ভয় প্রদর্শন

✍ শ্রী সুবোধ চন্দ্র সরকার

কবি পরিচিতি —-

ঠিকানা – বেহালা,কলকাতা-৭০০০৫৩,জন্ম – ১৩৬২, ৪ঠা অগ্রহায়ণ (ইং_ ২০শে নভেম্বর, ১৯৫৫) মাতুলালয় মুর্শিদাবাদ জেলার বড়ঞা গ্রামে। পৈতৃক আবাস – বীরভূম জেলার  অন্তর্গত তরুলিয়া গ্রামে৷, পিতা– নারায়ণ চন্দ্র সরকার,   মাতা – বাসন্তী সরকার, শিক্ষা – বীরভূম জেলার তরুলিয়া গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা শুরু। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুচন্দ্র কলেজ (নৈশ) থেকে  সাম্মানিক সহ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন। যোগেশচন্দ্র চৌধুরী কলেজ থেকে আইনে স্নাতক, এবং বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.কম. ডিগ্রি লাভ৷ সাহিত্য জীবন – কলকাতায় লেখা প্রকাশ রবীন্দ্র ভারতী সোসাইটিতে, কড়ি ও কোমল সাহিত্য পত্রিকায়।  সাহিত্য জগৎ প্রকাশনায়   দুইটি গ্রন্থ প্রণেতা “সাহিত্য মঞ্জুরী”  এবং ” ‘কাব্য মঞ্জুরী” বহু সাহিত্য পত্রিকার সাথে যুক্ত এবং লেখা প্রকাশিত৷

……………………………………………………………………………………………………………….

ভয় প্রদর্শন

চিরঞ্জিত এখন  খুশি কারণ তাদের দাম্পত্য জীবন খুবই সুন্দর হয়েছে। স্ত্রী হিসাবে আশালতাকে পেয়ে খুব খুশি। দুজনে খুব আনন্দের সঙ্গে দিন কাটাচ্ছে। চিরঞ্জিতের বাবা মধুসূদন এবং মা মেনকাও বৌমাকে পেয়ে খুব খুশি। চিরঞ্জীত ভাবতেই পারেনা যে তার জীবনসঙ্গিনী এত সুন্দর হবে। রূপে গুনে সবদিকেই আশা লতা চিরঞ্জিতের কাছে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে।  বন্ধুরা বলাবলি করে কিরে আশালতার কথায় পঞ্চমুখ, আগের  কথা গুলো একেবারে ভুলে গেলি  ? এই কথাই যেন তার কাল হলো, চিন্তা করতে লাগলো তার পূর্ব জীবনের কথা চিরঞ্জিত রেনুকা কলেজে একই ক্লাসে পড়তো। জানিনা কিভাবে তাদের আলাপ হয়েছিল।

 অল্প দিনের মধ্যেই তাদের নির্ভরতা বেড়ে গেল। উভয়ে উভয়ের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। স্টাডি রুমে ক্যান্টিনে জোড়ায় জোড়ায় তাদের দেখা যেতে লাগলো। তারপর চলল প্রেম পত্র লেখালেখি। পালা করে প্রতিদিন একটা করে প্রেমপত্র দেওয়া-নেওয়া শুরু হল। প্রেমপত্রের প্রথম প্রথম চিরঞ্জিত রেনুকা কে লিখতো পৃথিবীর সবকিছুকে ভুলে গিয়ে প্রেম করলে যেমন হয় ঠিক সেই রকম।কোনরকম রাখ ঢাক না রেখে মনের সব কথা উজাড় করে চিঠি লিখতো।রেনুকা একটু চাপা স্বভাবের ছিল, চিঠির উত্তর  সহজভাবে  দিত। একদিন চিরঞ্জিত লিখল প্রিয়ে তোমাকে না জানিয়ে আর পারলাম না, আমার কাছ থেকে তোমাকে কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না, তোমাকে আমার সারা জীবনের সঙ্গিনী করতে চাই। রেনুকা হ্যাঁ বা না কিছুই লেখে নাই চিঠিটা অন্য ভাবে নিয়েছে। এইভাবে কলেজ কাল অতিবাহিত হল। চিরঞ্জিত একটা ভালো চাকরি পেল রেনুকা একটা চাকরি পেয়েছিল। এরপর চিরঞ্জিত রেনুকা কে বিয়ের প্রস্তাব দিল। কিন্তু রেনুকা তার বাবার মতের বিপরীতে বিয়ে করতে রাজি নয় জানালো।  আগেই বলেছি ও একটু বাবার প্রিয় ছিল। চিরঞ্জিত বলল ঠিক আছে তাহলে আমি তোমার বাবার কাছে প্রস্তাব পাঠাবো। রেনুকার বাবা একজন ডাক সাইটে অফিসার। চিরঞ্জিত তার মামার মারফত রেনুকার বিয়ে প্রস্তাব রেনুকার বাবার কাছে পাঠালো। কিন্তু এ কথা শুনে রেনুকার বাবা হেসে উড়িয়ে দিল। তার মেয়ে এরকম কিছু করতেই পারেনা। ওর বিয়ে আমি আমার বন্ধুর ছেলের সাথে ঠিক করে রেখেছি। আপনার ভাগ্নেকে বলে দেবেন যেন বামন হয়েচাঁদে হাত দিতে না যায়।এই কথা শুনে যখন চিরঞ্জিত রেনুকার অফিসে দেখা করতে গেল চিরঞ্জিতকে পিয়ন মারফত বলেছিল দেখা করার সময় নেই এবং এভাবে যেন ও আর না আসে।

চিরঞ্জিত অত্যন্ত হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল তার জীবনে এইরকম একটা অভিশাপ আসবে ভাবতে পারেনি।চিরঞ্জিতের বাবা মা সবটা না জানলেও কিছু কিছু জেনেছিল। চিরঞ্জিতের বাবা তার এক বন্ধুর মেয়ে অত্যন্তভদ্র শিক্ষিত এবং সুন্দরী আশালতার সঙ্গে বিয়ের যোগাযোগ করলো।চিরঞ্জিত প্রথমে বাধা দিল কিন্তু মা এবং বাবার পীড়াপীড়িতে অবশেষে রাজি হয়েছিল এবং আস্তে আস্তে অতীতের কথা ভুলে গিয়েছিল। বন্ধুদের কথা শুনে আবার পুরনো স্মৃতি নাড়া দিয়ে উঠলো।

 বেশ দিন গুলো কাটছিল, একদিন অফিস ছুটির পর খুব দরকারি কাজে চিরঞ্জিত পাশের একটা শহরে গিয়েছিল। আসার সময় দেখল একটা দোকানের সামনে খুব ভিড় জমে গেছে, একটা মেয়ে নেশা করে চিৎকার চেঁচামেচি করছে রিক্সাওয়ালা কে বকছে এ তূমি আমাকে কোথায় নিয়ে এলে আমি তো এখানে আসবো বলিনি, রিক্সাওয়ালা বলছে ,ম্যাডাম আপনি এই জায়গার কথাই তো বলেছিলেন। রিক্সাওয়ালা কাচুমাচু করে কথা বলছে মেয়েটি চিৎকার করেই চলেছে। কৌতুলবশত চিরঞ্জিত সেখানে গিয়ে অবাক হয়ে দেখল মেয়েটি আর কেউ নয় তার প্রাক্তন প্রেমিকা রেনুকা। একটু সামনে থেকেই রেনুকা চিরঞ্জিতকে দেখতে পেল। রেনুকা প্রথমে অবাক হয়ে যায়, তারপর বলে চিরঞ্জিত   ,তুমি এখানে কেন? রিক্সাওয়ালা কেমন আমাকে হেনস্তা করছে দেখ।চিরঞ্জিত রেনুকাকে শান্ত করার জন্যই রিক্সাওয়ালাকে তার ভাড়া মিটিয়ে দিল এবং রেনুকাকে বলল ঠিক আছে আমি এসে গেছি, তোমার কি প্রবলেম বল। চিরঞ্জিত রেনুকা কে বলল আমায় ঠিক করে বলো কোথায় যাবে। রেনুকা তার গন্তব্যস্থলে নাম বলল। চিরঞ্জিত একটা ট্যাক্সি ডাকলো এবং বলল উঠে পড়ো তারপরে ট্যাক্সি ওয়ালাকে সেই স্থানে যেতে বললো। ট্যাক্সি চলতে শুরু করল ট্যাক্সির মধ্যে রেনুকা চিরঞ্জিতের হাত ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলো। বলল চিরঞ্জিত খুব ভুল হয়ে গেছে তোমাকে বিয়ে না করে। আজ আমি এক অভাগা নারী। আমার স্বামী একটা কঠিন অসুখে ভুগছে ,  প্রচুর পরিমাণে মদ খেয়ে লিভার খারাপ হয়ে গেছে, আমাকেও ছাড়েনি আমাকেও মত ধরিয়েছে, এখন আমি অথই জলে পড়েছি। ওর একটা অপারেশন করতে হবে অনেক টাকার দরকার আমি নিজে কি করব ভেবে পাচ্ছিনা। তাই একটু বেশি নেশা করে ফেলেছি। যাক তুমি কেমন আছো তুমি সুখি তো। এক নিঃশ্বাসে কথা  বলে রেনুকা থামল। চিরঞ্জিত বলল ঠিক আছে এখন শান্ত হও পরে দেখা যাবে কিছুক্ষণ যাওয়ার পর ট্যাক্সিওয়ালা থামলো বলল এসে গেছি। ট্যাক্সি থেকে ওরা নেমে পড়ল এবং রেনুকাকে বাড়ির মধ্যে এগিয়ে দিল। সেদিন কি হয়েছিল  জানে না চিরঞ্জিত তার পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে তার হাতে গুঁজে দিয়েছিল। তারপর চিরঞ্জিত বাড়ি  চলে এসেছিল। মনে মনে ভাবছিল যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়, ভাবতে ভাবতে ফিরে এলো কাউকে কোন কথা বলল না।

 দিন কয়েক পার হয়ে গেল। চিরঞ্জিত সব  ভুলতে বসেছিল হঠাৎ দুপুরে একটা ফোন এলো ফোনটা আশা লতা ধরে এবং চিরঞ্জিতকে বলে তোমার একটা ফোন কোন এক ভদ্রমহিলা করেছে। ফোন তুলে অবাক হয়ে গেল। ফোন করেছে রেনুকা বলছে চিরঞ্জিতদা, আমি রেনুকা বলছি আমি নিরুপায় হয়ে তোমাকে ফোন করছি সেদিন তোমাকে সব কথা বলেছি আমি তোমার কাছে সাহায্য চাই যদি তুমি দুই লাখ টাকার ব্যবস্থা করে দাও তাহলে খুব উপকার হয় তোমার টাকা শোধ করে দেবো । চিকিৎসার সব প্রেসক্রিপশন এর ছবি পাঠালাম টাকার দরকার তোমার কাছে দু লাখ টাকা সাহায্য চাইছি।

 ফোন পেয়ে চিরঞ্জিত হ্যাঁ কি না বলবে বুঝতে পারছে না আশালতার সামনে দাঁড়িয়ে কিছু না বলে তোমার সঙ্গে পরে কথা বলবো বলে ফোন রেখে দেয়।  চিরঞ্জীতের মুখখানা যেন কেমন হয়ে গেল। বারবার জিজ্ঞাসা করছে কি হয়েছে কেন এরকম হয়ে গেলে কেন। কিছু হয়নি বলে চিরঞ্জিত বলল এক বন্ধু অসুস্থ তাই ফোন করেছিল।পরের দিন আবার চিরঞ্জিত ফোন পেল রেনুকা আবার ফোন করেছে দেখো চিরঞ্জিতদা তোমাকে বারবার বলছি আমাকে যেভাবে টাকাটা হোক যোগাড় করে দাও,তুমি না পারলে আমায় অন্য রাস্তা দেখতেহবে।চিরঞ্জিত বলল এত টাকা আমি কোথায় পাবো? ঠিক আছে দিতে হবে না তোমার ঠিকানা ও আমার কাছে আছে তাহলে তোমার লেখা চিঠিগুলো আমার কাছে।আমি নষ্ট করে দিয়েছিলাম বলে তোমায় বলেছিলাম কিন্তু এই চিঠিআমার এত উপকারে লাগবে ভাবতে পারিনি। তুমি কি করবে দেখো যদি রাজি না হও তাহলে আমাকে অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। তুমি আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে পারবে। আমি বুঝতে পারিনি যে তুমি এইভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারবে। আমি বিশ্বাস করতে পারিনি আমি তোমার মত মেয়েকে ভালোবেসে ছিলাম। আমি এসব জানি না আমার টাকা চাই বলল রেনুকা।

 আবার ফোন পেয়ে চিরঞ্জিত যেন আশালতার কাছে অন্য মানুষ তাকে সহজ কথা বলে না তার সঙ্গে স্বামী স্ত্রীর আচরণ ভুলে যাচ্ছিল। আশালতা চিরঞ্জিতকে বলল তোমাকে বলতেই হবে তোমার কি হয়েছে, কে ফোন করেছে? কেন তুমি এমন করছ বলো বলতেই হবে। নিরুপায় হয়ে চিরঞ্জিত সব কথা আশা লতাকে বলে। এই কথা এইজন্য তুমি আমার সঙ্গে এরকম করছ আমি আছি তোমার কোন ভয় নেই। আমার দাদাকে বলে খোঁজ নেব। সত্যিই ওর স্বামী অসুস্থ কিনা দরকার হলে টাকা দিয়ে চিঠি গুলো নেব।অতীত অতীত past is past তোমার কোন ভয় নেই আমি তোমারই তোমাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমার। যেমন তুমি আমার রক্ষাকর্তা। তুমিও সব ভুলে যাও বলে আশা লতা সান্ত্বনা দিতে লাগলো। চিরঞ্জিত বলল তুমি এত ভালো,এখন ভাবছি আমি মানুষ চিনতে ভুল করেছি। কাচ কে হীরে ভেবেছি, আশালতার হাত দুটো চেপে বলল আমাকে বাচালে।

……………………………………………………………………………………………………

 

 

 

Loading