ছোটো গল্প – প্রতীক্ষা
কলমে – সোনালী মুখার্জী
আড়ুপাড়া,সাঁতরাগাছি,হাওড়া
ও খুকী,ও খুকী আলোটা জ্বালিয়ে দে মা।কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি নে মা।খুকী,কোথায় গেলি মা একবার এদিকে আয় মা।আলোটা জ্বালিয়ে দে মা।
এত বড়ো সূর্য্যটা আলো দিচ্ছে আর তোমার চারিদিকে অন্ধকার। আর হবেই না বা কেন?চোখের মাথা তো খেয়েছো। খক্,খক্,খক্ ওহো আর কাশতে পারছিনে,কেশে কেশে আমার পেট ব্যথা হয়ে গেল।একটু ওষুধ ও কেহ দেয়নি।একদিন এই সংসার আমি মাথায় করে রেখেছি।যার যখন যা দরকার সব সময়ের আগে দিয়েছি।নি জের জন্য তো কিছুই রাখিনি।এমন দিন দেখতে হবে কখনো ভাবিনি।
সুগার ঢুকে দাঁত নিল,মাথার চুল নিল,কান দুটোও নিলে।চোখ নিয়ে তবে ক্ষান্ত হলো।একটু যদি নিজের দিকে দেখতুম আজ তাহলে এমন দশা হতো না।
ও খুকী একবার বিছানার কাছে আয় তো মা,ভিজে ভিজে লাগছে কেন?কোথায়,কোথায় ভিজে?আমলো তুমি তো বিছানায় পেচ্ছাব করেছ।এবার তোমার ষোলো আনা পূরণ হলো।চোখে দেখোনা,কানেও শোনো না।এবার হেগে মুতে খাও।
আমি তোমার কে?দিন রাত খুকী,ও খুকী করে যাও।
একদিন তোমার ভরাভর্তি সংসারে আমার মা কাজ করতো।আজ তো সব গপ্প কথা দাদু।কে বলবে তোমার কেহ ছিল বা আছে।গিন্নী মা গত হবার সাথে সাথেই তোমার দুগ্গতি শুরু।হলো।তোমার কষ্ট চোখে দেখা যায় নে। আমার মা বেধবা ছিল।তোমার সংসারে কাজ করে আমাকে আমার মা বড়ো করলো।একটু ডাগর হতেই তোমরা আমার বে দিলে।মন দিয়ে সংসার করছিলুম আমি। আমার মাও মোলো অসুখে।বহু বছর তোমাদের কোন খোঁজ খবর ছিলোনি আমার কাছে।বড়দা,মেজদা, ছোড়দা,দিদি সবাই কততো বড়ো হলো,চাকরি পেলো।আমার মা ওদের দাদা,দিদি বলতো বলে আমিও দিদি, দাদা বলি। কী ধূমধাম করে সবার বে দিলে।বাড়ি যেনো আলোয় ভরে গেলো।
হঠাৎ করে গিন্নী মা স্টোকে মোলো।ব্যস এই বার কে দেখে। সবাই একে একে তোমাকে ফেলে দূরে দৃরে চাকরী নিয়ে চলে গেলো।দাদু তোমার এমন অবস্হা কেন হলো বলো?তুমি তো কিছুই বলতে চাউনি।কী বলবো বল তো।একটু চা দিবি খুকী? দিচ্ছি গো দিচ্ছি।
বড়ো ছেলে চাকরী নিয়ে বাড়ী ছেড়ে অনেক দূর দেশে যাবার সময় বললো,বাবা তুমি তো আমাদের সাথে ওখানে থাকতে পারবে না আর বাড়ি ছেড়ে তুমি যাবেও না।তার চেয়ে তোমার জন্য কিছু টাকা মাঝে মাঝে পাঠাবো।
ছোট ছেলে বছর দুই পরে সেই এক কথা আমার প্রমোশন হ য়েছে বাবা।ওখানে গিয়ে আমি তো হাত পুড়িয়ে খাবো না।তাই তোমার বৌমাকে সাথে নিয়েই যাবো।
যা বলা তাই কাজ।তুমি ভেবে দেখো,কী করবে।মাঝে মাঝে আমি টাকা পাঠাবো।আমার আর দাদার টাকায় তোমার চলে যাবে।
মেয়ে কে তো অনেক আগেই পার করেছি।তবু জামাই বলেছে বাবা,আপনি আমাদের সাথে চলুন এখানে একা কী করবেন?ওখানে তবু নাতি কে নিয়ে সময় কাটবে।ভালো থাকবেন।আমরা দুজন তো অফিস চলে যাবো।চলুন বাবা।আমি বলেছিলাম, না বাবা রাগ কোরোনা আমি আমার ভিটেতেই মরবো।কাপড়ের ব্যবসা করতাম দিনরাত পরিশ্রম করে এই বাড়ি করেছি,ছেলেমেয়ে মানুষ করেছি।বিনা পণে ছেলেদের বিয়ে দিয়েছি।মেয়ের বিয়ে দিতে অবশ্য আমাকে পণ দিতে হ য়েছিলো।ভালো জামাই পেয়েছি।ছেলেরা নিজেদের পছন্দ মতো বিয়ে করেছে।আমি অনুষ্ঠান করে বৌমা দের ঘরে তুলেছি। কী অপরাধ ছিল আমার জানিনা,আজ আমি একা।
খুকী আমাদের কাজের বৌ সবলার মেয়ে।সেদিন হঠাৎ দাদু দাদু করে চিৎকার করে এলো আমার কাছে।ভীষণ কান্নাকাটিও করলো।দাদু তোমার জন্য আমার ভীষন কষ্ট হ য়।আমি সংসারের কাজ করে চলে আসবো,তোমার দেখাশোনা করবো।যা জুটবে দুজনে ভাগ করে খাবো।
খুকী আসে।ছেলেরা কবার টাকা পাঠিয়েছিল।বাবাকে দেখতে তারা আসেনা।বছর দুই আগে দুই ছেলে দশ হাজার টাকা দিয়ে বললো,বাবা বাড়িটা বিক্রি করে দাও।যা টাকা হবে নাতি নাতনীকে দেবে বাকীটা তুমি বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে ওখানেই থেকে যাবে।তাতে আমি বলেছিলুম তোদের দেওয়া টাকা তোরা নিয়ে যা। আমার চিন্তা তোদের করতে হবে না।ছেলেরা সেই গেছে আর আসেনি।
গিন্নীটা বলতো, নিজেদের জন্য কিছু রাখো।আমরা দুজনে শেষ বয়সে আনন্দে থাকবো।সে তো আনন্দেই চলে গেলো।তবে তার কথা শুনলে ভালোই হতো।
এই নাও দাদু তোমার চা।হ্যাঁরে খুকী,তুই তোর সংসার ছেড়ে কতদিন আমার কাছে আসবি বল তো? কেন গো,তোমার বাড়ি দেখে কেহ বুঝি সেবা করবে বলেছে?না রে তা নয়।আমার সাথে তোর কত কষ্ট।কাল পাড়ার ক্লাবের ছেলেদের ডেকে আনিস তো।
পাড়ার ছেলেরা এলে,সবার নাম জেনে সমর বাবু বললেন,সব থেকেও আজ আমার কিছুই নেই।খুকী যদি দয়া না করতো তাহলে আমি মরেই যেতাম। আমি বলছিলাম,বাড়িটা আমি রামকৃষ্ণ মিশন কে দান করবো।বিনিময়ে আমি যতদিন বাঁচবো তাদের অধীনে থাকবো।তারাই আমার দেখাশোনা করবে।খুকীকে কেহ দেখার না থাকলে খুকী ও ওখানেই চলে যাবে এমন ব্যবস্হা করে দাও বাবা তোমরা।
এই ভাবে আর কষ্ট করতে পারছি না বাবারা।
আজ আমি যে অবস্হায়, সকলকে সেই অসহায় অবস্হায় পরতে হবে তবে এক এক জনের এক এক রকম সমস্যা।আজ যে কিশোর সেই তো হবে পিতা আবার সেই হবে দাদু।তাই প্রতীক্ষায় থাকতেই হবে এই দিনটার।
সমাপ্ত