মহাভারত আজও প্রাসঙ্গিক
কলমে:- সোমনাথ মন্ডল
রজঃস্বলা অবস্থায় বা পিরিয়ড চলাকালীন দ্রৌপদীকে চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে ভরা সভায় নিয়ে এসেছিল দুঃশাসন। সবার সামনে শরীর থেকে পোশাক খুলে নেওয়া শুরু করেছিল। অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র তাঁর সুবিচারকেও অন্ধ বানিয়ে নিশ্চুপ হয়ে বসেছিলেন। রাজার তোষামোদকারী মহারথীরা প্রতিবাদ না করে তামাশা দেখছিল। মহাভারতের এই কাহিনী কম-বেশি সকলেই জানেন। দ্বাপর যুগ হোক কলিযুগ; মহাভারতের দ্রৌপদী হোক কিংবা দিল্লির নির্ভয়া কিংবা আর.জি.করের ডাক্তার মেয়েটি, কাহিনী বরাবর একই থেকেছে। শুধু কাহিনির চরিত্রগুলো বদলাতে থেকেছে। তাই আজ বরং আলোচনা করি, এই কাহিনী থেকে কি কি শিক্ষনীয় রয়েছে।
রাজনীতি: ধৃতরাষ্ট্র রাজা হওয়া সত্ত্বেও নিশ্চুপ হয়ে একজন মহিলার সম্মানহানি হওয়ার সাক্ষী থেকেছিলেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপর মত মহারথীরা যেখানে তারা অন্য যেকোনো অন্যায়ের বিষয়েও গর্জে উঠতেন, সেখানে এই বিষয়ে রাজার বিরুদ্ধে যেতে পারেননি। কারণ রাজনীতি তাদের হাত-পা বেঁধে দিয়েছিল। তাঁদের কেউ রাজাকে রক্ষা করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন, কেউ বা রাজার টাকায় নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছিলেন। তাই চোখের সামনে এত বড় অন্যায় ঘটা সত্ত্বেও তাঁরা চুপ ছিলেন। এর থেকে বোঝা যায় যে রাজনীতি তাবড় তাবড় মহারথীদেরকেও পঙ্গু বানিয়ে দেয়।
প্রতিশোধ: মহাভারতে সবচেয়ে নৃশংসভাবে যদি কারোর মৃ’ত্যু হয়ে থাকে, তাহলে সেটা দুঃশাসনের। ভীম দুঃশাসনের হাত-পা ছিঁ’ড়ে নিয়ে বুক চি’রে র’ক্তপান করেছিলেন। বিচার ব্যবস্থা যখন সুবিচার দিতে পারেনা, তখন প্রতিশো’ধই একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমান যুগেও ধ•র্ষকদের একমাত্র শাস্তি হওয়া উচিত যন্ত্র’ণাদায়ক মৃ’ত্যু। ঠিক দুঃশাসনের মত। এমনকি ফাঁ•সিও এদের জন্য ভীষণ ছোট শাস্তি। ফাঁ•সি হল যন্ত্রণাবিহীন ক্ষণিকের শাস্তি। কিন্তু ধ•র্ষক নামক নীচ প্রাণীদের প্রাপ্য হচ্ছে ত’ড়পে ত’ড়পে মৃ•ত্যু। কিন্তু যে আইন নির্ভয়ার একজন আসামীকে দশ হাজার টাকা আর সেলাই মেশিন থেকে ছেড়ে দেয় নাবালক থাকাকালীন ঘটনাটা ঘটাবার জন্য, সেই আইনের থেকে এমন শাস্তি আশা করাই হাস্যকর। সেজন্যেই ভীমও সুবিচারের আশা না করে প্রতিশোধের পন্থাই বেছে নিয়েছিলেন।
পুরুষ: যারা মনে করেন পুরুষ মানেই ধ’র্ষক মানসিকতার, তারা ভুল। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করেছিল একজন পুরুষ, কিন্তু দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষা করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ, তিনিও একজন পুরুষ। প্রতিশোধ নিয়েছিলেন ভীম, তিনিও একজন পুরুষ। একজন নারী যদি পুরুষের কাছে সবচেয়ে বেশি অসুরক্ষিত হয়, তাহলে সে পুরুষের কাছেই সবচেয়ে বেশি সুরক্ষিত। নির্ভর করছে সেই পুরুষটি দুঃশাসন নাকি কৃষ্ণ। ধ•র্ষণের বিরুদ্ধে লড়াইটা নারীর একার লড়াই কখনো ছিলই না। চিরকাল সন্তান তার মায়ের সুরক্ষার জন্য, বাবা তার মেয়ের সুরক্ষার জন্য, ভাই তার বোনের সুরক্ষার জন্য, স্বামী তার স্ত্রীর সুরক্ষার জন্য, প্রেমিক তার প্রেমিকার সুরক্ষার জন্য গোটা দুনিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করে এসেছে। তাই লড়াইটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের লড়াই হোক, পুরুষের বিরুদ্ধে নারীর লড়াই নয়।
কর্মফল: দুর্যোধন-দুঃশাসন এরা ছিল বিকৃতমনা সাইকোপ্যাথ। এরা যে অপরাধ করবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু সেই সভায় সবচেয়ে বড় দোষ ছিল রাজা ধৃতরাষ্ট্রের। রাজার কাজ তার রাজ্যের একজন নারীকে সুরক্ষা দেওয়া। আর তবুও কোনোভাবে অপরাধ ঘটে গেলে সেখানে রাজার কাজ অপরাধীকে চরমতম শাস্তি দেওয়া। রাজা সেদিন পারতেন সেনাদেরকে আদেশ দিয়ে নিজের সুপুত্রদের শাস্তি দিতে। কিন্তু তিনি সেটা করেননি। ফলাফল হিসাবে দুঃশাসন শুধু একা শাস্তি পায়নি, সেই সভার প্রত্যেকে কর্মফল পেয়েছিল যারা সেদিন চুপ করে তামাশা দেখেছিল। কেউ ছাড় পায়নি। সবশেষে রাজাকে তার রাজ্য হারাতে হয়েছিল, পাশাপাশি সন্তানদেরকেও। যে রাজ্য আর সন্তানদের জন্য তিনি সেদিন চুপ ছিলেন, দিন শেষে সেগুলো কিছুই টিকিয়ে রাখতে পারেননি।
মেরুদন্ড: কৌরবদের একশজন ভাইয়ের মধ্যে নিরানব্বই জন দ্রৌপদীর হেনস্থার মজা লুটছিল। শুধু একজন উঠে দাঁড়িয়ে নিরানব্বই জনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল। তার নাম ছিল বিকর্ণ। বেশি কিছু করতে না পারলেও সে নীরব দর্শক হয়ে তামাশা দেখেনি, সভা ছেড়ে বেরিয়ে গেছিল। গোটা পৃথিবীর সবাই মেরুদণ্ডহীন হয়ে গেলেও অন্তত একজন প্রতিবার উঠে দাঁড়ায় শিরদাঁড়া সোজা রেখে। তারাই পৃথিবীর অক্ষরেখা, তাদের জন্যই এখনো পৃথিবী টিকে রয়েছে।
কুরুক্ষেত্র: একজন নারীকে অসম্মান করার জন্য মহাভারতে এমন এক বিভীষিকাময় যুদ্ধ হয়েছিল, যে যুদ্ধ গোটা একটা যুগকে অন্তিম যাত্রার পথে নিয়ে চলে গেছিল। যার নাম কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ। সমস্তটাই শুরু হয়েছিল দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ থেকে। ইতিহাস সাক্ষী আছে, নারীকে অবলা ভেবে যখনই কেউ তাঁর সম্মানে হাত দিয়েছে, তখনই তার পরিণতি মর্মান্তিক হয়েছে। সে মহিষাসুর হোক, রাবণ হোক কিংবা দুঃশাসন।
অতঃপর সারসংক্ষেপ এটাই যে, পৃথিবীতে যতদিন দ্রৌপদীরা থাকবে, ততদিন দুঃশাসনরা জন্ম নিতেই থাকবে। তাদেরকে শাস্তি দেবার জন্য অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের বিচারের অপেক্ষায় থাকলে চলবে না। বরং প্রত্যেককে অর্জুন কিংবা ভীম হয়ে উঠতে হবে। তাতে শতবার কুরুক্ষেত্র হলে হোক।