ভারতবর্ষের নামকরণ ভারত কেন হল
প্রফেসর ডক্টর কুশল সেন
Prof & Head
Dept.of Applied Numbers
Astrological Research Institute of Krishnamurthi paddhati
Agartala Tripura*
Niti Aayog, Govt. of India.
সদস্য, মার্গদর্শক মন্ডল, ভারতীয় বৈদিক জ্যোতিষ সংস্থানম্, বারানসী
e-mail : kooshoeg@gmail.com
যজুঃর্বেদ এর ৭ম অধ্যায় ১৪নং মন্ত্রে উল্লেখ রয়েছে ‘সা প্রথমা সংস্কৃতি বিশ্ববারা’ – অর্থাৎ বিশ্বে আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতিই প্রথম। এছাড়াও হিন্দু শাস্ত্রে বলা হয়েছে ‘বিশ্ব ভবেৎ এক নীড়’, অর্থাৎ সারা বিশ্ব একই গৃহ। তাই ‘রাষ্ট্র’ হিসাবে অনাদিকাল থেকেই প্রাচীনতম সভ্যতা ও সংস্কৃতির অধিকারী ছিল ভারতবর্ষ। কিন্তু এই ‘ভারত’ নাম অযোধ্যার রাজা পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র-এর ভাই ভরত বা রাজা দুশ্মন্ত শকুন্তলার পুত্র ভরত এর নাম থেকে নামকরণ হয়নি।
রাজা ভরতের পূর্বের ও পরবর্তী সকল রাজাকেই ‘ভরত’ বলা হত কারণ রাজা হিসাবে তিনি তাঁর সকল প্রজাগণের প্রবন্ধন ও ভরণপোষণ করতেন। এই যুক্তির সপক্ষে মহাভারতের আদিপর্বের ৭৪ নং শ্লোকে, ঋষি বেদব্যাস উল্লেখ করেছেন –
‘ভর্তাত ভারতি কীর্তিয়ে নেদম ভারতম্ কুলম’…
-মহাভারত, আদিপর্ব, ৭৪নং শ্লোক।
ঋক্বেদ –এ ‘ভারত’ শব্দের বিস্তৃত উল্লেখ করে বলা হয়েছে – ‘বিশ্বামিত্রস্য রক্ষতি ব্রহ্মেদম ভারতং জন্ম’ – ঋক্বেদ, ৩য় মন্ডল, ৫৩সূক্ত, ১২ শ্লোক পুরানে কথিত আছে – আমাদের এই পৃথিবী ৭টি বিশাল দ্বীপে বিভক্ত ছিল, এই ৭টি মহাদেশ এর কথা কোন দেশের বা সভ্যতার কোন প্রাচীন শাস্ত্রে উল্লিখিত নেই আধুনিক যুগ ব্যতীত। এই ৭টি মহাদেশ বা বিশালাকায় দ্বীপ ছিল প্লক্ষদ্বীপ, শাল্মলিদ্বীপ, ক্রৌঞ্চদ্বীপ, কুশদ্বীপ, জম্বুদ্বীপ, শাকদ্বীপ ও পুষ্করদ্বীপ। এই ৭টি দ্বীপের মধ্যবর্তী দ্বীপ জম্বুদ্বীপের শিবালিক পর্বতমালায় প্রথম অমৈথুনীয় বা অযোনিক (বিনা য়োনী) সৃষ্টি হয়েছিল। তাই প্রাচীনতম ভারতবর্ষের ভৌগলিক সীমা নির্ধারনের জন্য বলা হত- ‘আর্য্যাবর্তে জম্বুদ্বীপে ভারতখন্ডে ভারতবর্ষে’ অর্থাৎ পৃথিবীর সেই বর্ষ বা খন্ড যেখানে দেশটি জামুন বৃক্ষের সদৃশ্য তাকেই ভারত বলা হয়। ভরণপোষণের ব্যবস্থা ও বিচারধারা যে দেশে প্রচলিত, তাকেই পৌরণিক শাস্ত্রে ‘ভারত’ বলা হয়েছে।
আবার ঋক্বেদে উল্লিখিত রয়েছে – জম্বুদ্বীপে উত্তর ধ্রুব (Pole Star) থেকে দক্ষিণে পর্বতাঞ্চল হিমক্ষেত্রে যে ত্রিবেষ্টম অবস্থিত তাতে যে অযোনিক সৃষ্টি (বিনা যোনিতে সৃষ্ট প্রাণী) হয়েছিল তা প্রধানতঃ তিন প্রকারের ছিল – বনস্পতি, শ্বেদেচ্ছ (লার্ভাযুক্ত প্রাণী), অখন্ড (ডিম্ব থেকে সৃষ্ট) এবং জরায়ুজ (স্তন্যপায়ী) তারা মানস সরোবরের তীরে প্রথম প্রকাশমান হয়েছিল। তাই ঋক্বেদে বলা হয়েছে – ‘যুক্তা মাতা শ্বেতভুবি দক্ষিণা অতিষ্ঠঃ গর্ভ’ – ১ম মন্ডল, ১৬৪ সূক্ত, ৯ মন্ত্র ঋকবেদ’।
এই অযোনিক সৃষ্টির প্রাণীরা নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে অর্থাৎ সমতল তরাইয়ের থেকে ধীরে ধীরে দক্ষিণের দিকে প্রাণের বিস্তার করে। সেইকালে শস্য ও আনাজ নিজে থেকেই উৎপাদন হত। ‘নাতিশীতোষ্ণ’ আধুনিক শব্দ হলেও প্রাচীন সংস্কৃত শব্দ ‘ভরতাগ্নি’ থেকেই উদ্ভুত। ঋক্বেদে ২১টি সিন্ধুর উল্লেখ রয়েছে।
পশ্চিমে – শতদ্রু, ইরাবতী, বিপাশা, বিতস্তা, দশগতি,সিন্ধু ও সরস্বতী।
দক্ষিণে – কাবেরী, কৃষ্ণা, গোদাবরী, নর্মদা, তুঙ্গভদ্রা, মহানদী ও তাপ্তি।
উত্তর-পূর্বে– গঙ্গা, যমুনা, গন্ডকী, গোমতী, সরযূ, সয়ন্দিকা ও মহানদী।
প্রাচীনতম ভারতখণ্ডে দুটি নদ ছিল যা আজও বর্তমান – ব্রহ্মপুত্র ও শোন।ভারত এত ঊর্বরা ভূমি ছিল যে প্রথম মানব এই ভূমিখন্ডেই জন্মগ্রহণ করেছিল। অগ্নি থেকে মেঘের সৃষ্টি, তা থেকেই বৃষ্টি জলসেচন এর কাজ করে জমিতে অন্ন উৎপাদন করত। এহেন বর্ষে (‘বর্ষ’ শব্দটি বৃষ ধাতু থেকে উদ্ভুত) বা খন্ডে যারা বসবাস করতেন তারা পশুর মতো শক্তিশালী ও পরিশ্রমী লোক ছিলেন। তাই ‘শতপথ ব্রহ্মণ’ নামক প্রাচীন গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে – ‘লোকয়ম্ ভারতবর্ষম’।
এই ভারতবর্ষ বা ভারতখন্ডের মানুষ ‘আত্মবৎসর্বভূতেষু’ এর সাংস্কৃতিক চেতনা ও দায়িত্ববোধে উদ্ভুদ্ধ ছিল (আত্মবৎ সর্বভূতেষু। অর্থাৎ সর্বজীবকে যিনি নিজের মনে করেন) বলেই ভারতের মানুষকে দিব্যমানব বা মহামানব বলে উল্লেখ করা হয়েছে – ‘মনুর্ভব জনেয়া দেব্যম্’।
জম্বুদ্বীপের প্রাচীন অধিপতি, মহারাজ অগ্নীধ্র এর ৯টি পুত্র ছিল। নাভি, কিম্পুরুষ, হরিবর্ষ, ইলাবৃত, রম্যক, হিরন্ময়, কুরু, ভদ্রাশ্ব এবং কেতুমাল। রাজা অগ্নীধ্র জম্বুদ্বীকে ৯টি খন্ডে খন্ডিত করে নয় পুত্রকে ৯টি খন্ডের রাজা চয়ন করেন। রাজা নাভির নামে একটি বর্ষ বা খন্ডের নামকরণ করা হয়, যার নাম হয় – অজনাভ বর্ষ। রাজা নাভি এবং তাঁর পত্নী মেরুদেবীর এক পুত্র ছিলেন যার নাম ছিল ঋষভদেব। ঋষভদেব-এর সবচেয়ে বড় পুত্রের নাম ছিল ভরত। তাই অজনাভ বর্ষ বা খণ্ডের নাম হয় – ভারতবর্ষ। পুরানের আধারে প্রাচীনতম ভারতবর্ষের বিস্তার ৯০০০ যোজন বা ৮১০০০ মাইল ছিল। ভারতবর্ষ অন্য বর্ষ বা খন্ড থেকে শ্রেষ্ঠতর ছিল কারণ ভারত ছিল কর্মভূমি আর অন্যান্য বর্ষ বা খন্ডগুলি ছিল ভোগভূমি।
এখন প্রশ্ন হল ‘ভারত’ শব্দের এমনকি গূঢ় অর্থ বা তাৎপর্য রয়েছে, যা বিশ্বের দুটি মহত্বপূর্ণ গ্রন্থে (রামায়ণ ও মহাভারত) প্রাচীনকাল থেকেই স্থান পেয়েছিল? ‘ভারত’ প্রকৃতপক্ষে তিনটি শব্দ দ্বারা উদ্ভুত হয়েছে।
ভা – ভাবনা বা প্রকাশ, ঈশ্বরীয় সত্য (সাময়িকরূপে সাদা জ্যোতিঃ এর প্রকাশ)
র – রজস বা রজঃগুণ (লোহিত বা লাল রঙ)।
ত – তমস বা তমঃগুণ (শ্যাম বা কৃষ্ণ)। ‘রত’ শব্দার্থে লীন হওয়া অর্থাৎ এমন দিব্যভূমি যেখানে বসবাসকারী লোক সত্যের অনুসন্ধানে ধ্যানে রত বা লীন থাকে। আবার ঈশপনিষদে বলা হয়েছে প্রকৃতি ও দৃশ্যমান জগৎ শুক্ল (সাদা), লোহিত (লাল), কৃষ্ণ (কালো), এই ত্রিবর্ণের এক বিচিত্র সমাহার। ‘অজয়ে একম লোহিত শুক্ল কৃষ্ণম প্রকৃতিঃ’-ঈশউপনিষদ।
ভারতবর্ষের ভৌগলিক অবস্থানের ভিত্তিতেও উপরোক্ত এই তিন বর্ণের সমাহার লক্ষ্যণীয়।উত্তরভারতে হিম বা বরফাচ্ছাদিত হিমালয় সাদা বর্ণের বা শুক্লবর্ণ ; এখানকার লোক আনুপাতিকরূপে ফর্সা বা শ্বেতবর্ণের । তরাই অঞ্চল বা বিন্ধ্যাচলের মৃত্তিকার রঙ গম বা হালকা পীত বর্ণের । দ্রাবিড় অঞ্চলের মৃত্তিকার রঙ কৃষ্ণ, লোক আনুপাতিকরূপে কালো। তাই এই দেশের নাম হল ভারতবর্ষ বা ভারত যা প্রকৃতপক্ষে স্বতঃ রজঃ তমঃ এই তিনগুণের সমষ্টি।