নিজস্ব প্রতিনিধি – প্রতিপক্ষ যতই শক্তিধর হোক- মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবার প্রমাণ করে দিলেন যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজনীতিতে তিনি এখনো অপরাজেয়। তার জনপ্রিয়তা হয়তো ১০ বছর আগের চাইতে কিছুটা কমে গেছে- কিন্তু ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল কংগ্রেস আবারও বিপুল বিজয় পেয়েছে, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দল বিজেপিকে বহু পিছনে ফেলে।
বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আনার জন্য স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বারবার এই রাজ্যে এসে সভা করেছেন, কিন্তু তবু ভোটের লড়াইয়ে এঁটে উঠতে পারেননি পায়ে চোট পেয়ে হুইলচেয়ারে বসে প্রচারাভিযান চালানো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে।
অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে- কেমন করে পশ্চিমবঙ্গের এবং সর্বভারতীয় রাজনীতির এত বড় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠতে পারলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় – কী তার সাফল্যের উৎস। সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক শিখা মুখার্জি বলেছেন, রাজনীতিবিদ হিসেবে তার এই সাফল্যের পেছনে কিন্তু একটা প্রতিভা কাজ করে। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি এটা লিখেও গেছেন যে মমতা ব্যানার্জীর একটা ক্যারিশমা বা সম্মোহনী ক্ষমতা আছে। তবে ১৯৭০-এর দশকে যখন তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল কংগ্রেস দলের একেবারে সাধারণ একজন কর্মী হিসেবেই। তিনি ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর অনুরাগী এবং তার প্রাথমিক রাজনৈতিক জীবন কেটেছে পশ্চিমবঙ্গে ওই সময়ের সিনিয়র কংগ্রেস নেতা প্রণব মুখার্জির ছায়ায় – যিনি পরবর্তীকালে ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। কলকাতার হাজরা এলাকার এক নিম্নবিত্ত পরিবারে মমতা ব্যানার্জীর জন্ম ১৯৫৫ সালে। তার বাবা ছিলেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগের একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ এবং যোগেশচন্দ্র কলেজ থেকে আইনে ডিগ্রি নেওয়ার পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম পেশা ছিল শিক্ষকতা। তবে রাজনীতি করতে শুরু করেছিলেন ছাত্রজীবন থেকেই।
কিছুদিনের মধ্যেই দলে সিনিয়র নেতাদের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনীতিতে অনেক দূর যাবেন।
১৯৭৬ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সেই তিনি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য মহিলা কংগ্রেসের (আই) সাধারণ সম্পাদক হন। কয়েক বছর পর তিনি হন নিখিল ভারত যুব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ।
“মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা বিশেষত্ব হলো তার প্রচণ্ড লড়াকু মনোবৃত্তি, এবং তার পরিশ্রম করার ক্ষমতা” – বলছিলেন শিখা মুখার্জি। তার ভাষায়, “তার রাজনৈতিক জীবনে বহু বাধা এসেছে, ২০০১ সালে রাজ্য নির্বাচনে হারার পর তার দল তৃণমূল কংগ্রেস প্রায় ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, কিন্তু তিনি আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন, দলকে পুনর্গঠিত করেছেন। এটা তার লড়াই করার ক্ষমতার প্রমাণ।”
মহিলা কংগ্রেসের নেতা হওয়ার পরই তিনি একজন উদীয়মান রাজনীতিবিদ হিসেবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর নজরে পড়েছিলেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং প্রতীচী ট্রাস্ট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়কারী সাবির আহমেদ বলেছেন, ছোট ছোট অনেক ঘটনা আছে যার মধ্যে দিয়ে তিনি তখনকার কংগ্রেসের বড় বড় নেতাদের নজরে এসেছিলেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় ঘটনা হলো ১৯৮৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে সোমনাথ চ্যাটার্জির মতো প্রবীণ সিপিআই (এম) নেতাকে হারানো। প্রকৃতপক্ষেই সেটা ছিল এক সাড়া-জাগানো ঘটনা। কলকাতার যাদবপুরের একটি লোকসভা আসনে সেই প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতাকে হারিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতের অন্যতম সর্বকনিষ্ঠ পার্লামেন্ট সদস্য হয়েছিলেন। এর পর ১৯৮৯ সালে নির্বাচনে ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেসবিরোধী হাওয়ার মধ্যে তিনি সেই আসনে হেরে যান। কিন্তু কিছুদিন পরই ১৯৯১ এ আবার কলকাতা দক্ষিণ আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে লোকসভায় ফিরে আসেন এবং পরে আরও পাঁচবার লোকসভা সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।
লোকসভা সদস্য থাকার সময় বেশকিছু ঘটনায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই ‘লড়াকু’ ও ‘প্রতিবাদী’ ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে। নিজ দলের বিরুদ্ধে সিপিআইএমকে সহায়তার অভিযোগ আনা, পার্লামেন্ট ভবনে পেট্রোলিয়াম মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ, একজন এমপির সঙ্গে হাতাহাতি, ‘পশ্চিমবঙ্গের প্রতি বঞ্চনার প্রতিবাদ জানাতে’ রেলমন্ত্রীর প্রতি শাল ছুড়ে মারা এবং এমপি পদ থেকে ইস্তফা – ইত্যাদি নানা ঘটনায় আলোচিত হয়েছিলেন তিনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন ১৯৯১ সালে, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন পি ভি নরসীমা রাও। আর প্রথম পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে রেল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান ১৯৯৯ সালে – যখন বিজেপি-নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের অংশ হয়েছিল তার নিজের প্রতিষ্ঠিত দল তৃণমূল কংগ্রেস।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নির্বাচন
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৯৯৮ সালে এবং কিছুকালের মধ্যেই এটি পরিণত হয় বামফ্রন্ট-শাসিত পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলে।
বামফ্রন্ট সরকারের সময় ২০০৫ সাল থেকে পরবর্তী কয়েক বছরে পশ্চিমবঙ্গে শিল্প স্থাপনের জন্য কৃষিজমি বরাদ্দের কয়েকটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে গণ-অসন্তোষ তৈরি হয়।
বিশেষ করে সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে জমি রক্ষার জন্য গড়ে ওঠা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রধান বিরোধীদলে পরিণত হয় তৃণমূল কংগ্রেস।
নন্দীগ্রামে আন্দোলনরত জনতার ওপর পুলিশের গুলিতে অন্তত ১৪ জন নিহত হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার-বিরোধী মনোভাব জোরদার হয়ে ওঠে।
নন্দীগ্রামে কৃষকদের বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে ওঠেন রাজ্যের জনপ্রিয় নেতা।
২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে বামফ্রন্টের চাইতে বেশি আসন পায় তৃণমূল।
আর তার দু’বছর পর বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে মমতা ব্যানার্জীর তৃণমূল দল ওই রাজ্যে ৩৪ বছর ধরে ক্ষমতাসীন থাকা বামফ্রন্টকে হারায়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রথম নারী মুখ্যমন্ত্রী। এরপর থেকে তিনি নিরবচ্ছিন্নভাবে ক্ষমতায় আছেন। এরপর ২০১৬ এবং ২০২১ এর নির্বাচনেও জয়ী হয় তৃণমূল কংগ্রেস। বিদায়ী রাজ্য বিধানসভার ২৯৫টির মধ্যে তার দলের হাতে ছিল ২১১টি আসন।
পপুলিস্ট রাজনীতি?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল কংগ্রেস থেকে। তিনি ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর একজন অনুরাগী। তার রাজনৈতিক দর্শন মূলত কংগ্রেসের মধ্যেকার সমাজতন্ত্রী ধারার সঙ্গে মিলে যায়।
শিখা মুখার্জি বলেন, কল্যাণ রাষ্ট্রের ধারণা অনুযায়ী সাধারণ মানুষের জন্য খাদ্য সুরক্ষা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, শিক্ষা- অর্থাৎ যে সমস্ত সেবা বিনে পয়সায় পাওযা উচিত- এটাই তার আদর্শিক অবস্থান, এটার জন্যই উনি লড়ে যাচ্ছেন। আর এটা ক্লাসিকাল কংগ্রেসেরই নীতি। নন্দীগ্রাম আসনে জিতে ১৪ বছর আগে রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পথ করে নিয়েছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার রাজ্যের দরিদ্র ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠী, নারী এবং সংখ্যালঘুদের জন্য নানা রকম জনকল্যাণ প্রকল্প চালু করেছে ।
‘কন্যাশ্রী’, ‘সবুজ সাথী’, ‘স্বাস্থ্য সাথী’ -এ রকম প্রকল্পগুলো একদিকে প্রশংসিত হয়েছে, আবার অন্যদিকে ‘পপুলিস্ট কর্মসূচি’ বলে সমালোচিতও হয়েছে। এসব প্রকল্পে নানা দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তি-ইমেজই তৃণমূলের শক্তি? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তার রাজনৈতিক দল তৃণমূল কংগ্রেসকে নিয়ে সমালোচকরা বলেন, এটি একান্তভাবেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা দল। বিবিসির সাংবাদিক সৌতিক বিশ্বাস, তৃণমূল কংগ্রেসকে খুব সুশৃঙ্খল দল বলা যাবে না। তাদের দলের কাঠামোও সুদৃঢ় নয় এবং দলটি কোনো আদর্শের ভিত্তিতে তৈরি হয়নি। একজন আকর্ষণীয় ও সহজাত নেত্রীর ব্যক্তিত্বের ওপর ভর করে গড়ে উঠেছে দলটি। রাজনীতিবিদ হিসেবে তার সাফল্যের কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বলছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক বিরল ক্ষমতা রয়েছে মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারার। সাবির আহমেদ বলেন, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এলিটিজমের একটা প্রভাব আগে থেকেই ছিল – কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রেসিডেন্সি কলেজে না পড়েও বা নামী রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম না নিয়েও সফল রাজনীতিবিদ হয়েছেন। তার আটপৌরে ব্যাপারটাই মানুষ পছন্দ করেছেন।
সূত্র: বিবিসি বাংলা