বসন্ত পঞ্চমী ও সরস্বতী পূজা

বাস্তু আচার্য্য দেবযানী

9051039387

ddebjani63@gmail.com

বসন্ত পঞ্চমী যাকে দেবী সরস্বতীর সম্মানে সরস্বতী পূজাও বলা হয়। এটি একটি উৎসব যা বসন্তের আগমনের প্রস্তুতিকে চিহ্নিত করে।

বসন্ত পঞ্চমীর পিছনে একটি কিংবদন্তী রয়েছে, কাম নামক প্রেমের হিন্দু দেবতার উপর ভিত্তি করে। প্রদ্যুম্ন হলেন রুক্মিনী ও কৃষ্ণের পুত্র যিনি পৃথিবীর সকল মানুষের মধ্যে আবেগকে জাগিয়ে তোলেন। একসময় শিব মহাযৌগিক ধ্যানে মগ্ন ছিলেন তখন তাঁর ধ্যান ভঙ্গ করার জন্য ঋষিরা কাম দেবের কাছে আসেন। সেই সময় পার্বতী শিবকে জাগতিক কামনায় ফিরিয়ে আনার জন্য তপস্যা করছিলেন, কামদেব শিবকে জাগতিক কামনায় ফিরিয়ে আনার জন্য এবং পার্বতীর প্রতি মনোযোগ দেওয়ার জন্য শিবের স্বর্গীয় ধনুক থেকে ফুল ও মৌমাছির তৈরী তীর নিক্ষেপ করেন। ভগবান শিব তাঁর ধ্যান থেকে জাগ্রত হন এবং যখন তিনি তাঁর তৃতীয় চক্ষু খোলেন, তার থেকে একটি অগ্নি গোলক বেরিয়ে কামদেবকে পুড়িয়ে ভস্মে পরিণত করে দেয়। এই উদ্যোগটি হিন্দুরা বসন্ত পঞ্চমী হিসাবে পালন করে থাকে।

দেবী ভাগবত পুরাণ অনুসারে, বিষ্ণুর জিহ্বাগ্র থেকে সরস্বতীর জন্ম। ব্রহ্মা তাঁকে প্রথম পূজা করেন। দেবী সরস্বতী শুক্লবর্ণা, পীত বস্ত্রধারিনী এবং বীনা ও পুস্তকহস্তা। তিনি নারায়ণের থেকে সৃষ্ট হন তাই নারায়ণকে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করেন। পরে তিনি গঙ্গার দ্বারা অভিশপ্ত হয়ে হয়ে পুনরায় শিবের চতুর্থ মুখ থেকে সৃষ্ট হন এবং ব্রহ্মাকে পতি রূপে গ্রহণ করেন।

সরস্বতী হলেন জ্ঞান, সঙ্গীত, শিল্পকলা, বুদ্ধি ও বিদ্যার হিন্দু দেবী। তিনি আকাঙ্খা এবং ভালোবাসা সহ সৃজনশীল শক্তি ও শক্তির প্রতীক। তিনি, সরস্বতী, লক্ষ্মী ও পার্বতী এই ত্রীদেবীর অন্যতম। এই ত্রিদেবীর কাজ হল ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরকে যথাক্রমে জগৎ সৃষ্টি ও পালন করতে সাহায্য করে। মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে সরস্বতী পূজা করা হয়। সরস্বতী পূজার উল্লেখ পাওয়া যায় প্রথম ঋকবেদে।

প্রাচীন হিন্দু সাহিত্যে দেবী সরস্বতী বহু নামে পরিচিত। ব্রাহ্মণী (ব্রহ্মার শক্তি), ব্রাহ্মী (বিজ্ঞানের দেবী), বর্ণেশ্বরী (অক্ষরের দেবী), বীনাবাদিনী (দেবী যিনি বিনা বাজান), দেবী সরস্বতী বিদ্যাদাত্রী (জ্ঞান প্রদানকারী দেবী), হংসবাহিনী ( দেবী যিনি রাজহংসের উপর বিরাজমান), ভরাদি (ইতিহাসের দেবী), বাগ্দেবী (বাক দেবী), বানী এবং বাচী (উভয় সঙ্গীত, গানের প্রবাহ, কথা বলা ও বাকপটু)

বহু অবতারে দেবী সরস্বতী

দেবী সরস্বতীর অনেক অবতার ও রূপ রয়েছে। কাশ্মীর শক্তিপীঠে মহাসরস্বতী, বাসরা ও ভারগালে বিদ্যাসরস্বতী এবং শৃঙ্গেরীতে শারদম্বা হিসাবে পূজীতা হন। কিছু অংশে তিনি সাবিত্রী এবং গায়ত্রী নামেও পূজীতা। সরস্বতী শুধু জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দেবীই নন বরং তিনি নিজেই ব্রহ্মবিদ্যা, চূড়ান্ত সত্যের জ্ঞানের দেবী। তাঁর মহাবিদ্যা রূপ ‘মাতঙ্গী’ এবং ‘‘তারা’’ মহাবিদ্যা রূপে প্রকাশ হয়েছে।

পার্বতী হিসাবে – তিনি ব্রহ্মবিদ্যা, যা চূড়ান্ত সত্য

লক্ষ্মী হিসাবে – তিনি হলেন বিদ্যা লক্ষ্মী

গায়ত্রী হিসাবে- তিনি হলেন বেদের অবয়ব

বিদ্যা হিসাবে – তিনি হলেন সমস্ত দিক থেকে প্রজ্ঞা ও জ্ঞানের নিরাকার ধারণা।

সাবিত্রী হিসাবে – তিনি পবিত্র, ভগবান ব্রহ্মার সহধির্মনী।

মহাকালী হিসাবে – তিনি হলেন অজ্ঞতা, অহংকার, অশিক্ষিত এবং অলসদের মনকে ঘিরে থাকা অন্ধকারের ধ্বংসকারী।

হিন্দু ঐতিহ্যে সরস্বতী বৈদিক যুগ থেকে বর্তমান সময়কাল পর্যন্ত দেবী হিসাবে তাঁর তাৎপর্য বজায় রেখেছিলেন।হিন্দু মহাকাব্য মহাভারতের শান্তি পর্বে

সরস্বতীকে বেদের মা রূপে অভিহিত করা হয়। তৈতিরিয় ব্রাহ্মণ বইয়ে তাঁকে বাকপটু ও সুরেলা সঙ্গীতের জননী বলা হয়েছে।

ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা নামে পূজিতা দেবী সরস্বতী।

ভারতের বেশ কিছু অঞ্চলে যেমন বিন্ধ্য, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ এবং অসমে মহাকালী, মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতী দেবী মাহাত্ম্য পুরানের অংশ।

আসাম, পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরায় বসন্ত পঞ্চমীতে দেবী সরস্বতীর পূজা করা হয়।

বিহার ও ঝড়খন্ডে বসন্তপঞ্চমী সাধারণত সরস্বতী পূজা নামে পরিচিত।

তিব্বত ও ভারতের কিছু অংশে নীল সরস্বতী কখনও কখনও মহাবিদ্যা ‘তারা’র রূপ হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

কাশ্মীরে দেবী উপাসনার জন্য প্রাচীন তীর্থস্থান হল শারদাপীঠ। শারদা (শিক্ষার দেবী সরস্বতী জ্ঞানের দেবী)।

দেবী সরস্বতীকে জৈন ধর্মে জ্ঞানের দেবী হিসাবে শ্রদ্ধা করা হয়। এখানে সরস্বতীকে চার হাত দিয়ে দাঁড়ানো ভঙ্গিতে চিত্রিত করা হয়।

সারা বিশ্বে দেবী সরস্বতীর উল্লেখযোগ্য মন্দিরের মধ্যে রয়েছে গোদাবরী নদীর তীরে জ্ঞানসরস্বতী মন্দির। ব্রাহ্মণী হিসাবে পরিচয়ে গুজরাট, হিমাচল প্রদেশ, রাজস্থান ও উত্তরপ্রদেশ জুড়ে দেবী সরস্বতীর মন্দিরগুলি পরিলক্ষিত হয়। কেরলা এবং তামিলনাড়ুতে নবরাত্রির উৎসবের শেষ তিন দিন অর্থাৎ অষ্টমী, নবমী এবং দশমী দেবী সরস্বতী পূজা পালন করা হয়।

দেবী সরস্বতীর সাথে যুক্ত সবচেয়ে বিখ্যাত উৎসবগুলির মধ্যে একটি হল বসন্ত পঞ্চমীর হিন্দু উৎসব। ত্রিপুরা, আসাম, পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা মন্দিরে গিয়ে সরস্বতী পূজা করে থাকে। বেশিরভাগ স্কুল ও তাদের ছাত্রদের জন্য স্কুল প্রাঙ্গনে বিশেষ সরস্বতীর পূজার আয়োজন করে থাকে। ধর্মপ্রাণ হিন্দু পরিবারে এই দিন শিশুদের হাতেখড়ি এবং ব্রাহ্মণ ভোজন প্রথাও প্রচলিত। সরস্বতী বৈদিক দেবী হলেও সরস্বতী পূজার বর্তমান রূপটি আধুনিক কালে প্রচলিত হয়েছে। তবে প্রাচীনকালে তান্ত্রিক সাধকেরা সরস্বতী সদৃশ দেবী বাগেশ্বরীর পূজা করতেন বলে জানা যায়।

Loading