অধ্যাত্মিক দর্শনে ‘নবকলেবর

প্রফেসর ডক্টর কুশল সেন

অধ্যাপক (ফলিত সংখ্যাতত্ত্ব), Astrological Research Institute of Krishnamurti Paddhati (ARIKP)

সদস্য, মার্গদর্শক মন্ডল, ভারতীয় বৈদিক জ্যোতিষ সংস্থানম্‌, বারানসী

e-mail :  kooshoeg@gmail.com

পদ্মপুরাণে কথিত আছে, আদিকালে জগন্নাথ দেব নীলমাধবরূপে আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত ভিল উপজাতিদের দ্বারা পূজিত হতেন। আবার স্কন্দপুরাণ মতে পূজিত হতেন শবরদের দ্বারা। ঐতিহাসিকদের অনুমান হল- এই ধরণের মূর্তি নির্মাণ (অসম্পূর্ণ ও বিকৃত মূর্তি নির্মাণ) ও পূজা অঙ্গরাজাদের সমসাময়িক আমলের ঘটনা।

পরবর্তী সময়ে ইতিহাস একটু অন্যদিকে মোড় নেয়। ভারী পাথরে নির্মিত মূর্তির পরিকল্পনা বাদ দিয়ে হালকা দারুনির্মিত মূর্তি নির্মাণের কথা ভাবা হতে থাকে, যার মূলেও অবধারিত ভাবে ছিল শবরদেরই উপস্থিতি। কারো কারো মতে শঙ্করাচার্যের নির্দেশ মতোই এই দারুমূর্তি নির্মিত হয়। হালকা কাষ্ঠ নির্মিত এই মূর্তিকে নিরাপদে রাখতে রাজা শবর উপজাতিদেরই এক গোষ্ঠীকে নিয়োগ করলেন যাদের হাতে রইল মূর্তিটির যাবতীয় রক্ষণাবেক্ষণের ভার (মূর্তি নির্মাণের সময়কাল, সোমবংশীয় রাজা প্রথম যযাতি কেশরী, মতান্তরে দ্বিতীয় ভানুদেবের আমলে)।

প্রভু জগন্নাথ সর্বধর্মেরই দেবতা- মূর্তি নির্মাণ থেকে মূর্তির নিরাপত্তা সর্বক্ষেত্রেই প্রভু জগন্নাথ হলেন তথাকথিত নিম্নবর্গের মানুষের যার প্রভাব দেখা যায় পরবর্তী পর্যায়ের জগন্নাথ মন্দিরের নানা ধরণের অনুশাসন ও পূজার রীতিনীতিতে!

পণ্ডিতেরা জানিয়েছেন শবরদের তৈরি পূজোর রীতিনীতির সঙ্গে বৈদিক পূজো পদ্ধতি যুক্ত হয়েই, প্রভু জগন্নাথের পূজার রীতি নিয়ম তৈরি হল এবং লৌকিক দেবতা থেকে জগন্নাথদেবের উত্তরণ ঘটল বৈদিক দেবতায়। এছাড়া আর্যদের তরফে অনার্যদের হেয় জ্ঞানে ডাকা ‘দৈত্য’ শব্দটিরও পরিবর্তিত হল ‘দয়িত’ বা ‘দয়িতা’তে। অনবসর সেবা, রথযাত্রা ও নবকলেবরে তাদের এল পূর্ণ অধিকার।

জগন্নাথ মন্দিরের ক্রিয়ান নীতি- আর্য ও অনার্য সংস্কৃতি মিশ্রিত জগন্নাথ মন্দিরের ক্রিয়া সকল হয়ে গেল যথাক্রমে এইরকম- দেবালয়ের ক্রিয়াকর্ম আর্য বা বৈদিক ধারায়; নবকলেবর এর সময় বনজ কর্ম উপজাতি প্রথায়৷ শক্তিপূজা দেবী মঙ্গলা তথা উপজাতি ধারায়। মন্দিরের অনুষ্ঠান ও সেবায়েত ক্রিয়াকর্ম উপজাতি ও বৈদিক ধারায়। মন্দির ও পথে ক্রিয়া আচার অনুষ্ঠান শবর ধারায়।

এমনকি, স্নানযাত্রার সময় ব্যবহৃত মন্ত্রটি বৈদিক হলেও প্রথাটি কিন্তু শবর নীতি মেনেই করা হতে থাকল। যে নিয়মটি আজ অবধি চালু রয়েছে। তাই দেখা যায়, প্রভু জগন্নাথের জগতের ঈশ্বর হয়ে ওঠার কাহিনী সামাজিক ক্রমবিবর্তনের ধারাপ্রবাহ মেনেই প্রতিষ্ঠিত সত্য।

ওড়িয়া সাহিত্যে জগন্নাথদেবের স্থান- ওড়িয়া সাহিত্যে এমন সব রোমহর্ষক জনপ্রিয় কাহিনী প্রচলিত রয়েছে যেগুলি বিশ্লেষণের পরে সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, জাত-পাতে বিভক্ত আমাদের ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় প্রভু জগন্নাথ দেবই হলেন সাম্যবাদের মূর্ত প্রতীক। এমনই একটি বাস্তব ঘটনার অবতারণা করা হল। ঘটনাটি আজ থেকে বহুদিন আগেকার হলেও তার যথর্থতা আমাদের একবিংশ শতাব্দীর যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞাননির্ভর আধুনিক জনমানসেও সাড়া জাগায়।

কাহিনীটি হল- উক্ত নামের জনৈক এক ভদ্রলোক জাহাজ নিয়ে যাচ্ছিলেন কোলকাতা থেকে পণ্ডিচেরী। সমুদ্র উপকূলবর্তী ভূমি থেকে দুই মাইলের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছিল তাদের জাহাজ; যার মধ্যে ভারতীয়রা ছাড়াও অনেক ইউরোপীয় যাত্রীরা ছিল। এমতাবস্থায় জাহাজের ক্যাপ্টেন হঠাৎ শক্তিশালী দূরবীণ দিয়ে দিকচক্রবালটি পর্যবেক্ষণ করতেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। তিনি দেখতে পেলেন দূর থেকে এক বিশাল তিমি প্রচণ্ড গতিতে হাঁ করে এই জাহাজের দিকে ছুটে আসছে। সেই সঙ্গে আকাশ কালো করে আসছে এক ভয়ানক সামুদ্রিক ঝড়। অভিজ্ঞ নাবিকও বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন, টেনশন এর মধ্যে তার হাত-পা কাঁপতে লাগল। এমন সময় তিনি দেখতে পেলেন এক ভারতীয় একটি অদ্ভূত ছবির সামনে বসে হাতজোড় করে প্রার্থনাতে ব্যস্ত। জানতে পারলেন ওই অদ্ভূত ছবিটি প্রভু জগন্নাথ দেবের।

একটু অনিচ্ছাসত্ত্বেও জাহাজের ক্যাপ্টেন বাধ্য হয়ে বললেন, ‘যদি এই ভয়ানক বিপদ থেকে তোমার এই দেবতা আমাদের উদ্ধার করতে পারেন তাহলে, ফ্রান্সের যে ঘন্টাটি আমি পণ্ডীচেরীর গীর্জার জন্য নিয়ে যাচ্ছি সেটি ওই জগন্নাথ দেবের মন্দিরে পুরীতেই উৎসর্গ করব।’ অল্পক্ষণ পরেই জাহাজটির নাবিক আবার দূরবীণের কাঁচে চোখ লাগিয়ে একদম স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তিনি দেখলেন, তিমি ও ঝড় উভয়েই যেন কোন এক জাদুবলে উধাও হয়ে গেছে। উপরে আকাশও একদম পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন, নেই কোন কালো মেঘ। জাহাজের ক্যাপ্টেন নতমস্তকে স্বীকার করলেন প্রভু জগন্নাথের অলৌকিক ক্ষমতা। তার কথামতো প্রভু জগন্নাথদেবের পুরীর মন্দিরে উৎসর্গ করলেন; যেটি আজও এত বছর পরেও স্বচক্ষে সকলেই প্রত্যক্ষ করতে পারেন। মন্দিরের পশ্চিমদ্বার সংলগ্ন নীলাদ্রি বিহারে আজও তা সযত্নে সুরক্ষিত আছে।

কিন্তু মূল্যবান প্রশ্নটি হল- ‘প্রকৃত ঐতিহাসিক চিহ্ন বহন করা এই উপরোক্ত ঘটনাটি কিছুটা হলেও আমাদের কি একটু অন্যরকম ভাবে ভাবতে বাধ্য করায় না?’ সবটাই কি কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দেওয়া যায়?’

জগন্নাথদেবের নবকলেবর- নবকলেবর নিয়ে সারা পৃথিবীর জগন্নাথ প্রেমী ভক্তদের মধ্যে প্রভূর উৎকণ্ঠা থাকে। আনুমানিক প্রতি বারো বছর অন্তর শ্রীজগন্নাথদেবের দারু বিগ্রহ পরিবর্তন করা হয়। পুরাতন বিগ্রহকে পুরীর ‘কৌহলী বৈকুণ্ঠ’ নামক স্থানে সমাধি দিয়ে মন্দিরে শ্রী জগন্নাথ দেবের বিগ্রহের ‘ব্রহ্মবস্তু’-কেও পরিবর্তন করা হয়। ব্রহ্ম বস্তুই জগন্নাথ বিগ্রহের ব্রহ্মসত্তার প্রতীক। একটি ছোট পুঁটলির ভিতরে কিছু গোপন বস্তু সংরক্ষিত থাকে। তাতে কি আছে, কেউ জানে না। সেই ব্রহ্ম বস্তু জগন্নাথদেবের পুরাতন বিগ্রহ থেকে নতুন বিগ্রহে প্রতিস্থাপন করা হয়। এই প্রতিস্থাপনকেই ‘ব্রহ্মা-পরিবর্তন’ বলা হয় যা নবকলেবরের সঙ্গে ব্রহ্ম পরিবর্তন অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত রয়েছে।

ব্রহ্মবস্তু পরিবর্তন- এই উল্লেখযোগ্য ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রয়েছে এক গূঢ় আধ্যাত্মিক দর্শন। ‘ব্রহ্ম বস্তু’ কোন বস্তু বা মেটিরিয়াল নয়। ‘ব্রহ্মবস্তু’ হল ঈশ্বরসত্ত্বা-পরমাত্মার প্রতীক। শ্রীকৃষ্ণ পরমহংস ঈশ্বর বলতে বোঝাতেন ‘স্বচ্ছবস্তু’। জড় শরীরে, ঈশ্বর বস্তু যুক্ত হলে মানুষ পূর্ণতা পায়।শ্রীজগন্নাথ দেবের ক্ষেত্রেও পুরাতন শরীর থেকে নতুন শরীরে ব্রহ্ম প্রতিস্থাপন করা হয়। জগন্নাথদেবের যে কলেবর আমরা চাক্ষুস দর্শন করি, তা পরিবর্তনশীল। কিন্তু জগন্নাথের ব্রহ্ম-বস্তু অপরিবর্তনীয়। এই বস্তু আসলে পরমাত্মা-পূর্ণব্রহ্ম-নিত্য-শ্বাশত। এই দর্শনের ফলিত রূপই হল নবকলেবর। নবকলেবর কোন ঘটনামাত্র নয়, একটি আধ্যাত্মিক দর্শন মাত্র।

নবকলেবর আধ্যাত্মিক দর্শন কেন পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে যেসব আচার কৃত্যাদি সম্পন্ন হয়, তা সবই শাস্ত্র সিদ্ধ এবং বিশ্বাস সিদ্ধ। ফলিত ক্ষেত্রে শাস্ত্র ও আধ্যাত্মিকতা এবং বিশ্বাস ও বিধান একে অপরের পরিপূরক। এই পারস্পরিক সংবন্ধন শ্রীজগন্নাথ দেবের সংস্কৃতিতে খুবই শক্তিশালী। স্কন্দপুরাণ অনুসারে, শ্রীজগন্নাথ হলেন স্বয়ং শ্রীনারায়ণ। শাস্ত্র অনুসারে, ভগবান শ্রীবিষ্ণু-শ্রীনারায়ণ বারার পৃথিবীতে আসেন। শ্রীমভাগবত গীতায় বলা হয়েছে- ‘ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভাবামি যুগে যুগে’। এখানে লক্ষণীয় হল- শ্রীজগন্নাথ দেব মানুষ রূপে ‘পৃথিবীতে এলেন না, কিন্তু মনুষ্য লীলা করার জন্যই এলেন।

মনুষ্যলীলা কথাটির সরলার্থ হল- দারুব্রহ্ম শ্রীজগন্নাথ মনুষ্য জীবনের ঔচিত্যকে মান্যতা দিয়ে মানবজীবনের শরিক হতে চান। সাধারণ মানুষের মতোই শ্রীজগন্নাথ খেতে ভালোবাসেন, দুপুরে নিদ্রামগ্ন হন, স্নানযাত্রার সময় ১০৮টি ঘড়ার জলে স্নান করেন, তাঁর জ্বর হয় ও চিকিৎসা পরিচর্যা হয়, তিনি সুস্থ হয়ে মাসির বাড়ি যান, ইত্যাদি জীবনপ্রবাহের ঘটনা চলে। মনে হয় স্বয়ং ঈশ্বরও মানুষের জীবনের স্বাদ পেতে আগ্রহী। এই বার্তা ও ভাবধারা মানবজীবনের মহিমাকেই তুলে ধরে।

মনুষ্য জীবনের তিনটি সত্য আছে- জন্ম-মৃত্যু ও আত্মা। কিন্তু গীতায় বলা হয়েছে, যার মৃত্যু হয় তার পুর্ণজন্মও ধ্রুব। মানুষের মৃত্যু হলেও তা কোন জীবনবোধের কথা নয়, মানুষ মৃত্যুকে অতিক্রম করে এটাই মানুষের মহিমা। তাই মানুষ র্থনা করে ‘মৃত্যোর্মামৃতম্ গময়’। শ্রীজগন্নাথ দেবের নবকলেবর সেই অমৃত গমনেরই দ্যোতক।

গীতায় ‘মৃত্যু’ শব্দটি পরিবর্তে একটি অন্য শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে ‘দেহান্তর প্রাপ্তি’। আত্মা অমর যা অমৃতলোকের অধিবাসী। অপরদিকে দেহ মরণশীল। মানুষ জীর্ণ দেহ পরিত্যাগ করে নতুন দেহ গ্রহণ করে। জগন্নাথদেবও এর অন্যথা করেন না। তিনি পরমব্রহ্মা, তাঁকে মানব লীলা না করলেও কিছু এসে যেত না। কিন্তু কেবলমাত্র মানুষের জীবনকে মহিমান্বিত করার জন্যই জগন্নাথদেব মানবলীলার অবতারণা করেন।

অতি খ্যাতনামা সমালোচকরাও বলেন, প্রভু জগন্নাথ দেব আসলে সর্বধর্মেরই দেবতা। ইনিই রত্নবেদীতে বিষ্ণু, শয়নকালে শক্তি, গমনে রুদ্র, স্নানবেদীতে বিনায়ক ও রথচালনা কার্য্যে আদিত্য বা সূর্য্যদেব। বৈষ্ণবদের তিনি কৃষ্ণ, শবর উপজাতিদের কাছে চখানয়ন, শৈবদের কাছে শিব।

আবার তিনিই একাধারে ঋষভনাথ, গণপতি, কালী- যার মধ্যে অনিবার্যভাবে মিলেমিশে থাকে সাধারণের প্রতি আশ্বাস। অনেকটা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় —

“মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক আমি তোমাদেরই লোক…” বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

Loading