একবিংশ শতাব্দীর দ্বারে এমন কথা উচ্চারিত হয়

কলমে – সোনালী মুখার্জী

 

 

দূর সম্পর্কের দাদু দিদার কাছে আঁতুর থেকে মানুষ রাত্রি এর কারণ সে একজন কন‍্যাসন্তান।সে যখন তার সুন্দরী মায়ের গর্ভে ছিল তার বাবা একটাই কথা বলতো এখানে আমার “ছেলে” আছে।কিন্তু সময়  হলে যখন মেয়ে হলো বাড়ির সকলে বাচ্ছাটির দিকে অবহেলার দৃষ্টিতে তাকালো।বাবা বললো,এ তো কালো হবে দেখছি।তার বাবার আবার কালো পছন্দ নয় তার উপর মেয়ে।

আঁতুর তুলতে বাপের বাড়ি গেলো রাত্রির মা গেলো। দাদু দিদা দেখতে এসে শিশুটিকে অবহেলার কথা শুনে বললো,সুস্হ বাচ্ছার জন্ম  হয়েছে, আবার কি চাই?ছেলে বা মেয়ে যাই হোক তার জন‍্য শিশুটার কী দোষ?আর তার মায়ের কী দোষ?ছেলে,মেয়ে যাই হোক তার জন‍্য তার বাবা দায়ী।

একমাসের মধ‍্যে রাত্রির মায়ের জন্ডিস ধরা পড়লো।ডাক্তার বললেন,আপনি সুস্হ হলে বাচ্ছাকে দুধ দেবেন।সেই সুযোগে বাচ্ছা রেখে তার মা কে বাবার বাড়ি থেকে  শ্বশুর বাড়ি নিয়ে চলে গেল। সিজারে বেবী,বাচ্ছার মায়ের O নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত। একমাস গেলো,দু মাস গেলো বাচ্ছাটির খবর নেয়না।নিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা।এরা ফোন করলে বলে ওর মা অসুস্হ,বাচ্ছাটাকে দেখার লোক নেই।আগে ওর মা সুস্হ হোক তারপর দিয়ে যাবেন।

রাত্রির অন্নপ্রাশন হলো না।

এদিকে সাতমাস পার হলো বাচ্ছাটির মা নূতন করে অসুস্হ হলো,পরীক্ষা করে জানা গেলো পেটে চার মাসের বাচ্ছা আছে।

এবার আরো পাঁচ মাস কাটার পর  সেই সিজার করেই এবার ছেলে হলো।মহাধূমধাম করে সকলকে মিষ্টিমুখ করিয়ে ছেলেকে ঘরে তুললো।মেয়ের কথা তারা তুললোই না। সে কেমন করে হাসে,কেমন করে বসে আর কেমন করে খেলে তার মা দেখতেও পেলো না।নাহ্ এখনের মতো ভি ডি ও কল্ হয়নি।

বাপের বাড়ির লোকেরা অভিমানে  বাচ্ছাটির বাড়ির লোকের সাথে কোনো যোগাযোগ  করত না। কী সুন্দর দেখতে হ য়েছে মেয়েটি।নাম রাত্রি। রাত্রি কে নিয়ে দাদু দিদা বেশ খুশিতেই আছে। রাত্রি যত বড়ো হচ্ছে বড্ড জেদী আর রাগী হচ্ছে।দিদাকে মা বলে। একটু বড়ো হলে জানতে চায় তার বাবা কোনটা।একদিন ফোন করে বাবার সাথে কথা বলিয়ে দেয় দাদু। পার্কে গিয়ে দেখে বাবা তার বাচ্ছাদের খেলতে নিয়ে যায় ওর বাবা নিয়ে যায় না কেন? মা,বাবা কেহ রাত্রির সাথে দেখা করেনা। দিদা রাত্রিকে বলে তোর একটা ছোট্ট ভাই আছে তাই ওরা তোর কাছে আসতে পারে না। রাত্রি বলে আমি কেন মা-বাবার কাছে নেই,ভাই তো আছে?সবার একটা বাড়ি আমার কেন অন‍্য বাড়ি?

রাত্রির সব কথার উত্তর দাদু দিদা দিতে পারে না।রাত্রির মা মাঝে মধ‍্যে রাত্রিকে দেখতে আসে।রাত্রি বলে আমি তোমার সাথে যাবো আর ভায়ের সাথে খেলবো।ওর মা রাত্রিকে বুঝিয়ে রেখে যায়।

এমনি করে রাত্রি বড়ো হ য়।রাত্রিকে কোনদিন একথা বলা হ য়নি যে,তুই মেয়ে বলে তোর বাবা তোকে নিয়ে যায় না।ওকে বলা হ য়েছে তুই মন দিয়ে পড়াশোনা করে মস্ত ব‍্যরিস্টার হবি।মেয়েদের হয়ে লড়বি।মেয়েদের দুঃখ দুর্দশা নিয়ে লড়াই করবি।

পড়াশোনা,নাচ গান সব শেখে রাত্রি।পড়াশোনায় ভীষন ভালো।ঐ এক জায়গায় একটা প্রশ্ন রাত্রিকে কেন তার বাবা,মা তাদের বাড়িতে রাখে না।ও তো বড়ো হয়েছে,ভাই ও বড়ো হ য়েছে এখন সমস‍্যা কোথায়?

ভাইকে বাইক কিনে দিয়েছে,ফোন কিনে দিয়েছে ওকে দেয়নি কেন?

দিন দিন বড়ো জেদী আর রাগী হ য়ে উঠছে।ছোঁড়াছুড়ি করছে।মনমরা হ য়ে থাকে। এই সব দেখে দাদু সাইকোলজিস্টিের কাছে নিয়ে যায়।

রাত্রিকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করেন ডাক্তারবাবু।যেমন তোমার নাম,কী ভালোবাসো?কোন ক্লাসে পড়ো?আগে পরের সংখ‍্যা,বাদ‍্যযন্ত্রের নাম,ফলের নাম,পাখীর নাম,নদী ঝরনা কী ভালোলাগে,তবলা হারমোনিয়াম কোনটার শব্দ ভালো,নিরানব্বই থেকে  এক বিয়োগ করলে কত হ য়,সেটার থেকে সাত বিয়োগ করলে কত হ য়? সব কথা শেষ হলে দিদাকে বললেন,একটা সত‍্যিকথা বলবেন?ওরা কী কন‍্যা সন্তান হবার জন‍্য বাচ্ছাটিকে অবহেলা করে?সেদিন সব কথা অকপটে ডাক্তারবাবুকে বলতে হলো।রাত্রিও সব কথা শুনলো।

কিছু পরীক্ষা দিলেন।সেগুলো করে আবার ও নিয়ে যাওয়া হলো। রাত্রি এখন কাউন্সিলিং এ আছে।ওর বাবা,মাকেও ডেকেছেন ডাক্তারবাবু।সুরাহা একটাই হ য়েছে বাবা,মায়ের সাথে রাত্রি কথা বলে তবে এখনো বাড়ি তে যায়নি।ভাই বলেছে দিদি বাড়িতে এলে তবেই ফোঁটা নেবে।জেটুর মেয়েদের থেকে ফোটা নেবে না।দিদিরা বাড়িতে আছে আর ওর নিজের দিদি বাইরে আছে কেন?এসব কথায় কেহ কর্ণপাত করে না।ভাইবোনে ফোনে কথা হ য়।

রাত্রি ভীষণ  মন মরা।পড়াশোনা করে সে ব‍্যারিস্টার হবে এবং অবহেলিত মেয়েদের হ য়েই লড়বে।

নাহ্,অপমানজনক কথা বাবা মাকে বলেনা।ওর অধিকার ও দাবী করে না।মনে একটাই দুঃখ রাত্রিকে কেহ ভালোবাসে না।দাদু দিদা তারা তো এমনিই ভালোবাসবে তবে তার বাবা,মায়ের ভালোবাসা কোথায়?ভাই আছে অথচ ও কেন পরের বাড়িতে? সব প্রশ্নের উত্তর রাত্রি এই সমাজব‍্যবস্হার কাছ থেকে পেতে চায়।সকলেই যদি ছেলে চায় একদিন এই ছেলে সন্তান ভূমিষ্ঠ করবে কে বা কারা?

রাত্রি বড়ো হচ্ছে?হাজারো প্রশ্নের পাহাড় তার কাছে।কাউনসিলিং এ আছে রাত্রি।ডাক্তারের কাছে এখন একাই যায়।বিদ্রোহী মন ছুটে চলেছে আরো কত রাত্রির কাছে।এরকম কত শত রাত্রির হ য়ে সে লড়াই করবে।মায়েদের জন‍্য ও লড়বে রাত্রি। নীরবে কেন তারা অত‍্যাচার সহ‍্য করে রাত্রির মতো আরো কত শত রাত্রির জীবনে অন্ধকার ডেকে আনবে?

 

Loading