের মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার) দেশে ফিরে এসেছে। তাকে দেখে মূহুর্ত দেরি না করে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়েছে।
বাবা-মা তার কোন ওজর-আপত্তি শোনেনি। ছোট কোনগুলো আর অসহায় পরিবারের মুখের দিকে তাকিয়ে শেষাবধি তাকে সম্মতি দিতে হয়েছে। আমি যেন তাকে ক্ষমা করে দিই।
হাহাহা
কী আনন্দ!!
যাক, আঞ্জুম ফিরে পেয়েছে তার প্রিয় প্রাঙ্গন।
ভালোই তো। চালচুলোহীন সংসারে অশান্তির মধ্যে আছি। সেখানে তোমাকে কোন রাজসুখে রাখতাম বলো??
খোলা প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে বহুদিন পর বুকের ভেতর আড়মোড়া ভেঙে দেয় কষ্টগুলো। টের পাচ্ছি দুচোখের শিরশিরানি।
কাঁধে কারো কোমল স্পর্শ পেতেই সম্বিৎ ফিরে পেয়ে চমকে উঠলাম। তাকিয়ে দেখি বেদনাহত মুখে পাশে দাঁড়িয়ে আঞ্জুম। সাথে তার ছোট এক পুতুলসোনা। ঠিক যেন নিপুণ কারিগরের তৈরি একটা মাটির প্রতিমা।
বললো
=এটা আমার মেয়ে। কি করছো আজকাল? জব করছো কোথাও? বিয়ে করেছো? ছেলেমেয়ে ক’জন?
কি জবাব আছে দেবার মতো!
জবাব না পেয়ে বললো,।
= বিয়ে করে আমাকে নিয়ে দুবাই, লন্ডন দৌড়ের ওপরে কেটেছে দিন। আমার বিসিএস জব জয়েনিং অফার লেটার এলেও জব করতে দিলো না। মেয়ের দেখভাল করে সময় পার হয়েছে। চার বছর পর দেশে ফিরেছি। আগামীকাল ভোরে ফিরে যাবো তাই আজ গ্রাম থেকে চলে যাচ্ছি।
নির্বাক হয়ে শুনলাম।
বললাম
= সুখি হয়েছো!
নাগো, আমার আর জব করা হয় নি। কার জন্য কিসের জন্য জব করবো?
বিয়ে?
সে তো তোমার সাথে বিরিসিরি গাঁয়ের মন্দিরে আঙটিবদল করে করেছিলাম।
নাহ্,
সামাজিকভাবে বিয়ে করিনি আর।
ভবঘুরে মানুষ। সময় পেলে চলে যাই বিরিসিরির সেই গোবরা গাঁয়ের মাটিতে। তোমার আমার স্মৃতির বুনিয়াদি সেই ঘরে। দুচারদিন সেখানে থেকে তোমাকে খুঁজি নির্জন পাহাড়ের কাছে। করজোড়ে মিনতি করতে থাকি তোমাকে ফিরে পেতে।
কি যেন কি হয় আঞ্জুমের চোখে। জলের ক্ষীণকায় দুফোঁটা গড়িয়ে গেলো।
সমালে নিয়ে মেয়ের হাতটা শক্ত করে ধরে সে।
ওদিকে তখন আপ ট্রেনের সাড়া পড়েছে।
আঞ্জুম লম্বা পা ফেলে এগিয়ে যায় তাঁর ট্রেন ধরার ব্যতিব্যস্ততায়।
জলভরা চোখে আমি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছি।
তপ্ত লোনাজলের প্রতিবিম্বয় একজনা আঞ্জুম অ নে ক আঞ্জুম হয়ে ছড়িয়ে পড়ে আমার দৃষ্টি-সীমানায়।
আহা!
বড় সাধ জাগে একবার তোমায় দেখি!
এক জনমে মেটে না সাধ ভালোবাসিয়া!
আঞ্জুম!
প্রিয় আঞ্জুম আমার!
আমি যে সত্যি তোমাকে আজও ভালোবাসি!
#আঞ্জুম
(একজন #রূপা কে!)
©সিরাজুল ইসলাম।
বাংলাদেশ থেকে
………………………………………………………………………………………………….
-
-
-
-
__________________________________________________________
-
-
-
-
-
-
-
__________________________________________________________
-
-
_______
-
-
-
-
-
-
-
-
-
-
-
-
-
-
-
-
-
-
-
-
-
-
-