অণু গল্প – নতুন দিশা

কলমে :- অদিতি মুখার্জী সেনগুপ্ত

 

সকল বাধা বিপত্তির মেঘ যেন কেটে যাবে মৃণালের জীবন থেকে, এই নববর্ষের দিনে, এটাই মোহিনীর অটুট বিশ্বাস। তমসার আঁধার কেটে এক নতুন দ্যুতির আবির্ভাব ঘটবে আজ ওদের সুখের সংসারে। মোহিনী বরাবর মহাদেব-এর ভক্ত। শ্রাবণ মাসে অনেকবার বাক কাঁধে করে, “হর হর মহাদেব” বলতে বলতে তারকেশ্বরে পৌঁছে, মনের সুখে শিব ঠাকুরের মাথায় জল ঢেলে, মৃতুঞ্জয় মন্ত্র উচ্চারণ করলেই ওর মনের সকল গ্লানি নিমেষেই দূরে চলে যেত।

মৃণালের বরাবরের একটাই  শক, পুরোনো ধাতুর মুর্তি সংগ্রহ করা। আর এর জন্য ওর শ্যালক রাহুল ওকে যথেষ্ট সাহায্য করত। রাহুলের দোকানে এক অদ্ভুত দেবীর মুর্তি, মৃণালের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রাহুলের বক্তব্য এটাই যে ওই মুর্তিটা ও কোনও যাদুঘরে দিয়ে দেবে, কারণ যবে থেকে ওই মুর্তি দোকানে আসার পর থেকেই রাহুল বিচিত্র সব স্বপ্ন দেখতে থাকে। রাতে রাহুলের ঘরে কে যেন ঘুঙুর পরে নাচে। ঘুম ভাঙার পর কাউকেই দেখতে পায়না। এই সব শোনার পর মৃণালের জেদ চেপে গেল, ওই মুর্তিটা ও নিজের সংগ্রহে রাখবেই। মুর্তিটা সযত্নে বাড়িতে নিয়ে এসে, একটা সুন্দর সিংহাসনে স্থাপন করে। প্রথম এক সপ্তাহ বেশ ভালোই কাটল। তারপর অমাবস্যার রাতে হঠাৎই মৃণালের বাড়িতে ঢুকেই যেন সব কিছুই অদ্ভুত ঠেকল। মোহিনীর সাথে আচমকাই বকাবকি শুরু করল। ওর মনে হতে লাগল ওর পিঠে যেন কে বসে আছে। অসহ্য  যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল।  মোহিনী যন্ত্রণা লাঘব করার জন্য  ওর আরাধ্য মহাদেব-এর প্রসাদী ফুল মাথায় ঠেকাতে যেতেই মৃণাল রাগান্বিত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালো আর ফুলটা কুটিকুটি করে ছিঁড়ে, থুতু দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল। মোহিনীকে চিৎকার করে বলল,”আমার চোখের সামনে থেকেএকদম দূরে  চলে যাও।” মোহিনী যেন এই মৃণালকে চেনে না।

রাতে মোহিনী যা দেখল, তাতে ওর চক্ষু চড়কগাছ। মৃণাল ফ্রিজ খুলে কাঁচা মাংস খাচ্ছে। মোহিনী আর সহ্য করতেই পারল না। এরকম চলতে থাকলে মোহিনী তো পাগলই হয়ে যাবে। পয়লা বৈশাখের আগে কিছু একটা করতেই হবে। ঠিক করল, নীল ষষ্ঠীতে মহাদেব-এর মাথায় জল দিয়ে এই প্রার্থনাই করবে যে মৃণালের সব কষ্ট যেন দূর করে দেয়। তবে মনে একটা সন্দেহ রয়েই যাচ্ছিল যে, ও কি নিজের মনোবাঞ্ছা পূরণ করতে পারবে? বাধ্য হয়েই মোহিনী, নিজের বান্ধবী, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, কুমারিকার সাথে যোগাযোগ করল। কুমারিকা সব কিছু শুনে, মোহিনীকে একজন প্যারানর্মাল বিষয়ে গবেষক-এর সন্ধান দিল। মি.রস্তোগী সব কিছু ধৈর্য্য সহকারে শোনার পর মোহিনীকে বললেন, “আমি আপনাদের বাড়িটা ভালোভাবে ঘুরে দেখতে চাই।” মোহিনী রাজি হয়ে গেল।

মি.রস্তোগী ঢুকেই, ঘরের ভিতরে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন। মুর্তিটা স্পর্শ করতেই ওনার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা শিহরণ বয়ে গেল। মুর্তির ভিতরে কার বসবাস এটা জানতেই হবে।

পরের দিন মি.রস্তোগী এসেই নিজের ঘরের থেকে মন্ত্রপুতো জল ছেটানোর পরেই এক আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে যায়। মৃণাল কর্কশ কন্ঠে চিৎকার করে ওঠে,”আমাকে কী তোরা শান্তিতে থাকতে দিবি না? আমার ভক্তের সাথে থেকেই তো আমি আমার উদ্দেশ্যে সফল হবো। আমার স্ত্রীয়ের ঈশ্বরের ভক্তির জন্যই আমি আমার জীবনে অনেক শাস্তি পেয়েছি। আমার নৃত্যের আর মিতভাষী ব্যবহারের জন্য অনেক মহিলাই আমার প্রতি আসক্ত হতো। আর আমার স্ত্রী আমার এই কুকর্মের জন্য আমাকে পরিত্যাগ করে আর মোহিনীর দাদা রাহুলের সাথে বিবাহিত জীবন যাপন করছে। আমি পৃথিবীতে যারাই  ঈশ্বর ভক্ত, তাদেরকে এভাবেই কষ্ট দেব, বিশেষ করে মোহিনী। আর মৃণাল আমাকে স্বেচ্ছায় নিয়ে এসেছে। আমি বেশ ভালোই আছি। মি.রস্তোগী বললেন, “এবার আমার ক্ষেপণাস্ত্র প্রয়োগ করার সময় এসে গেছে। আমি আগামীকাল নীল ষষ্ঠীর দিনেই এখানে সব ব্যবস্থা করব।” মোহিনী এককথায় রাজি হয়ে গেল।

সারারাত মৃণালের ছটফট করে কাটল, একবার মোহিনীকে মৃতুঞ্জয় মন্ত্র উচ্চারণ করতে শুনে, ওর গলা চেপে ধরতে গিয়েও, থমকে গেল ওর কবচের ছোঁয়াতে।

পরেরদিন মি.রস্তোগী সকাল সকাল পৌঁছে গেলেন, মোহিনীদের “ত্রিদিব” ভিলাতে। মুর্তির প্রাণ বিসর্জন মন্ত্র উচ্চারণ করলেন এবং মোহিনীকে আদেশ করলেন, “নির্ভয়, মৃতুঞ্জয় মন্ত্র উচ্চারণ করতে করতে, মুর্তিটা কে কাছের কোনো জলাশয় বিসর্জন দিয়ে এসো। তারপর বাড়ি ফিরে মৃণালের মাথায় প্রসাদী ফুল ঠেকিয়ে দিও। তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”

মি.রস্তোগী-এর নির্দেশ মোহিনী অক্ষরে অক্ষরে পালন করল। এইসব চলাকালীন মৃণাল যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। মোহিনীর ডাকে ওর ঘোর কাটতেই, মুর্তির আসন খালি দেখে আঁতকে উঠে, মোহিনীকে প্রশ্ন করল,”আমার সাধের মুর্তি কোথায়?” মোহিনী বলল,”তোমার স্বাভাবিক জীবন যাপনে ওই মুর্তি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাই ওটাকে বিদায় করেছি। নববর্ষে ওই আসনের শুদ্ধিকরণ করিয়ে, ওখানে লক্ষ্মী-গনেশের মুর্তি প্রতিষ্ঠিত করার ইচ্ছা, আর এবার থেকে বুঝে শুনে অ্যানটিক জিনিস পত্র বাড়িতে আনবে।” মৃণাল সম্মতি জানিয়ে ঘাড় নাড়ল। দুজনেই  গেয়ে উঠল,”মঙ্গল দীপ জ্বেলে…।”

ওদের জীবনে নববর্ষ নতুন আলোর দিশা নিয়ে আসুক এই কামনাই করি।

Loading