নমি চরণে

কলমে ✍️: সুপ্তি বসু

……………………..

নমি নমি চরণে, নমি কলুষহরণে

সুধারস নির্ঝর হে, নমি নমি চরণে।

তোমারে নমি, হে আমার প্রাণের কবি,

তুমি আমার বিষাদে, হরষে, সুখে দু:খে,

তুমি নও শুধু ছবি।

ঠাকুর তুমি ছিলে, তাই আমি আছি। শুধু ছিলে না, আছো, থাকবে চিরদিন, যতোদিন বাঁচি।

আজ তোমায় চন্দনে, মালায়, সাজাবো যতনে, ধূপ,  দীপ জ্বালিয়ে আরাধনা করবো তোমায়। পঁচিশে বৈশাখ, বারে বার আসুক ফিরে এই দিন, তোমার জন্ম দিন। আজ কিছু জনকে আসতে বলেছি সন্ধ্যা বেলায় – গানে, কবিতায়, নাচে  এই নর্থ সিকিমের মঙ্গন পাহাড় মুখরিত হয়ে উঠবে।

প্রায় দশ বছর ধরে এই মঙ্গনে আমি আছি। জীবনের কঠিন, জটীলতায় ভরা চেনা জগত যখন হৃদয়হীন, অচেনা হয়ে যায় তখন এই  মুক্ত প্রকৃতিই আশ্রয়দাত্রী। এই পাহাড় আমাকে তার রূপ- মাধুর্য দিয়ে দুহাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করেছিলো। আমি মন্ত্র মুগ্ধের মতো সৌন্দর্য এ আকৃষ্ট হয়ে, এখানেই থেকে গেলাম। প্রাণের ঠাকুরকে নীবিড় ভাবে অনুভব করা, এর থেকে ভালো জায়গা আর কি আছে। ধীরে ধীরে আশে পাশের মানুষগুলোর সারল্য আন্তরিকতায় মন ভরে গেলো। এরা কতো সহজে অপরিচিত কে আপন করে নিতে পারে!  আসলে কোনো প্রত্যাশা নেই যে তাদের।

নাহ: আজ তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হবে।  আজ কিছু জনকে আসতে বলেছি।দুপুরের পর থেকেই সবাই আসতে শুরু করবে। সন্ধের পরই ত সব অন্ধকার, তাই ফিরতে হবে সবাইকেই।

এখানে আসার পর থেকেই একটা সুন্দর অভ্যাস হয়েছে, খুব ভোরে উঠে  উন্মুক্ত প্রকৃতির বুকভরে বিশুদ্ধ বাতাস নিয়ে হাঁটা। পঞ্চোশোর্ধ আমি, আরো দশ বছর পেছনে চলে গিয়েছি যেন, বয়স কমিয়ে দেয় প্রকৃতির মাধুর্য।  নিজেকে ভুলে থাকতেই ত চাই। এরপর বুধিয়ার হাতে মশলা দেওয়া গরম চা, আহা: জীবন এতো সহজ?  ভোরের অহনা হালকা গোলাপি রূপে প্রকাশ, ধীরে ধীরে হালকা স্বর্ণালি রঙ তারপর গাঢ়  রঙের সোনা গলিয়ে ঢেলে দেয় চারিদিকে। আমি এক মুহূর্ত নষ্ট করি না। লেফাফা খুললেই পরতে পরতে নতুন রূপের বার্তা, প্রকৃতি আপন খেয়ালে দিয়ে যায়। আমি সব টুকু চোখ দিয়ে, হৃদয় দিয়ে অনুভব করি।

বাবা আমার নাম রেখেছিলেন পূর্ণিমা। যেদিন জন্মেছিলাম পূর্ণিমা ছিলো। ভেবেছিলেন আমি  জ্যোৎস্নায় স্নাত করে  দেবো চারিদিক। কিন্তু পূর্ণিমা একদিন অমানিশায় পরিণত হবে, বাবা বোধহয় ভাবেন নি।

বড়ো হওয়ার সাথে সাথে কবি রবি, আমার অন্তরে, আত্মায়। তাঁর সুর, কবিতা, সাহিত্যে কাব্যে, চিন্তা ভাবনায় নিজেকে  জড়িয়ে নিয়েছি কখন  জানি না। আমার  জীবনের চলার পথের  পথপ্রদর্শক, ঈশ্বর রূপে। আমার বিষাদে, হরষে, সুখে, দু:খে তিনি আমার পাশে।

” তুমি বন্ধু নাথ, নিশিদিন তুমি আমার,

তুমি সুখ, তুমি শান্তি, তুমি হে অমৃত পাথার।’

রবীন্দ্র ভারতী থেকে সঙ্গীত শিক্ষা।তাঁকে আরো গভীর ভাবে জানা, তাঁর সঙ্গে দিন যাপন করা এক অনাবিল প্রশান্তি। এই সুখ আমার শিরায়, মজ্জায়, আমি এই শান্তির পূজারী। এই শান্তি, সুখকে লালন, করি প্রতিমুহূর্তে, শ্রদ্ধা করি, পূজো করি।

” আমার হৃদয় তোমার আপন হাতের দোলে  দোলাও”।

এর মাঝেই আলাপ হলো ঝকঝকে উজ্জ্বল,প্রাণবন্ত  পড়াশোনায় চৌখস  অনিকেতের সঙ্গে। তারপর ভালোবাসা, বিয়ে। তারপর সংসারে মনোনিবেশ। ভালোই  কাটছিলো দিনগুলো। কিন্তু, না,  আমি ভুল, মানুষকে বিশ্বাস করেছিলাম। আমার রবীন্দ্র ভাবনা, এক চাপা অসন্তোষ এর কারন, অনিকেতের পরিবারে। অনিকেত জানতো আমার পূজারী, আমার ঈশ্বর কে।

আমার গান গাওয়া কবিতা সবেতেই আপত্তি ছিলো শ্বশুর বাড়িতে।  অনিকেত কেন নীরব?  ওতো আমার ঈশ্বর পূজারীকে সম্মান জানাতো!! আমি বিস্ময়, কেউ গান শুনতে ভালোবাসে না?? তাও মেনে নিলাম। ঠিক আছে,  আমার মনেই ত আছেন প্রানের ঠাকুর।

চরম আঘাতটা এলো একদিন অপ্রত্যাশিত ভাবে। সেদিন স্কুল থেকে ফিরে, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমার ভালোবাসা, আমার শ্রদ্ধা, আমার মন সব ধূলোয় লুন্ঠিত। আমার সব খাতা, বই, হারমোনিয়াম সব মাটিতে!!!মনে হচ্ছিলো আমার হৃৎপিন্ডটা উপড়ে দিয়েছে কেউ। সমস্ত শরীর, মনকে কেই যেন ফালা ফালা করে দিয়েছে। মন, চোখ ভিজে গেলো, কেউ বুঝলো না।

” দু:খের বরষায় চক্ষের জল যেই নামলো,দরজায় বন্ধুর রথ সেই থামল।

এতো দিনে জানলেম যে কাঁদন কাঁদলেম সে কাহার জন্য”।

সেই দিনই  আমার প্রাণের ঠাকুর, গীতবিতান বুকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম, চিরদিনের জন্য। চলে এলাম বাবার কাছে। ” বাবা তোমার পূর্ণিমা আলোকিত করতে পারলো না”। সেদিন ঘর বন্ধ করে খুব কেঁদেছিলাম, গীতবিতান, সঞ্চয়িতা ভিজে গেলো।

আমি উঠে দাঁড়ালাম, মুক্তির সন্ধানে। ঈশ্বর ত আমার সাথেই।

” প্রভু আমার, প্রিয় আমার পরম ধন হে

চিরপথের সঙ্গী আমার চিরজীবন হে”।

তারপর সিকিমের এই মঙ্গন পাহাড়  আমাকে দু হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করে নিলো পরম স্নেহে। জটীলতায় ভরা, যন্ত্রণাময় এক অধ্যায় থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পেলাম। আমার প্রাণের ঠাকুর, ঈশ্বর আরাধনা র এই ত আদর্শ জায়গা। থেকেই গেলাম পাকাপাকি ভাবে,  পিছু টান থেকে মুক্ত হতে। এই সারল্য এ ভরা মানুষ গুলোর আন্তরিকতায়। মন ভরে গেলো পরিপূর্ণ। আর কী অদ্ভুত, আশেপাশের সরল মানুষ গুলো, যাদের ভাষা আলাদা তারা আমার রবীন্দ্র সাধনায় সামিল হয়ে গেলো!!

” আমারে তুমি অশেষ করেছো, এমনি লীলা তব।

ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব “।

একী!!! কতো বেলা হয়ে গেলো!  আজ আমার কী হলো এতো দিন বাদে হঠাৎ পিছনের  বেদনাদায়ক, রক্তাক্ত অতীত  কবর খুঁড়ে সামনে এলো? আজো আমাকে তাড়া করে বেড়ায়?  কেন?

” প্রভু বলো বলো কবে

তোমার পথের ধুলার রঙে রঙে আঁচল রঙিন হবে”।

সন্ধ্যা সমাগমে সকলে চলে এসেছে। ফুল মালায়, চন্দনে অপরূপ সাজে মহারাজ।

” হে নূতন,  দেখা দিক আর

বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ “।

মঙ্গনের আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে পাহাড়ে প্রতিধ্বনি উঠলো তোমার জন্ম দিনে।লহ প্রণাম। আমার বেদনা ক্লিষ্ট জীবনের মুক্তি।

” আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে”।

Loading