কবিতা :- আগমনী

কলমে – মধুমিতা দেব

কন্ঠে – সঞ্চিতা সরকার  

আকাশ বাতাস উঠল ভরে আগমনীর সুরে,

এমন দিনেই এসেছিলাম মায়ের কোলটি জুড়ে।

আমি আগমনী,

অঞ্জলি ভরা মৃত্তিকাচূর্ণ নিয়ে অপেক্ষা করছি আজ তোমার জন্য….

 চিনতে পার আমাকে?

হুঃ….চিনবে কি করে?

তোমরা যে ভদ্দর লোক…..

তোমার আলিশান বাড়ির মধ্যে থেকে আজ ভেসে আসে আগমনীর সুর,

শিউলি আর স্থলপদ্মের সুবাসে ভরে থাকে তোমার বাগান,

তোমার লক্ষীপ্রতিমার মত সুন্দরী স্ত্রী, রোজ প্রদীপ জ্বালে তুলসীতলায়…

আর আমি…?

আমার কথা বাদ দাও…

আমি তো তোমাদের মত ভদ্রলোক নই….

তবে, সে ছিল একদিন…

শ্যামলিমা মাখা ছোট্ট একটা গ্রামে বড় হয়েছিলাম আমি,

স্কুলের গন্ডি তখনও পার করিনি,

বান্ধবীদের সাথে ফেরার সময়, রোজ আরচোখে দেখতাম,

তুমি ঐ কাঠচাঁপা ফুলের গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে আমাকে অপলক চোখে দেখছ…

সেই থেকেই শুরু….

দেখতে দেখতে কখন যে তোমার দু চোখের পলকে বন্দী হয়ে গেলাম বুঝতেই পারিনি।

এভাবেই বছর দুই কাটার পর,

তুমি উচ্চশিক্ষার জন্য চলে গেলে শহরে….

গর্বে আমার বুক ভরে উঠেছিল।

যাওয়ার দিন তুমি আমার দু হাত ধরে বলেছিলে, “আমাকে ভুলে যাবি না তো পাগলী?”

আমার দু চোখের জল বাগ মানেনি সেদিন।

 বলেছিলাম, “আমি ভুলে যাব? একমাত্র মৃত্যু এলেই তোমাকে ভুলতে পারব।”

তোমার যাওয়ার পথের দিকে অপলক তাকিয়ে ছিলাম সেদিন….

ধীরে ধীরে দূর থেকে দূরে যেতে যেতে বিন্দুতে পরিনত হলে,আর কিছুক্ষণ পড়ে মিলিয়ে গেলে কোথায় যেন….

ভয় হচ্ছিল সেদিন, হয়ত তুমি আর ফিরে আসবে না।

ফিরে এসেছিলে তুমি….

বছরে দু-একবার আসতে,

কয়েকদিন থেকে আবার ফিরে যেতে…

তখন তুমি প্রচন্ড ব্যস্ত থাকতে, উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়তে,

সময় কোথায় আমার দিকে তাকানোর?

তুমি মস্ত বড় মানুষ হবে, অনেক নাম হবে তোমার…

সব তো আমারই জন্য…

তাই বিরক্ত করিনি তোমাকে,

তোমার উন্নতির পথে বাঁধা হতে চাই নি….

কিন্তু আমার মোহন বাঁশির সুর বেসুরো বাজতে শুরু করেছে ততদিনে….

 মরিয়া হয়ে ছুটে গেছিলাম তোমার কাছে।

তুমি জানালে, তোমার মা-বাবার মত নেই, তাঁদের অমতে তোমার বাড়ীতে আমার স্থান হবে না।

আমার পা-য়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল।

অস্ফুটে বললাম,” তবে তো তোমাকে ভুলতে, মৃত্যুকেই আলিঙ্গন করতে হবে।”

তুমি চমকে উঠলে,

তোমার হাত স্পর্শ করল আমার কম্পিত ঠোঁট….

বললে, “একথা বলিস না রে পাগলী,আমি সহ্য করতে পারবনা।”

খুশিতে পাগল হয়ে গেলাম আমি,

না… এখনও প্রেম  মরে যায় নি।

কিন্তু উপায়?

“একটা উপায় আছে,আমাদের কটা দিন একটু কষ্ট করে চলতে হবে রে পাগলী, তারপর কয়েক বছর পর চাকরী পেয়ে গেলে, সব কষ্টের অবসান হয়ে যাবে।”

সেদিন গভীর রাতে, তোমার হাত ধরে বেরিয়ে পড়লাম…

পিছনে ফেলে এলাম আমার পরিবার,

আমার ঘর,

আমার শৈশব….

সেদিন পিছন ফিরে তাকাই নি একবারও,

নতুন সংসার গোছাব দুজনে মিলে….

সেই আনন্দে আত্মহারা ছিলাম সেদিন,

 ছুটন্ত ট্রেনে, দুরন্ত গতিতে পৌঁছলাম শহরে,

একটা এক কামরার ঘরে ঠাঁই হল দুজনের।

সেই রাতটা দুজনে স্বপ্নের মতই কাটালাম…

তোমাকে কষ্ট করতে দেব না…

 তাই বাড়ি থেকে বেশ কিছু টাকা আর কিছু গয়না সাথে এনেছিলাম,

অচেনা বিপদবহুল জায়গায় ঘরে রাখা নিরাপদ নয়।

তাই, তুমি সব নিয়ে তোমার ব্যাঙ্কে আর লকারে রেখে আসতে গেলে….

বলে গেলে, সাবধান,

আমি এসে ঠিক তিনবার দড়জায় টোকা দেব,

তখনই শুধু দরজা খুলবে….

সকাল গড়িয়ে দুপুর,

দুপুর গড়িয়ে বিকেল,

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে….

কি করব? কোথায় যাব জানি না…

বুঝলাম, তুমি নিশ্চয় কোনও বিপদে পরেছ….

কি করব ভাবতে ভাবতেই দরজায় তিনবার টোকা পড়ল…

একছুটে দরজাটা খুলে দিলাম…

কিন্তু একি! এরা কারা?

বাঁচাতে পারলাম না নিজেকে….

বুঝেছিলাম তোমার কোনও বিপদ হয়েছে….

তোমাকে খুঁজতে গিয়ে মৃত্যুকে আর আলিঙ্গন করা হল না।

তারপর….???

তারপর,

বহু হাত বদল হওয়ার পর, পৌঁছলাম এখানে…..

নাঃ….আর কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না….

বাড়ীতে ফেরার রাস্তা তো নিজেই বন্ধ করেছিলাম….

তবে বিশ্বাস কর, তোমাকে খোঁজ করার চেষ্টাও করেছিলাম,

ভেবেছিলাম বিপদে পড়েছ,

ঠিক আমাকে খুঁজতে খুঁজতে আসবে একদিন,

আমি বলব,” আমি নষ্ট হয়ে গেছি,আ-আমার কাছে এসনা।”

আর তুমি আমার কাছে এসে বলবে,

” দুর পাগলী, তোর মন তো পবিত্র, আর শরীর!সে তো ধুয়ে নিবি।”

বারবার স্বপ্ন দেখেছি সেদিনের,

তুমি আসবে,

ঠিক ফিরে আসবে আমার কাছে।

কতদিন পরে আজ আমার স্বপ্ন সত্যি হল।

আমাদের কোঠার সামনে মস্ত এক কালো রঙের গাড়ী এসে দাঁড়াল…

কানাঘুষোয় শুনলাম, শহরের খুব বড় এক মানুষ…

তার একটা সই-এর অনেক দাম।

তার সুন্দরী বৌ-এর রোগমুক্তির মানত ছিল…

কথা দিয়েছিল, এবছর নিজে হাতে মা-য়ের পূজার যোগাড় করবে…

তারপর দেখতে পেলাম তোমাকে,

দুই হাত জোড় করে গাড়ী থেকে নেমে এলে….

তখন এই কোঠায় বাজছে মুজরার ঘুঙুর,

চারদিকে মঁ মঁ করছে সস্তা আতরের উগ্র গন্ধ…

আমাকে দেখলে তুমি….

চিনতে পারলে কি?

নাঃ চেনার কথাও নয়…

সদ্য ফোটা বেলের কুড়ি এখন বাসী হয়ে  গেছে…

একি! আমার কাছে দু হাত বাড়ালে কেন তুমি….???

চিনতে পেরেছ বুঝি?

কি দিতে পারি এখন তোমায়?

না না…আমি যে নষ্ট হয়ে গেছি…

হঠাৎ তোমার কথায় চুরমার হয়ে গেল আমার স্বপ্ন…

তুমি দু হাত বাড়িয়ে বললে,

“এই কোঠার একটুখানি মাটি দেবে আমায়, মা-য়ের পূজা যে এই মাটি ছাড়া হবেনা”

ঘরের পাশের শিউলি গাছটা থেকে, টুপটাপ করে ঝড়ে পড়ল কয়েকটা শিউলি ফুল…

আকাশে বাতাসে আগমনী সুর নষ্ট মেয়ের দোরে,

(আমি আগমনী) অঞ্জলি ভরে মৃত্তিকা আজ এনেছি তোমার তরে।।

Loading