প্রতিদান
কলমে ✍️: – মধুমিতা দেব
অপ্টোমেট্রিস্ট (রোটারি টেকনো নেত্রালয়)
(১)
“একি তুই?এখানে?”
অবাক বিস্ময়ে তনু তাকিয়ে থাকে রূপার মুখের দিকে।রূপা মানে, ডক্টর রূপাঞ্জনা দেবনাথ। এ তল্লাটের নামী নিউরোলজিস্ট।
রূপাও যথেষ্ট বিস্মিত হয়েছিল ওকে দেখে,তবে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলে,
“কেমন আছিস?” ওর পাশে বসা অয়নও কম অবাক হয়নি, বলে, “তুমি চেনো ম্যাডামকে?”
তনুর তরফ থেকে উত্তরটা রুপাই দেয়।
“আমরা দুজন ছোটবেলাকার বন্ধু,একই পাড়ায় থাকতাম।”
-“বাবু,তিনটে কফি বলে দে না।” রূপা কর্মচারীকে ডেকে বলল।
-“প্লীজ ম্যাডাম,ব্যাস্ত হবেন না আমাদের নিয়ে, বাইরে অনেক পেশেন্ট অপেক্ষা করছে আপনার জন্য।বরং সামনের রবিবার আমাদের বাড়িতে আপনার ইনভিটেশন রইল। কি হলো তনু?তুমি কিছু বলো।”
তনু বোধ হয় বিস্ময় এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি, একটু থতমত খেয়ে বলে উঠলো, “হ্যা হ্যা,চলে আয়, রবিবার।”
-“এতদিন বাদে প্রথমবার আপনাদের সঙ্গে দেখা হলো,এখানে খাতির-যত্ন করার সুযোগ তো আর নেই, এক কাপ কফিই না হয় খাওয়ালাম… আর দাদা, প্লিজ আমাকে ম্যাডাম ম্যাডাম করে বলবেন না, আফটার অল,আপনি আমার বাল্যবন্ধুর বেটারহাফ।”
(২)
তনু আর রুপা,অর্থাৎ তনুশ্রী মিত্র আর রূপাঞ্জনা মুখার্জ্জী,ছোটবেলা থেকে এদের একই পাড়ায় বেড়ে ওঠা,একই সঙ্গে খেলাধুলা।কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতেও পারত না।স্কুল থেকে ফেরার পরে দুজনে দেখা করে তবে বাড়ি ঢুকত। পাড়ায় ওদের দুরন্তপনায় ব্যতিব্যাস্ত হয়ে অনেকেই নালিশ করতো ওদের মা বাবার কাছে,মার-বকুনিও কম খেত না মা-বাবার কাছে, কিন্তু তাতে কি? আবার পরের দিন কারো কলিং বেল টিপে পালিয়ে যাওয়া অথবা সাইকেল, রিক্সার টায়ার পাংচার করে দিয়ে পালানো আরো কত কিছু বদমাইশি, কোনটাই বাদ যেতনা। কিন্তু পাড়ার প্রাণ ছিল এরা দুজনেই। রুপা অপেক্ষাকৃত শান্ত আর একটু সাদাসিধে ছিল।দুজনই খুব সুন্দর গান করত, দুজনেরই গানের গলা ছিল অপূর্ব। পাড়ার যে কোনো অনুষ্ঠানে এদের ছাড়া কিছু হতনা। সবাই ওদেরকে একসাথে তনু-রূপা বলে ডাকত।যদিও তনুর চটকদারিটা একটু বেশিই ছিল,আর তুলনামুলক স্মার্ট ছিল। সে তুলনায় রুপা ছিল,বেশ বোকাসোকা আর ক্যাবলা।
এই বন্ধুত্বে ধীরে ধীরে ফাটল ধরতে শুরু করলো যখন ওরা একটু বড় হল।পড়াশোনায় তনুর চেয়ে রূপা বরাবরই ভাল ছিল।গানের গলাও ছিল তুলনামূলক মিষ্টি।এর থেকেই কিছুটা ঈর্ষান্বিত হতে থাকে তনু।
এইসময় ওরা দুজনেই ‘সুরতাল’ নামে একটা গানের ব্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল। দুজনেই এই ব্যান্ডের সান ছিল। রুপা একটু গম্ভীর প্রকৃতির গান করতে ভালবাসত আর তনু করত হালকা প্রকৃতির গান।তনুর চটুল গান সবাইকে মুগ্ধ করলে রূপার গান এর গভীরতা ছিল অনেক অনেক বেশি।প্রথমদিকে চালাক চতুর তনুর সব কথাই মেনে নিত রূপা।কিন্তু তাতে বাদ সাধল সূর্য।
সূর্য ছিল এই গ্রুপের ই মেল সিঙ্গার।সে বারবার লক্ষ্য করত ছোট ছোট কারনে রূপাকে তনু হেয় করছে কিন্তু রূপা কখনই তার প্রতিবাদ করত না।সবকিছুই যেন সে হাসিমুখে মেনে নিত।ধীরে ধীরে এই মিষ্টি সরল সাদাসিধে মেয়েটার প্রেমেই পড়ে গেল সে।কিন্তু রূপাকে কিছু বলার সাহস পেল না।এদিকে তনুও সূর্যকে নিজের মন দিয়ে ফেলেছে।এরপর এক দিন তনু সূর্যের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করতেই গোলযোগের সৃষ্টি হল।সূর্য সরাসরি তনুকে জানিয়ে দিল,যে ওর মত অহংকারী,হালকাচালের মেয়েকে সে পছন্দ করে না বরং তার বন্ধু সরলমনা রূপাকে সে পছন্দ করে।ব্যাস্….তনুর সম্পূর্ণ রাগ গিয়ে পড়ল রূপার ওপর।সে রূপাকে যাচ্ছেতাই করে অপমান করল, সূর্যের মত ভাল ছেলেকে মিথ্যা প্রেমের জালে জড়িয়েছে,একথা বলতেও ছাড়ল না।রূপার কোন কথা শোনার প্রয়োজনও বোধ করল না।অঝোরে কেঁদে ভাসাল সে। বদনামের ভয়ে গানের রিহার্সালে যাওয়াও বন্ধ করল।
এদিকে রূপাকে ছাড়া ‘সুরতাল’-র যেন সুর কাটতে চলল। ব্যান্ডের সবাই রূপাকে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হল।সামনে নতুন অনুষ্ঠান,রূপাকে ছাড়া কোন অনুষ্ঠান!!!জাষ্ট ভাবা যায় না। কয়েক দিন রিহার্সালে আসার পর রূপা বুঝতে পারল তনুর সাথে অনেকটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।সে নিজেও কারো সঙ্গে বেশি কথা বলত না,চুপচাপ নিজের কাজ করে বাড়ি ফিরে আসতো।একদিন ওদের গীটারিষ্ট রাহুল বলল,”জানিস্, তোর বেষ্টফ্রেন্ড কি বলেছে? “
-“কি?”
-“তোর সাথে এক স্টেজে ও উঠবে না।তাই ওকেই গ্রুপ থেকে বাদ দেওয়া হবে।”
এই একটা কথাই বোধহয় বদলে দিয়েছিল অভিমানী রূপার জীবন।গানের দুনিয়াকে ছেড়ে চলে এসেছিল,মন দিয়েছিল পড়াশোনায়।শত ডাকেও আর কেউ ফেরাতে পারেনি তাকে।প্রিয়বন্ধুর বন্ধুত্বেের প্রতিদান দেওয়ার জন্য ছেড়ে দিয়েছিল তার জমি।
কিন্তু সব গাছ তো আর সব জমিতে হয় না।আর ঈর্ষা কোনদিনও উপরে ওঠার সিড়ি হতে পারে না। কালের স্রোতে হারিয়ে গেল তনুর হালকা মেজাজের চটুল গান।অতিরিক্ত স্মার্ট হতে গিয়ে জড়িয়ে পড়ল উশৃঙ্খল জীবনে।আর উশৃঙ্খল জীবনযাত্রায় নষ্ট হল তার সুন্দর গানের গলা। ধীরে ধীরে শেষ হয়ে গেল ওর ক্যারিয়ার।আর পাঁচটা মেয়ের মতই গতানুগতিক জীবনই হল তার সম্বল।
আজ প্রায় পঁচিশ বছর আগের ঘটনা সামনে এসে যেন চাবুক মেরে গেল তনুকে।সেদিনের সেই মুখচোরা আর ক্যাবলা মেয়েটার মধ্যে এত আগুন ছিল যে তাতে পুরে ছাই হয়ে গেল তনুর অহংকার।
কফির কাপটা কাছে টেনে নিয়ে, তনু অস্ফুটে বলে উঠল,”তুই কত স্মার্ট হয়ে গেছিস রে রূপা….”
………………………………………………………………………………………………………………