অনন্যা
কলমে ✍️: অদিতি মুখার্জী সেনগুপ্ত
সংক্ষিপ্ত কবি পরিচিতি:-কবির জন্ম ২০শে জুন, ১৯৭১ সালে উড়িষ্যা রাউরকেল্লায়। বাবা ও দাদার অণুপ্রেরণায় ও বাংলা ভাষার প্রতি অগাধ ভালোবাসা থেকেই লেখা শুরু। প্রিয় সাহিত্যিক বত্রিশা অণুকবিতার ও রসিকা অণুকবিতার শ্রষ্ঠা ,অর্পিতা কামিল্যার সহযোগীতায় বত্রিশা অণুকবিতার ‘একক পরাগ’ প্রকাশিত হয়েছে।তার লেখা বই “ছোটদের কাণ্ডকারখানা”– কলম সৈনিক সাহিত্য পরিবার থেকে তুলসী জানা স্মৃতি পুরস্কার এবং মরিচীকা প্রকাশনীর বর্ষবরণ উৎসবে সেরা সাহিত্যিক পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছে।
………………………………………………
কিছু কিছু অনুভুতি আজীবন মনের ভিতর দাগ কেটে দেয়, যা অনেক চেষ্টা করেও মুছে ফেলা অসম্ভব। অনন্যা বর্তমানে একটি সরকারী হাসপাতালের একজন সিনিয়র নার্স। তবে এই পদটা অর্জন করতে ওকে কম কাঠ খড় পোড়াতে হয়নি। যথেষ্ট কষ্ট করেই এই পদ মর্যাদার অধিকারিনী হয়েছে।
আজও যখন ওই দিনটার কথা মনে পড়ে যায়, তখন অনন্যা নিজের মনটাকে বেঁধে রাখতে পারেনা। মনটা তখন যেন এক বাঁধনহারা কালবৈশাখী ঝড়। নিজের ঘরে এসে, মেহেগানী কাঠের ফ্রেমে বেলজিয়াম কাঁচের আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে থাকতে, অনন্যা যেন এক স্বপ্নের দেশে ভেসে গেল। এই আয়নাটা অনন্যা বংশ পরম্পরায় পেয়েছে। ওর ঠাকুর্দা বিশ্ব যুদ্ধের সময় ঠাকুমাকে এনে দিয়েছিল আর ঠাকুমার পর বড় বৌমা হিসাবে ওর মায়ের অধীনে ছিল আর ও যেহেতু অবিবাহিতই রয়ে গেল পয়তাল্লিশটা বসন্ত পেরিয়েও তাই ওটা এখন ওর দখলে। আয়নাটার মধ্যে যেন এক অদ্ভূত শক্তি আছে, আয়নার সামনে দাঁড়ালেই মনে হতো যেন সে মনের গোপন তথ্যটা পড়ে ফেলেছে। বাইরে পশ্চিমের আকাশ জুড়ে কালো মেঘ করেছে। একটু পরেই যেন কালবৈশাখীর ঝড় উঠবে। মনে পড়ে গেল দশম শ্রেণীর সেই দিনগুলোর কথা। রায় বাড়ির বিশাল বারান্দায় সুবোধদা দাঁড়িয়ে থাকত, অনন্যা যখন স্কুল থেকে ফিরত তখন। একদিন ফেরার পথে কালবৈশাখীর ঝড় ওঠে, সাথে শিলা বৃষ্টিও আরম্ভ হয়, বেশ আনন্দে ভিজে ভিজে বাড়ি ফিরছিল, তখন সুবোধদা রাগান্বিত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “খবরদার, এভাবে ভিজে ফিরবে না, খুব অশ্লীল দেখায়, কারোর লোলুপ দৃষ্টি তোমার ওপর পড়ুক আমি চাই না। তুমি কেবল আমার। আর হ্যাঁ, কপালে মেরুন টিপ পড়বে, আমার এই পেঁচিটাকে খুব মিষ্টি দেখায়।” তবে উচ্চমাধ্যমিক দেওয়ার আগে, বাবার মৃত্যুর সাথে সাথেই জীবনের সব অঙ্ক ভুল প্রমাণিত হতে লাগল। সুবোধদা কে, রায় কাকু একপ্রকার জোর করেই ডাক্তারি পড়তে বিদেশ পাঠিয়ে দিলেন। যোগাযোগ-এর সুত্র টা বন্ধ হল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খুব কেঁদেছিল অনন্যা। ওর মনে হল আয়না থেকে কেউ বলছে, “স্বপ্ন যেটা দেখেছিলি, পূরণ হতে পারে যদি তোর পোড়া কপাল সম্পূর্ন পুড়ে না থাকে।”
তবে দায়িত্ব বোধ এতটাই প্রখর ছিল যে সেদিন যখন গ্রামে ফিরে সুবোধদা, অনন্যা কে ওর সাথে পালানোর প্রস্তাব দিল, তখন মায়ের পিছু ডাকে সাড়া না দিয়ে উপায় ছিল না। সুবোধ দা, অনেক কটু কথা লিখেছিল হাসপাতালের দারোয়ানের হাতে দেওয়া সেই চিঠিতে। অনেক কষ্টে হজম করেছিল।
তবে আজ হাসপাতালে সিনিয়র ডাক্তার না থাকায় সুবোধ দা-এর ছেলের মাথায় স্টিচ অনন্যাকেই করতে হয়েছিল। আর পরের দিন যখন ঋণ শোধের কথা জানালো সুবোধ দা, তখন অনন্যার ধৈর্য্য-এর বাঁধ ভেঙ্গে গেল, ও বাড়ি ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়াতেই যেন কেউ বলল,”আর, কিছু গোপন না রেখে, জানিয়ে ফেল মনের কথা।”
সুবোধ দা কে সব লিখল, মনের কথা উজার করে, এ কেমন কালবৈশাখী, যা সবকিছু এলোমেলো করে দিল ওর জীবনে। চিঠি লেখা শেষ করে আয়নার সামনে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। কানে কানে কে বলল তোর এক স্বপ্ন ভঙ্গ হলেও, চিরকাল সুবোধের মনে তোর নাম স্বর্ণাক্ষরে খচিত হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে। অনন্যা -এর বুকে দামামা বাজতে লাগল।
চিঠিটা, পড়া শেষ করে, দু ফোটা চোখের জল ফেলে, সুবোধ বলে উঠল, “তোর নাম সার্থক, তুইই অনন্যা। ঈশ্বর তোর মঙ্গল করুন।”