ছোটো গল্প – কথার ফাঁদে
কলমে – স্বপ্না মজুমদার
অনেক বছর আগের কথা। সময় তখন অন্য রকম।কট্টর সি পি এম সমর্থক অবনী বাবু ছেলের বিয়ে দেবেন। খুঁজছেন মধ্য শিক্ষিতা সুন্দরী ঘরোয়া রান্না জানা,এক সুপাত্রী। সাহিত্যকে ভালোবাসা,সি পি এম সমর্থক পরিবারের মেয়ে।
তখন জ্যোতিবাবুর আমল। অবনী বাবু বাড়ির ড্রয়িং রুমে বড় একটা জ্যোতিবাবুর ছবি লাগিয়ে রেখেছেন। আছে মার্কস,লেলিন। অপর দিকের দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত,শরৎ,বঙ্কিমের ছবি। ঘরে আছে রবীন্দ্র রচনাবলী,বঙ্কিম রচনাবলী ইত্যাদি বহু গ্ৰন্থ থরে থরে সাজানো।
ছেলের সম্বন্ধের জন্য যারাই আসেন গোঁফে হাত বুলিয়ে বলেন,কোনো কিছু চাই না আমার। শুধু আপনার মেয়েকে ওই যা বলেছি ওটুকু হলেই হবে।
কতো মেয়ের বাপ যে হতাশ হয়ে ফিরেছেন তার ঠিক নেই। অবনী বাবু নিজের সিদ্ধান্ত ছেড়ে বেরোতে চান না। অবশেষে কনিকা কে দেখে অবনী বাবুর খুব পছন্দ।
উচ্চমাধ্যমিক পাশ।গান জানে। বেশ সুরেলা কন্ঠ।কনিকার বাবা কংগ্ৰেস সমর্থক। কিন্তু এইটুকুর জন্য এমন হিরের টুকরো জামাই পেয়ে হারাতে মন সায় দিল না,শঙ্কর বাবুর।উনি ব্যাপারটা গোপন করে গেলেন। ভাবলেন বিয়েটা আগে হয়ে যাক। সব চেয়ে বড় কথা অবনী বাবুর ফ্যামিলী না জানলেই হলো। মেয়েকে ভালো করে শিখিয়ে পড়িয়ে নিলেন। মেয়ে বলেছিল– বাবা, একসাথে থাকতে হবে,যদি কখনো ভুল করেও বলে ফেলি। তখন কি হবে। বাবা শঙ্কর চৌধুরী বললেন — অতো ভাবিস নে মা। একবার বিয়ে হয়ে গেলে,আর কি করার আছে।
এ সব নিছক পাগলামি অবনীবাবুর। গদিতে এখন জ্যোতিবাবু আছেন তো,তাই অতো লম্বা চওড়া কথা।
কি সব বলে গেলেন সেদিন,,,সর্ব হারার নেতা।
যত্তোসব। উনি কি বোঝেন কংগ্ৰেসের ভ্যালু। সে সব বুঝতেন গুনী জনেরা। একদিন ঠিক পাশা ওল্টাবে। সেদিন অবনী বাবুকে দেখে নেব।
যাইহোক,বিয়ে খুব ধূমধাম করে হয়ে গেল। কনিকা শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় শঙ্কর চৌধুরী কানের কাছে মুখ এনে বললেন —শোন্ মা, এখন কাঁদবি পরে। জামাইকেও কিছু বলিসনি, যেন কখনো। তোর শ্বশুরটা বড্ড কট্টর ঢ্যাটা।বড় দেরিতে বুঝলাম।সাবধানে থাকিস। আমি তো পাশেই রইলাম। চিন্তা করিস না। শুধু মুখ খুলিস না।
বেশ সুখেই কাটছিল কনিকা শেখরের বিবাহিত জীবন।
বিয়ের দু বছর পরে কোলে ছোট্ট মহুল চলে এসেছে।
নাতি পেয়ে সংসার সুখে কানায় কানায়।
এখন সামনে বিধান সভা ভোট। কনিকা শেখরের সাথে গেছে ভোট দিতে। ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার আগে অবনী বাবু বারে বারে বৌমাকে বলেছেন,ছবি দেখিয়েছেন — কাস্তে হাতুড়িতে ঠিক মতো ছাপ দিও। এদিক ওদিক তাকাবে না। একটা ভোট ভীষণ দামী।মনে রেখো।
কনিকা চুপ করে মাথা নিচু করে শুনেছে।
গত দুই দিন ধরে বাবা,মা বারে বারে কনিকাকে বলেছে —একদম চুপ থাকবি। ও বাড়িতে পার্টি দল বিষয়ে কোনো কথা মতামত একদম নয়। কনিকা ও সে কথা এই দু বছরে ভালোভাবে বুঝেছে। শ্বশুর খাওয়া দাওয়া ভুলে যায় পার্টির কাজে, মিটিংএ মিছিলে। শাশুড়িও বেশ কট্টর।
শেখরো কম নয়।বাপ ছেলেতে গম্ভীর আলোচনা চলে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে। টিভির খবর,পেপার গিলে খায়।
কনিকা হাঁপিয়ে ওঠে এই পরিবেশে। ভাবে এরা এমন কেন। সাধারণ জীবন মাঝে মাঝে ভুলে যায়।
কনিকা ও শেখর ভোট দিয়ে বেরিয়ে এসে বাইকে চাপে।
শেখর বলে— এবারো আমরাই জিতবো। কি বলো?
অন্যমনস্ক কনিকা বলে— কেন?
শেখর— কি বলছো তুমি। মানুষ বোকা নয়। সব বোঝে।
জ্যোতি বসু ছাড়া কে আছে বাংলার হাল ধরবে। তুমি এমন করে কেন বললে কেন কনি?
তুমি ঠিক জায়গায় ভোট দিয়েছো তো?
কনিকা অন্য মনস্ক ভাবেই বলে— এতো বলো কেন তোমরা? একটু ঝেঁঝে ওঠে। ভোট দেওয়া নিজস্ব অধিকার। নিজস্ব ভাবনা ও মতামত। আমি কোথায় ভোট দিয়েছি জানাতে বাধ্য নই।
শেখর শুধু বলে— আমরা পুরো পরিবার এক ভাবনায় চলি। তুমি পরিবারের বাইরে নও।
বাড়িতে আসে কনিকা। শ্বশুর জিঙ্গাসা করে আবার শাশুড়িও জিঙ্গাসা করে। বিরক্ত হয়ে ওঠে কনিকা।
শেখরকে বলে— কিসের পরিবার? তোমার পরিবার,, পরিবার। আমার পরিবার আমার নয়?
অবনী বাবু —- মানে? কি বলতে চাইছো বৌমা?
কনিকা — বাবা, আমি আর এই মিথ্যা নিয়ে চলতে পারছি না। আমাকে আমার মতো থাকতে দিন।
এবারে শাশুড়ি বলেন — তুমি তো সব জানতে বৌমা। আমরা তো তোমাদের মিথ্যে বলে এই বিয়ে দিইনি।
তাহলে তুমি আজ এসব বলছো কেন?
কনিকা চুপ করে যায়।
শেখর বলে— যা বোঝার বুঝেছি কনিকা। তুমি ও তোমার পরিবার আলাদা বলেই দিলে। বাবার ইচ্ছা শুধু এটুকুই ছিল। এটাও যদি না পূরণ করতে পারো। তবে তুমি এ বাড়ির কেউ নও।ও বাড়িতে গিয়েই থেকো। এ পরিবার তোমার জন্য নয়।
কনিকা চমকে ওঠে।বলে– কি বলছো তুমি? আমি তোমার স্ত্রী। তোমার সন্তানের মা।এই বাড়ির বৌ।
শেখর— ঠিক বলছি। তুমি যেতে পারো। তবে মহুল যাবে না। ও এই পরিবারের বংশধর।
কনিকা পরের দিন চলে যায়। ওইটুকু ছেলেকে কিছুতেই
শেখর দেয় না কনিকার কাছে। কনিকার বাবা বলেন— এমন ভুল কেন করলি মা? ওরা যে বড্ড কট্টর।
কনিকা —– ভুল আমার নয় বাবা। ভুল করেছো তুমি।
আমি তার খেসারত দিলাম।
শঙ্কর চৌধুরী — আমি আদালতে যাব। মহুলকে তোর কাছে ফিরিয়ে আনবো।
কনিকা—- তোমায় আমার জন্য আর কিছু করতে হবে না বাবা। মহুল ওর বাবার কাছে আছে।থাকতে দাও।
বড় হয়ে বুঝতে শিখলে, হয়তো নতুন কিছু ভাববে।
ও এ যুগের ছেলে।ভালো মন্দ বোঝার ক্ষমতা একদিন সময় হলে ওরো হবে। ততোক্ষণ অপেক্ষায় থাকবো।
সমাপ্ত