বাংলার পুতুল ও পুতুলনাচ

 

কলমে ✍️: – ড.আশিস কুমার নন্দী

শিক্ষক, কবি,প্রাবন্ধিক ও লেখক।

বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 

‘পুতুল’-শব্দটি লাতিনে– Pupa,ফরাসিতে —  ‘Poupee’, ইংরেজিতে —-‘Doll’ নামে পরিচিত।

পুতুল মানেই যেন শিল্প সংস্কৃতির ঊষালগ্ন। সেই কোন্ আদিম যুগ থেকেই পুতুল তৈরির প্রচলন ছিল। মানুষ তখন গুহাজীবনে। গুহার দেয়াল ও মেঝেতে যে ছবি

আঁকতো, তাই-ই তো পুতুল তৈরির প্রাথমিক স্তর।যদি বলা হয়, আলতামিরার গুহায় আঁকা ছবি পুতুলের উত্তরপুরুষ, তাহলে অত্যুক্তি হবে না। উল্লেখ্য —‘অস্ট্রিয়ার ভিলেডর্ফ থেকে পাওয়া প্রত্ন- প্রস্তরযুগের মাতৃকা মূর্তি, হরপ্পা সংস্কৃতির বিভিন্ন কেন্দ্রে পাওয়া তাম্র প্রস্তর‍যুগীয় মাতৃকা মূর্তিগুলি, নর্তকী এবং পুরোহিত মূর্তি ইত্যাদি, প্রাচীন প্যালেস্তানীয় সংস্কৃতিতে প্রচলিত পূর্বপুরুষের প্রতিমূর্তি, মিশরের মেমফিস নগরীর পোড়ামাটির নারী পুরুষের মূর্তি, আদিম অরণ্যবাসী বিভিন্ন মানবগোষ্ঠীর পশুপক্ষীর টোটেম প্রভৃতি নিদর্শন নিছক পুতুল মাত্র নয়।'(লোকসংস্কৃতি ও বিশ্বকোষঃ দুলাল চৌধুরী সম্পাদিত /একাদেমি অব ফোকলোর। কোলকাতা -২০০৪)। তার মানে পুতুল ছিল সেসময়। বিবর্তন হয়েছে কালান্তরে। এই পুতুল সম্পর্কে বিশ্বের সব মানুষের কমবেশি পরিচিতি, আগ্রহ আছে ও ছিল। আধুনিক যুগেই যে ত নয়,প্রাচীনকাল থেকেই পুতুল ছিল। চীন, জাপানে পুতুলকে ঘিরে লোক- উৎসবের কথা জানা যায়।জাপানের হিনামাৎসুরি উৎসব বিশ্ববিখ্যাত।ক্যাথলিক খ্রিস্টান দেশে শিশু ঈশ্বর (যীশু)’-এর মূর্তি ছোটদের খেলার পুতুল রূপে ব্যবহৃত হতো বলে মনে করা হয়। সম্ভবত ১৫-শ শতাব্দী থেকে বিভিন্ন নমুনার ফ্যাশন পুতুল (fashion doll)-এর  বিনিময়ের মাধ্যমে দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ে।মনে করা হয়, ১৭-শ শতকে য়ূরোপে সাধারণ ভাবে পুতুলের ব্যবহার হয়। খেলা-মেলা ছাড়াও ঘর সাজাতেও পুতুল ব্যবহৃত হতো। কাদামাটিকে সুনিপুণ হাতে বিভিন্ন রূপ দেওয়া হয়।পোড়ামাটি, তালপাতা, নারকেলের ছোবা, পাট,গালা,কাঠ,কাপড়,এমনকি ঝিনুক দিয়েও পুতুল বানানো হয়।বিভিন্ন ধাতু দিয়েও পুতুল তৈরি করা হয়। মানুষের মূর্তি ছাড়াও হাতি, ঘোড়া, কুমীর, বিড়াল, বিভিন্ন পশুপাখিরও রূপ দেওয়া হয়। দেবদেবীরাও বাদ যায় না। বিদেশে বারবি ডল ব্যবহার করে ধনীর সন্তান। আমাদের গ্রাম বাংলার ছেলে মেয়েরা মা ঠাকুরমার তৈরি পুতুল নিয়ে খেলে অনেক আগে থেকেই । যাদের অবস্থা একটু ভালো, তারা মেলায় পরবে গিয়ে পুতুলের সম্ভার বাড়ায়।টুকটুকে ঠোঁট সবুজ টিয়াপাখি দেখে মায়ের আঁচল টেনে বায়না ধরে। তবে যে যাই বলুক করুক, বাংলার পুতুল একটা আবেগ, একটা অদ্ভূত অনুভূতি। ছেলেবেলার কথাগুলো মনে করিয়ে দেয় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকেও।হয়তো আনমনে পুতুল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে সেইসব

দিনগুলোতে ফিরে যায়।বাচ্চারা ডাগর চোখে তাকিয়ে দেখে ফোকলা বুড়ো বুড়িকে।যতই আজ ভিডিও গেমস, ফ্রি ফায়ার ইত্যাদির বাড়বাড়ন্ত হোক,পুতুল কিন্তু আজও আকর্ষণ, টানের। বাঙালির অন্যতম আদি ঘরোয়া শিল্প। খননকার্য চালিয়ে যেসব পোড়ামাটির পুতুল পাওয়া গেছে, তা থেকে ধরে নেওয়া যায় যে,বহু আগে থেকেই পুতুলশিল্প প্রচলিত ছিল। বাংলার পুতুলের জনপ্রিয়তা আজকের নয়।তৎকালীন জনসমাজের প্রতিফলন পুতুলের মাধ্যমেও হতো।

প্রসঙ্গত বলা যায়, কাঁঠালিয়া স্থানের পুতুল বাঙালি সমাজ ও জীবনের অন্যতম নির্দেশক।  রাজা-রাণী

পুতুল বিস্মৃত ইতিহাসকে মনে করিয়ে দেয়। শিব দুর্গা বিষ্ণু সরস্বতী লক্ষ্মী — ধর্ম ও লৌকিক সংস্কৃতির কথা মনে করিয়ে দেয়। আদিবাসীদের মধ্যেও পুতুলের  প্রচলন ছিল। সেখানেও লোকাচার প্রকাশিত। মোটামুটি বলা যায়, বিভিন্ন বিষয় উল্লিখিত হয়েছে পুতুলের মাধ্যমে। তবে ক্রীড়াসঙ্গী বা নিছক আনন্দের জন্য পুতুল ব্যবহৃত হয়েছে অনেক সময়ই।ঝুড়ি মাথায় পুতুল বিক্রি করতে বেরিয়েছে ফেরিওয়ালা, আমাদের ছোটবেলায় খুব পরিচিত দৃশ্য।রবি ঠাকুর, নজরুল, বুদ্ধদেব, সুভাষচন্দ্র –এরকম মনীষীর পুতুল দোকানে থরে থরে সাজানো থাকে এখনো। ভাইবোন বা পাড়ার ছেলেমেয়ে মিলে পুতুলের বিয়ে বিয়ে খেলা ছিল ভীষণ মজার। পুকুর পাড়ে খালি পায়ে নেমে খানিকটা এঁটেল কাদা এনে কচি হাতে পুতুল গড়ে নেওয়া হতো। অনেক সময় খড়কুটো বা কাঠ পাতার  আগুনে পুড়িয়ে লাল করে নেওয়া হতো। বাড়ির বড়োদের কাছে শাড়ির টুকরো নিয়ে পরিয়ে দেওয়া হতো। শন পাটের চুল।  ভুষা কালি দিয়ে কালো রঙ। কপালে সিঁদুর। ঘোমটা টানা। কী আনন্দের দিন! পুনকা শাকের বীজ কিম্বা বড়ো সরষে দানা দিয়ে চোখ হতো। পুতুল পুতুল ছেলেবেলা। পুতুল পুতুল খেলা। গড়িয়ে যেত বেলা। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ক্ষীরের পুতুল’- বারবার পড়তে ইচ্ছে করে। দুয়োরাণী ক্ষীরের পুতুলকে বিয়ে করতে পাঠাচ্ছেন। ষষ্ঠী ঠাকুর খেয়ে ফেললো সেই ক্ষীরের তৈরি পুতুল। উপহারও দিল এক পুত্রসন্তান। বাংলা সাহিত্যে পুতুল এবং পুতুল খেলা নিয়ে কম লেখাজোখা হয়নি। পুতুল তৈরি একটা লোকশিল্পকলা।সুদূর প্রাচীন কালের আদিম মানুষের শিল্পকলা ভাবনা, আজ তা ক্রমশ বিবর্তিত হয়েছে। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে মানবসভ্যতায় মস্তিষ্ক প্রসূত প্রযুক্তির ক্রমোন্নতি ঘটেছে। প্রযুক্তি প্রকরণের উন্নতি পুতুল শিল্পের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে। পুতুল একটা –‘ফোক আর্ট’। বিশেষ জনগোষ্ঠীর থেকে ক্রমে ক্রমে সবার মধ্যে বিস্তৃতি লাভ করেছে পুতুল। মানবসভ্যতার মানসিক এবং  সাংস্কৃতিক বিকাশের এক বিশেষ নিদর্শন, তা অস্বীকার করা যাবে না। এর মধ্যে মানবসভ্যতার নৃতাত্বিক গুণাগুণগুলির মিশ্রণ ঘটেছে।। এখন প্রশ্ন হলো — পুতুল কেন তৈরি হলো? উত্তরে বলা যায় —

    ১)গৃহসজ্জার উপকরণ।

    ২) শিশু-কিশোর উপযোগী খেলনা। এই খেলনা সামগ্রীর মাধ্যমে শিশু কিশোর মনে মানবসমাজ ও পারিপার্শ্বিক প্রকৃতি  পরিবেশ সম্পর্কে খেলাচ্ছলে একটা ধারণা তৈরি হয়।

    ৩)শুভকামনা ও অশুভকামনার জন্য ধর্মীয় আচার ইত্যাদি পালন।

পুতুল নিয়ে আলোচনা হবে আর শিল্পীদের কথা আসবে না,তা তো হয় না। সূত্রধর,ভাস্কর, কুম্ভকার –এরা শিল্পকলায় অসাধারণ পারদর্শী। তাঁরা নিজেদেরকে প্রকৃতই বিশ্বকর্মার উত্তরসূরী মনে করেন, যাঁরা কাঠের কারিগর। এখানে দুটি তথ্য সামনে আসে —

ক) বিশ্বকর্মা হলেন আদিপুরুষ।

খ) মহাভারতের কর্ণের পালক পিতা অধিরথের বংশ।

এর পক্ষে অবশ্য জোরালো সত্য পাওয়া যায়নি।

সে যাই হোক, প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে, প্রাচীন বৌদ্ধ সাহিত্যে, অর্থশাস্ত্রে, মহাবংশে, পাণিনির রচনায় সূত্রধর কারিগর ইত্যাদির উল্লেখ আছে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য মাণিকরাম গাঙ্গুলির ধর্মমঙ্গল, জগজ্জীবন ঘোষালের মনসামঙ্গল কাব্যে ছুতার, কামিলা ইত্যাদি কারিগরদের সম্পর্কে জানা যায়।বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের ‘ মনসাবিজয় ‘ কাব্যে সূত্রধর, ছুতারদের উল্লেখ আছে। দ্বিজ বংশীদাসের ‘পদ্মপুরাণ’-এ সূত্রধর ও ছুতার  শব্দ প্রায় সমার্থক।

রামদাস আদকের ‘অন্নদামঙ্গলে’, মুকুন্দ দাসের ‘চণ্ডীমঙ্গলে’ সুত্রধরদের কথা রয়েছে। এই সূত্রধর, ছুতার,কাঠমিস্ত্রীদের হাতে তৈরি পুতুল অলঙ্করণের কাজেও লেগেছে। অবিভক্ত বর্ধমানের নতুনগ্রাম কাঠের পুতুলের জন্য সুপরিচিত। এখন পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু জায়গা কাঠের পুতুলের জন্য বিখ্যাত। শিমূলবেড়িয়া, চড়িদা,বাহাদুরগঞ্জ (বিষ্ণুপুর), নাড়াজোল,দেউলি,শ্রীরামপুর, খড়িবাড়ি, রসাগ্রাম ইত্যাদি। তবে আধুনিক সাজ সরঞ্জামে তৈরি পুতুলের চাহিদায় এখন এসব জায়গায় অস্তিত্ব ক্ষীয়মান ক্রমশ। প্লাস্টিকের পুতুল, গালার পুতুল, রবারের পুতুল বাজার দখল করছে। তবে একটা সময় মাটির তৈরি শকুন্তলা, গৌর -নিতাই, বউ পুতুল, রাধাকৃষ্ণ, হর-পার্বতীর চাহিদা ছিল তুঙ্গে। রঙ করা মাটির লক্ষ্মীপ্যাঁচা ঘরে এনে সুখ-সমৃদ্ধি বাড়ানোর চেষ্টা চলত। কুমোরপাড়ায় পুতুলের ছড়াছড়ি ছিল। ভৈরব পুজোর হাতি, ঘোড়া তৈরি হতো। পৌষ সংক্রান্তির দিন মাটির তৈরি এসব লাগবেই। মনসা পুজোর সময় বা দশরের সময় মায়ের কল্পিত মূর্তির প্রয়োজন মেটাতো কুম্ভকারেরাই।বিষয়গত ভাবনার মধ্যে তাঁদের মন মানসিকতার প্রতিফলন ঘটেছে। ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির কথাও তাঁরা ভাবতেন। গ্রাম তো বটেই, নগর-শহুরে জীবনেও পুতুলের চাহিদা ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি পায়।১৯৯৫ সালে জীবানন্দ ভাস্করের শিক্ষকতায় পুতুল কারিগরদের ট্রেনিং স্কুল স্থাপিত হয়েছিল নতুনগ্রামে।কী সুন্দর প্রচেষ্টা ছিল পুতুলকে সৌখিন করে তুলতে তখন। সাধারণ জিনিস কিন্তু ব্যবহার করা হতো অদ্ভূত দক্ষতায়। তেঁতুল বীজের গুঁড়ো, পাট,ময়দার আঠা, হরিতকী, হিঙ্গুল,ভুষো কালি ব্যবহার হতো। পুতুলের চোখ খুব মায়াবী। টানা টানা পটলচেরা বা বাঁশপাতার মতো। নিদ্রালু চোখ।

পদ্মতামলী — বলে পূর্ব মেদিনীপুরে একটি গ্রাম আছে। এই গ্রামটি বেণীপুতুল গ্রাম নামেও পরিচিত। এখানে পুতুলের আবার বিভিন্ন নামকরণ। পুতুল নিয়ে নাচের জন্যই অবশ্য। দস্তানা পুতুল, হাত পুতুল, পাতনাচনা পুতুল, খেঁদিপুতুল এইসব।পুতুল এত জনপ্রিয় যে বাঙালির ঘরে ঘরে মেয়ের নামই রাখা হতো পুতুল। আদর দিয়ে সোহাগ পুষে। বিক্রিবাটার মধ্যে দিয়ে একশ্রেণির মানুষের জীবিকাও নির্বাহ হতো। পুতুল নাচিয়েও কিছু মানুষ রোজগার করতো। পুতুল নাচের কথা বলার আগে আসি সামগ্রিক ভাবে সাংস্কৃতিক দিক থেকে পুতুলের শ্রেণি বিভাগে।কেমন ভাবে ছিল শ্রেণিবিন্যাস! —–

১) টুসু পুতুল ২) ভাদু পুতুল ৩) রাণী পুতুল ৪)আহ্লাদী পুতুল ৫)বৌ পুতুল ৬)ষষ্ঠী পুতুল ৭)লক্ষ্মী পুতুল ৮)হিঙ্গুল পুতুল ৯) ঘাড় নাড়া পুতুল ১০) জৌ পুতুল ১১) যাদু পুতুল ১২) তালপাতার সেপাই পুতুল ১৩) আশ্চর্য প্রদীপ ১৪) বোঙ্গা হাতি পুতুল বেড়াচাঁপা, জয়নগর, -মজিলপুর, ঘূর্ণি,সুভাষগ্রাম,কাঞ্চনপল্লী, রাজনগর, স্যান্দড়া, — প্রভৃতি স্থান উদ্ধৃত শ্রেণিবিন্যাসের সাক্ষ্য বহন করে। বাঁকুড়া বা পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু স্থানে আবার ডোকরা পুতুল দেখা যায়। আসলে লোকায়ত বাংলার লোকজীবনে পুতুল একটা সুস্থ ও সুন্দর সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক বাহক। জনৈক ইতিহাসবিদ্ ও পন্ডিত মন্তব্য করেছেন — ‘ভারতে পুতুল নির্মাণের শিল্পটি অতি পুরাতন। উত্তর – পশ্চিমে বেলুচিস্তান এবং মহেঞ্জোদারো ইত্যাদি অঞ্চলে অসংখ্য মাটির তৈয়ারি পুতুল পাওয়া গিয়াছে। বাংলাদেশে তমলুক, বাঁকুড়ার পোখরানা(প্রাচীন পুষ্করানা)  প্রভৃতি স্থানেও অনেক প্রাচীন পুতুল পাওয়া যায়।দিনাজপুরের বানগড় ও চব্বিশ পরগনার চন্দ্র কেতুগড় অঞ্চলেও খননকার্যের সময়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ অনেক পুতুল পাইয়াছেন।’ একটা সময় ঢাকার রায়ের বাজারের ও চারুকলা শিক্ষক মরণচাঁদ পালের নাম পুতুলশিল্পী হিসাবে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। পুতুল তৈরি একপ্রকার কুটীর শিল্প।ইসলামপুর,বহরমপুর প্রভৃতি স্থানে তৈরি পাটের পুতুলের চাহিদা অনেক। রাস উৎসব উপলক্ষ্যে শোলার পুতুল বেশ বিক্রি হয় জয়নগর, মথুরাপুরে।অন্যভাবে বলা যায়,লোকশিল্পের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে পুতুল বঙ্গ সংস্কৃতির এক অমূল্য সম্পদ।

শুধু কি খেলার অঙ্গ?আচার – অনুষ্ঠান, মানত  করতেও তো পুতুল দরকার হতো। কার্তিক ফৌজদার

মল্লরাজা বীর হাম্বীরের জন্য দশাবতার তাস প্রথম তৈরি করেন।বিষ্ণুপুরের রাসমঞ্চ, মদনমোহন মন্দির, জোড়বাংলা মন্দির, শ্যমরায় মন্দির — এখানে টেরাকোটা পুতুল মুগ্ধ হয়ে দেখতে হয়।বিষ্ণুপুরের হিঙ্গুল পুতুল বয়ে নিয়ে চলেছে প্রাচীন উত্তরাধিকার।

যখনই পুতুলনাচ — শব্দটা শুনি বুকের ভেতর যেন দোল দোলানি। জনসংযোগের এক অপূর্ব মাধ্যম। আবার লোক বিনোদনও।এই সম্বন্ধে বলা যায় —-

   ‘ puppetry is broadly, the conveying of a concept to an audience through the manipulation (i.e.movement by hand, directly or indirectly) of inanimate objects. A limited but more common understanding of the terms has reference to small models of the human form which are used to present plays’.

   শুধু ভারত নয়, তুরস্ক,ফ্রান্স, ইতালি, ইংল্যান্ড, লাতিন আমেরিকা, জাপান, চীন প্রভৃতি বিভিন্ন দেশেই পুতুলনাচ প্রচলিত আছে। মালদহের গম্ভীরা নাচ,জলপাইগুড়ির মুখা নাচ,ছৌ এর মুখোশ নাচ– এসব পুতুলনাচেরই অংশ বললে খুব একটা ভুল হবে কী? পুতুলনাচের অবশ্য নানান প্রকরণ আছে —

দস্তানা পুতুল( Glove puppet), ডাঙ্ বা দন্ড পুতুল ( Rod puppet), সুতোয় টানা পুতুল ( String puppet) এরকম। ছায়াপুতুল, ছড়িপুতুল — একপ্রকারের পুতুলনাচ।পুতুলনাচের ক্ষেত্রে একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য– গান,অভিনয় এবং নাচ, এই তিনটি বিষয়ের সম্মিলন। নাহলে সার্থক রূপ পায় না। অনেক মানুষের জীবিকা নির্বাহের উপায় এই পুতুলনাচ।গ্রামীণ অর্থনীতির সাথে সাযুজ্য থাকে। অনেক মেহনত করতে হয়।একটা শিল্প কিন্তু এভাবেই জীবিত থাকে। দস্তানা পুতুলের মুখ মাটির। ওই মাটি পোড়ানো হয়।তাতে চোখ মুখ,নাক এঁকে নেওয়া হয়।খুব ভারী হওয়া চলবে না। ঝোলায় নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে অসুবিধা। ভিক্ষার মাধ্যম ছিল এই দস্তানা পুতুল। বেণীপুতুল শিল্পীরাই সাধারণত এই পুতুল তৈরি করে। পরে পরে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।সরকারের থেকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে। এখন কাঠের গুঁড়ো, থার্মোকল,পেপার মন্ড দিয়ে তৈরি হয়।মেয়ে পুতুলের হাতে চুড়ি, শাঁখা পরানো হয়।নেলপালিশও থাকে। পুতুলের হাতে ঘুঙুরও বাঁধা হয়।মেয়ে পুতুলের মাথায় একটা ওড়না থাকে, সেটা সংলাপ বা ডায়ালগ অনুযায়ী তার লজ্জার প্রকাশ ঘটাতে সুবিধা হয়।ডাঙের পুতুল তৈরি এত সহজ নয়। হাল্কা কাঠ দিয়ে তৈরি করতে হয়।ঝলমলে পোশাক চাই।পুতুল নাচানোর জন্য  বিশেষভাবে  দক্ষ শিল্পী দরকার। বাদ্যকার ও মাস্টার থাকে। ঐতিহাসিক বা সামাজিক পালা অভিনয়ের জন্য প্রস্তুতি চাই।মূলত, চব্বিশ পরগনা এই পুতুলের প্রতিষ্ঠাভূমি। ডোরের পুতুল বা সুতোয় টানা পুতুল বেশিরভাগ নদীয়াতে দেখা যায়। পুতুলের মুখ ছৌ- এর মুখোশ তৈরির রীতিতেই তৈরি।

মাটির লেই মাখানো ছেঁড়া ন্যাকড়া, কাগজ দিয়ে পুতুলের মুখ, আর শরীরটা তৈরি হয় শোলা দিয়ে। রঙিন পোশাক পরানো হয়। মাঝারি মাপের মঞ্চ,৭-৮ ফুট লম্বা, ৪-৬ ফুট উঁচু, তিন ফুট গভীর। সূত্রধর একসাথে তিন চারটি পুতুলও নাচাতে পারে। এখানেও পৌরাণিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক বিষয়নির্ভর পালা পরিবেশিত হয়।বাদ্যযন্ত্র তো থাকেই।বেণীপুতুল শিল্পী বসন্তকুমার ঘোড়ই খুব সুন্দর একটা মন্তব্য করেছিলেন ——

   ‘ মেয়েরা যেমন তিনগাছা চুল দিয়ে বিনুনি তৈরি করে এবং সেটিকে ইচ্ছেমতো দোলাতে পারে, চাইলে খোঁপা বাঁধতে পারে, এই পুতুলগুলিও তাই। দুটো হাত এবং শরীরটা তিনগাছি চুলের মতো, আবার কাপড়ে ঢাকা শরীর পুরো বিনুনির মতোই দোলে এবং পুতুলটিকে ইচ্ছেমতো গুটিয়ে খোঁপার মতো ব্যাগে ভরে নেওয়া যায় –সেকারণে এই পুতুলের নাম বেণীপুতুল।’ আগে যেটা হাতপুতুল ছিল, এখন সেটাই বেণীপুতুল। এর উদ্ভব সম্পর্কে একটা স্থানীয় মানুষের মধ্যে একটা গল্পকথা শোনা যায় -‘ ইংরেজদের শাসন। ভীষণ অত্যাচার। কখনো ফসলের ক্ষতি করে। কখনো মেয়েদের উপর অত্যাচার। সবাই অতিষ্ঠ। ইংরেজ গ্রামে ঢুকলে দল বেঁধে অন্য গ্রামে আশ্রয় নিতে হতো। এরকমই একদিন গ্রামে ইংরেজরা ঢুকেছে দেখে একজন বৃদ্ধ মানুষ ভয়ে পাশের এক জঙ্গলে ঢুকে পড়লো। জঙ্গলের ভেতর একটা পুকুর ছিল। বৃদ্ধ দেখলো পুকুরের ওপাড়ে একটা সাদাচুলো সাহেব বসে আছে। বৃদ্ধ তো ভয়ের চোটে অস্থির। কিন্তু অনেকক্ষণ বাদেও সাদা মাথাটিকে নড়তে না দেখে বৃদ্ধ কাছে এগিয়ে গেল। গিয়ে দেখে ওটা সাহেবের মাথা নয়,একটা তালের আঁটি। বৃদ্ধ অনেক ভেবে একটা উপায় আবিষ্কার করে, যদি এই তালের আঁটিকে পুতুলের মাথা বানিয়ে চোখ,মুখ,নাক, কান এঁকে দেওয়া হয়, তাহলে তো পুতুলের নাচ দেখিয়ে অনেক মানুষকে খবর দেওয়া যাবে।’ ইংরেজদেরও নাকি পুতুল নাচ দেখাতো আর তারা খুব খুশি হতো। এর ফাঁকে ইংরেজরা গ্রামে ঢুকেছে কিনা খবরও দেওয়া হতো। সেইসাথে পুতুলনাচ দেখিয়ে ইংরেজদের সময়ও নষ্ট করে দেওয়া হতো।’ প্রামাণ্য সূত্র পাওয়া যায় —–

”Glove puppet is made by penetrating the stick of palmyra (Taler ahati). Only the head of puppet is made by mud’.( Chakraborty : 2003: 11)

রাধা-কৃষ্ণ, রাম-সীতার কাহিনী, শিব- দুর্গার গান পুতুলনাচের মধ্য দিয়ে মানুষের কাছে পরিবেশিত হতো। এক-দুটি গানের উল্লেখ করা যায়—-

গঙ্গা ও দুর্গা

দুর্গাঃ —- ও তোর কোন্ গুণেতে যতন করে রেখেছে শূলপাণি

ও তুই বল দেখি লো শুনি,

শুন গঙ্গা লো —

এমন কথা জানি বা না জানি।

গঙ্গাঃ– আমায় শিরে ধরে শূলপাণি পবিত্র হয়েছে।

আমি শুধাই তোর কাছে, শুন দুর্গা লো —

তাই তো তিনি মস্তকে রেখেছে।।

     এখানে দু’হাতে দুটি পুতুল। একজন দুর্গা, অপরজন গঙ্গা। এইজন্যই বুঝি কবির ভাষায় সাহিত্যে ঠাঁই —‘নাচায় পুতুল যথা দক্ষ কারিগরে!’

হাসির গান,সঙের গান সবই পরিবেশিত হতো পুতুল

নাচের মধ্য দিয়ে —-

‘শোন্ বলি ও টেপির মা, তুই কেন মাঠে যাবি না

আর একখান হাল কে ধরবে, বল নাগো বল না।আষাঢ়ের জল পড়েছে’—–

      সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, স্বাস্থ্যচেতনা, সুস্থ সমাজচেতনা,পরিবেশ সচেতনতা– বিভিন্ন বিষয়ও ছিল। তবে এসবের ভেতরেও একটা শৈল্পিক উপলব্ধি তো ছিলই। শিল্পীরা পুতুলের আড়ালে থেকে শিল্পিত উপলব্ধির প্রকাশ ঘটান।’পুতুলনাচের ইতিকথা’য় মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন –

‘ সংসারে মানুষ চায় এক, হয় আর, চিরকাল এমনি দেখে এসেছি ডাক্তারবাবু,পুতুল বই তো মানুষ নই আমরা, একজন আড়ালে বসে খেলাচ্ছেন।’

   পুতুল নাচের মধ্য দিয়ে অনেক কাহিনী পরিবেশন করা হতো। নাটক যাত্রা ইত্যাদির মতো করে। প্রচুর মানুষ ভীড় করে। অনেক সৎ উদ্দেশ্যও সাধিত হয়।বাংলা সাহিত্যেও পুতুল উল্লেখযোগ্য ভাবে এসেছে। সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রফেসর শঙ্কু ও আশ্চর্য পুতুল’ — গল্পটি ভীষণ ভাবেই আকর্ষণীয় পাঠকের কাছে। সুইডিশ একাডেমি অফ সায়েন্স থেকে সাম্মানিক উপাধি নিতে গিয়ে গ্রেগর লিন্ডকুইস্ট নামের একজন ভদ্রলোকের সাথে শঙ্কুর পরিচয় হয়।লিন্ডকুইস্ট বলেন, তিনি একজন শিল্পী, যার বিশেষত্ব বিখ্যাত লোকেদের ক্ষুদ্রাকার কিন্তু অবিকল প্রতিমূর্তি তৈরি করা। শঙ্কুকে আহ্বান জানান। নিজের বাড়িতে আপ্যায়নও করতে চান।প্রফেসর শঙ্কুর মতে, এই মূর্তি বানানো শুধু শিল্প নয়,বিজ্ঞানও।সুকুমার রায় ‘আদুরে পুতুল’–এ লিখেছেন —-

‘মোমের পুতুল ঘুমিয়ে থাকুক দাঁত মেলে আর চুল খুলে –

টিনের পুতুল চীনের পুতুল কেউ কি এমন তুলতুলে?’

‘পুতুল ভাঙা’য়– কবিগুরু এক শিশুর নালিশের  উপস্থাপন। এসেছে পুতুলের কথা —–

‘কোনোরকম খেলার পুতুল

নেই কি,মা ওঁর ঘরে

সত্যি কি ওঁর একটুও মন

নেই পুতুলের ‘পরে?’

শিশুর পুতুল ভেঙে গেলে যে ভারী কষ্ট। জসীমউদ্দিনের বিখ্যাত কবিতা–‘ পুতুল’। কী অসাধারণ লেখা —–

  ‘পুতুল! আমার সোনার পুতুল! আমি পুতুল হব তোমার বরে,

তুমি হবে আমার পুতুল সারাটা দিন কাটবে আদর করে।

তোমায় আমি চাঁদ বলিব,জোছনা দিয়ে মুছিয়ে দিও মুখ,

তোমায় আমি বলিব মাণিক, মালা হয়ে জড়িয়ে দিও বুক।’

পুতুল নিয়ে প্রচুর ছড়া রচিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে,সমাজে, সংস্কৃতিতে পুতুলের একটা সময় অগ্রাধিকার ছিল। আজ অবশ্য অনেকটাই ক্ষয়িষ্ণু। অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে। চর্চা সেভাবে নেই।আগ্রহও হারাচ্ছে। কালের পরিবর্তনে রুচিরও পরিবর্তন ঘটেছে। একটা সময় সাঁওতালি পুতুলনাচ ‘চাদর বাঁধনী’ বা ‘চাদর বাদর এনেচ’ দারুণ জনপ্রিয় ছিল। এখন সেভাবে আর দেখা যায় না। মনহরা পুতুলনাচ হয়ই না বললেই হয়।গরীব-গুর্বো ঘরের ছেলের খেলনা হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন পুতুল। মেলায় পরবে মাঝে মধ্যে চোখে ঠেকে। তবে এই পুতুল যে একটা আবেগ, একটা ভালোবাসা, একটি মধুময় স্মৃতি, এবং  সেইসাথে ইতিহাসও–সেকথা অনস্বীকার্য। বোরহানউদ্দিন খানের মন্তব্য সত্যিই এই পুতুল সম্পর্কে যেন শেষ কথা—–

   ‘ খেলনা পুতুল নি

………………………………………………………………………………………………………………

 

Loading