মা-মেয়ের সম্পর্ক দারুণ এক সম্পর্ক। গল্প উপন্যাসে চমৎকার সব মা-মেয়ের সম্পর্কের গল্প শুনতে পাই। যতটা বন্ধুসুলভ মা-মেয়ের সম্পর্ক তা সামাজিক বাস্তবতায় ভিন্নভাবে দেখা যায়। কিশোরী মনের যত্নে পরিবারে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারেন মা নিজেই।

মা-মেয়ের মনের যত্নের কৌশল নিয়ে জানাচ্ছেন, যুক্তরাজ্যে গবেষণারত মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক পিএইচডি গবেষক ও চিভেনিং স্কলার ড. কামরুন নাহার কলি।

মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এখন সবাই সচেতন হচ্ছেন। পরিবারের কাঠামো শিশু-কিশোর আর তরুণের মানসিক স্বাস্থ্য বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মেয়ে শিশু ও কিশোরীরা পরিবারে সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় থাকে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে।

আমাদের বইপত্রে বা শিক্ষাব্যবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা কম বলে মেয়ে শিশু ও কিশোরীরা নারী স্বাস্থ্য ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে জানার সুযোগ পায় কম। মেয়ে শিশু ও কিশোরীর মনের যত্নে মা হতে পারেন পথপ্রদর্শক, মা হতে পারেন দায়িত্বশীল রোল মডেল।

মেয়ে শিশু ও কিশোরীকে বুঝতে হবে: আপনি একজন মা। আপনার মত করে আপনার মেয়ে শিশু ও কিশোরীকে বুঝলে চলবে না।

বয়সের পার্থক্য ও যুগের ভিন্নতার একটা বিষয় সবসময় মাথায় রাখতে হবে। একেকজন মানুষ একেক মননের অধিকারী। একেক জন মানুষের ভাবনা একেক রকম। কিশোরী মনের নানান প্রশ্ন থাকে। নানান বিষয়ে তার আগ্রহ থাকে।

মা হিসেবে আপনার মেয়ে শিশু ও কিশোরী কেমন তা আপনাকে জানতে হবে। সে কিভাবে দুনিয়া দেখে, সে কিভাবে বাস্তবতাকে বুঝতে চায় তা মা হিসেবে আপনাকে জানতে হবে।

সম্পর্ক সাবলীল করুন: আমাদের সামাজিক ব্যবস্থায় মা-মেয়ের সম্পর্ক কিছুটা শীতল থাকে। বিশেষ করে বয়:সন্ধিকালীন সময়ের মত গুরুত্বপূর্ণ সর্ম্পবে। মাকে কন্যা ভয় পাবেন-এটাকে স্বাভাবিকভাবে ধরে নেই আমরা। এতে একটা মানসিক ও সম্পর্কগত দূরত্ব তৈরি হয়। মা-মেয়ের সম্পর্ক সাবলীল রাখার চেষ্টা করতে হবে। মা হিসেবে মেয়ে শিশু ও কিশোরীর চিন্তার দুনিয়া সাজানোর চেষ্টা না করাই ভালো। আপনার মেয়ে শিশু ও কিশোরী যেভাবে পৃথিবী দেখতে চায় তা জানার চেষ্টা করুন। কৈশোর সময়ে সম্পর্ক কঠিন থাকলে পরবর্তীতে আপনার মেয়ে প্রাপ্ত বয়স্ক হলে সম্পর্ক স্বাভাবিক অবস্থায় আনা কঠিন হয়ে পড়ে।

পাশে থাকুন, কথা শুনুন: মেয়ে অনেক কিছুই আপনাকে বলতে ভয় পাবে। আপনার মেয়ে স্কুল-কলেজে অনেক ভুল করবে-এটাকে স্বাভাবিক ধরে নিন। ভুলের কারণে মানসিক বা শারিরীক শাস্তি এড়িয়ে চলতে হবে। আপনার মেয়ে শিশু ও কিশোরীর পাশে থাকার চেষ্টা করুন। অনেক ময় মা হয়ে রাগ করে চুপ থাকি আমরা। এমনটা না করে বরং তার কথা শুনতে চেষ্টা করুন। কিশোরী বয়সে মেয়ে অনেক শারিরীক, মানসিক ও সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তা মা হিসেবে সব সময় চেষ্টা করতে হবে মেয়ের পাশে থাকতে। মজার ছলে তাকে তার শারিরীক গড় বা তার সহপাঠীর পরীক্ষার নম্বর দিয়ে তুলনা করা যাবে না। বরং তাকে তার মতো করে জীবনের রূঢ় বাস্তবতা বোঝানোর চেষ্টা করুন। সে যেন তার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ কথা আপনাকে শোনাতে পারে, আপনি যেন তার কথা শুনছেন এমন মানবিক হওয়ার চেষ্টা করুন। কোন ভুল হয়ে থাকলে, কন্যা যেন প্রথম আপনার কাছে সাহায্যের জন্য আসে সেভাবেই নিজেকে তৈরি করুন।

শিখতে-জানতে অনুপ্রাণিত করুন: মা হিসেবে আপনার ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ভরণ-পোষণ কিংবা তিনবেলা খাবার আর নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই কিন্তু আপনার দায়িত্ব না। আপনার কন্যাকে একজন মেয়ে হিসেবে না বরং একজন মানুষ হিসেবে শেখার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। শৈশব থেকেই চেষ্টা করুন তার মত করে সৃজনশীল কাজে যুক্ত করতে। স্কুল-কলেজের সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে বাঁধা দেবেন না। নতুন চ্যালেঞ্জ নিতে অনুপ্রাণিত করুন। বইপড়া, ম্যাগাজিন পড়া, স্কুল কলেজে স্কাউটিং-গার্লস গাইডের মত সহশিক্ষামূলক কাজে যুক্ত হতে অনুপ্রাণিত করুন। আপনার অনুপ্রেরণাতেই হয়তো বাংলাদেশ দ্বিতীয় নিশাত মজুমদার-ওয়াসফিয়া নাজরীনের দেখা পাবে।

নিজের চাপ চাপিয়ে দেবেন না: মানুষ হিসেবে আমাদের অনেক অতীতের কষ্ট বা ট্রমা থাকে। আমরা সেই দুঃখের ঝাপি আমাদের সন্তানের উপরে চাপিয়ে দেই। এমনটা না করাই আপনাদের সম্পর্কের জন্য শ্রেয়। নিজের দুঃখ-কষ্ট আপনার বন্ধু হিসেবে আপনার কন্যাকে জানাতে পারেন। সেই দুঃখের ইতিহাস থেকে সে যেন কিছু শিখতে পারে-সেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিন। আপনার ব্যাথা বা কষ্ট থেকে যেন আপনার মেয়ে শিশু ও কিশোরীর বাস্তব জীবন সম্পর্কে ধারণা পায়, দুঃখ নয়।

নিজের স্বপ্ন মেয়ে শিশু ও কিশোরীর উপরে চাপিয়ে দেবেন না: আমরা আমাদের আকাঙ্খিত স্বপ্ন বা আশা আমাদের সন্তানের মাধ্যমে অর্জন করতে চাই। অনেকেই চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে নিজের স্বপ্ন  মেয়ে শিশু ও কিশোরীর উপরে চাপিয়ে দেই। আপনি হয়তো চিকিৎসক হতে পারেননি, কিন্তু  মেয়ে শিশু ও কিশোরীকে ছোট বেলা থেকে চিকিৎসক হতেই হবে বলে চাপ প্রয়োগ করেন। এমনটা করা যাবে না।

একাকী চলার কৌশল শেখান: পৃথিবী বিশাল জায়গা। আপনি মা হিসেবে মেয়ে শিশু ও কিশোরীর জীবনে ২০-২২ বছর পর্যন্ত সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখতে পারবেন। এরপরে পৃথিবীর বাস্তবতায় আপনার  মেয়ে শিশু ও কিশোরীকে একজন মানুষ হিসেবে বাস্তব দুনিয়ার নানান চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। একাকী পৃথিবীতে চলার কৌশল জানাতে হবে আপনার  মেয়ে শিশু ও কিশোরীকে। মানুষ হিসেবে তাকে নানান কৌশল জয় করার কৌশল শেখাতে হবে।  মেয়ে শিশু ও কিশোরী হয়ে জন্মেছে বলে যে শুধু ঘরের কাজ শেখাবেন বিষয়টি এমন নয়। গাড়ি চালানো থেকে শুরু করে সে যেন পাহাড় জয় করতে পারেন এমন ভাবে তৈরি করুন  মেয়ে শিশু ও কিশোরীকে। সামনের দুনিয়ার জন্য তৈরি করুন আপনার  মেয়ে শিশু ও কিশোরীকে। মানুষ হিসেবে তাকে পথ চেনাতে হবে আপনাকে। কম্পাস হয়ে তার জীবনে নিজের অবস্থান তৈরি করুন।

__________________________________________________________

 

 

 

__________________________________________________________

__________________________________________________________

 

 

 

 

 

 

 

 

  

Loading