পিতৃ তর্পণ ও মহালয়ার তাৎপর্য

প্রফেসর ডক্টর কুশল সেন

অধ্যাপক (ফলিত সংখ্যাতত্ত্ব), Astrological Research Institute of Krishnamurti Paddhati (ARIKP)

সদস্য, মার্গদর্শক মন্ডল, ভারতীয় বৈদিক জ্যোতিষ সংস্থানম্‌, বারানসী

e-mail :  kooshoeg@gmail.com

মহামিলনের উৎসব এবং মহাশক্তির জাগরণের ঐকান্তিক আরাধনা – শারোদৎসবের সাথে, মহালয়ার পিতৃতর্পণের দিনটির আলাদা মাহাত্য রয়েছে। পিতৃতর্পণ – প্রিয়জনের বিয়োগ ও বেদনার প্রকাশ এবং শারোদোৎসব হল – দেবী দুর্গার মাতৃরূপের আরাধনার মাধ্যমে বিজয় উৎসব পালন। ‘তর্পণ’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ জল প্রদান করা। শাস্ত্রে উল্লিখিত আছে, তর্পণ হল এমন এক যজ্ঞ যাতে পিতৃপুরুষের জন্য আহুতি দিয়ে তাদের আত্মার তৃপ্তিসাধন এবং ফলশ্রুতি স্বরূপ তর্পণকারী ব্যক্তিকে পিতৃপুরুষ সুখ ও অনাবিল জাগতিক স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান করেন। ‘মনুস্মৃতি’ গ্রন্থে তর্পণকে পিতৃযজ্ঞের সমান মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে।

তর্পণের সংজ্ঞা ও তর্পণযোগ্য পিতৃপুরুষ – ‘তৃপ্যান্তি পিতরো যেন তৎপনয়’ অর্থাৎ মৃত পিতৃপুরুষ যে বস্তু প্রদানে প্রসন্ন হন তাকেই তর্পণ বলে। আমদের নিজস্ব বংশজাত মৃত পিতৃপুরুষের দেহে যে আত্মার অবস্থান ছিল বর্তমানে তাঁরা যে শরীরেই থাকুন না কেন, সেই শরীরেই শাস্ত্রোক্ত জলক্রিয়া ও শ্রাদ্ধকর্ম দ্বারা তিনি তৃপ্তিলাভ করে থাকেন। কারণ তর্পণের ফলে, তর্পণযোগ্য দ্রব্যের সূক্ষ্ম পরমাণু মন্ত্র বলে তাঁর বর্তমান দেহের ভক্ষ্যবস্তুর পরমাণুর সাথে মিশে যায়।

কালের অববাহিকাতে আর্য ঋষিরা তাঁদের দূরদৃষ্টিতে ভবিষ্যতের ধ্বংসের পরিণাম দর্শন করেছিলেন এবং বেদের যুগে মঘা নক্ষত্রে বিষুব মিলনকালীন সূর্যকেই পিতৃগণ নামে স্তব ও আরাধনা করেছিলেন। তারপরে অতীতকালের কোন এক ভাদ্রমাসের অমাবস্যার   ১৪ দিন পূর্ব থেকে, সূর্যের উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য প্রদান করে পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে উপাসনা প্রথার প্রচলন করেছিলেন। পরবর্তীকালে ‘পিতৃগণ’ নামধারী সূর্যার্ঘ্য দান, পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণে রূপান্তরিত হয়েছে। বেশীরভাগ শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিতের মতে; প্রতি বছরের ভাদ্র মাসের পুরো কৃষ্ণ পক্ষটিই ‘পিতৃপক্ষ’ যা সাধারণতঃ ১৪ দিনের অবধিকাল

মহালয়াতে পিতৃশ্রাদ্ধের পুণ্যতাবৃদ্ধি – কপিল মুনি রচিত সাংখ্য দর্শণ এর মতে প্রকৃতি থেকে এই জগৎ সৃষ্টির প্রথম ব্যক্ত রূপ হলেন ব্রহ্মা, যাঁর দার্শনিক নাম ‘মহান’। এই ‘মহান’ থেকেই অহংকার, মন, পঞ্চভূত, ইন্দ্রিয় সবকিছু একের পর এক সৃষ্টি হয়। তেমনই যখন কারোর মৃত্যু হয় বা ‘লয়’ হয় তখন বিপরীত প্রক্রিয়ায় মন সহ সমস্ত ইন্দ্রিয় একে একে পঞ্চভূতে লীন হয়, পঞ্চভূত হচ্ছে (ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম), পঞ্চতন্মাত্রে (শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ) বিলীন হয়, তা পুনরায় বিলীন হয় অহংকারে। অবশেষে অহংকার বিলীন হয় ‘মহান’এর মধ্যে। এখানে বিলীন হওয়া মানেই মৃত্যু। হয়তো সেই কারণেই মানুষে ‘ব্রেন ডেথ’ না হওয়া পর্যন্ত মৃত্যু ঘেষিত হয় না।প্রসঙ্গত বলা যায় মহানের মধ্যে লয়প্রাপ্ত হওয়াটাই ‘মহালয়া’ যা থেকে এসেছে স্ত্রীলিঙ্গতে ‘মহালয়া তিথি’।

মহালয়া তিথিতে, ভগবান ব্রহ্মার নির্দেশে আমাদের প্রয়াত পিতৃ পুরুষেরা সূক্ষ্মদেহে নেমে আসেন মর্ত্যভূমির পরিমন্ডলে। অর্থব বেদে উল্লিখিত আছে – ‘বিধু ঊর্ধ্বভাগে পিতরো বসতি’ অর্থাৎ চন্দ্রের (সংস্কৃত অর্থে বিধু এর অর্থ চন্দ্র) অপরপৃষ্ঠে যা পৃথিবী থেক দৃশ্যমান নয়, তাতে আমাদের পিতৃপুরুষরা বিরাজ করেন। মহালয়ার দিন প্রয়াত পিতৃপুরুষদের মহান (বিশাল) সমাবেশ (আলয় বা আবাস) অন্তরীক্ষে তৈরী হয় বলেই দিনটির নাম ‘মহালয়া’। মহালয়াতে শ্রাদ্ধ করাটা এতই পূর্ণ্যকর্ম যে, এই শ্রাদ্ধে নাকি গয়ায় গিয়ে শ্রাদ্ধ করার ফল মেলে। কিন্তু মহালয়ার সার্বিক বিশিষ্টতা হল ‘তর্পন’।

তাত্বিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পিতৃপুরুষকে অর্ঘ্যদান ও স্মরণ করা হলেও তর্পণের অন্য এক মাহাত্ম্য আছে।বৈদিক আর্য ঋষিরা এই পিতৃপুরুষের তর্পণের মাধ্যমে নিজস্ব আত্মার শুদ্ধিকরণ করতেন ও তথাকথিত ইহলোক ও পারলৌকিক শাপ থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে পেয়েছিলেন।

Loading