বিশেষ প্রতিবেদন- পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন শুরু হতে যাচ্ছে খুব শিগগির। নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই রাজ্যটির প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল, বিশেষত রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল, বিজেপি, কংগ্রেস ও সিপিএমসহ অপরাপর বামপন্থিদলগুলো তাদের নির্বাচনী কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু করে দিয়েছে। ইতোমধ্যে জোট গঠন করেছে বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ। আসন ভিত্তিক দলগুলোর প্রার্থী ঘোষণাও প্রায় শেষ পর্যায়ে। এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে দলবদল শুরু হয়েছে ব্যাপক হারে। কেন্দ্রীয় শাসকদল ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপিতেই গিয়েছে এর বেশির ভাগ অংশ। নির্বাচনী এই মৌসুমে অনেক সিনেমা তারকাও যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় তারকা মিঠুন চক্রবর্তী।  ব্রিগেডের মঞ্চে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উপস্থিতিতেই তিনি বিজেপিতে যোগ দেন। বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যস্ততা বেড়েছে রাজ্যের সংবাদমাধ্যমগুলোর। বেড়েছে নাগরিকদের ব্যস্ততাও। এই নির্বাচনে ক্ষমতায় আসবে কোন দল? টানা দুইবার ক্ষমতায় থাকা তৃণমূলই থেকে যাবে শাসনের দায়িত্বে? নাকি তাদের হটিয়ে ক্ষমতার মসনদে বসবে বিজেপি? কিংবা দীর্ঘ সময় পশ্চিবমঙ্গ শাসনকারী বামদলগুলোর নতুন জোট বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে? এসব নিয়ে চলছে নানা সমীক্ষা, চলছে চুলচেড়া বিশ্লেষণ। নির্বাচন নিয়ে কী ভাবছেন?

সুমন ভট্টাচার্য

সাংবাদিক ও কলামিস্ট

তৃণমূল জিতলে পশ্চিমবঙ্গ কাশ্মীর হয়ে যাবে বলে শুভেন্দু অধিকারী আসলে কি বোঝাতে চেয়েছেন? সদ্য বিজেপিতে যোগ দেওয়া নেতা তাহলে কি আসলে বাংলাদেশকে পাকিস্তান মনে করেন? আর হিন্দুত্ববাদী দলে যোগ দেওয়ার পরে তিনিও কি আসলে ‘মুসলিম বিরোধী’ মন্তব্য করে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতির পথে হাঁটতে চাইছেন? ২০২১-এর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচনের আগে একজন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে এইগুলো আমার কাছে জরুরি প্রশ্ন হয়ে উঠে আসছে। কারণ এই বছরটা শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ এবং মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহেই বিজেপির সর্বোচ্চ নেতা, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশ ভ্রমণ করবেন বঙ্গবন্ধুর স্মরণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। তাই একদিকে নরেন্দ্র মোদী মুসলিম প্রধান বাংলাদেশকে কাছে টানতে চেষ্টা করবেন, সেখানে গিয়ে শেখ হাসিনার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ‘প্রতিবেশীর সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করবেন, আর তাঁরই দলের নেতারা মোদীর সঙ্গে একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের দিকে কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত করবেন, সেটা কি করে চলতে পারে?

শুভেন্দু অধিকারীর ব্রিগেডে করা ‘সাম্প্রদায়িক’ মন্তব্যের জবাব এমনিতে কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লা টুইট করে দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আজকের এই ফেসবুক, টুইটার সোশ্যাল মিডিয়ার পৃথিবীতে বিশ্বের কোন প্রান্তে কি হচ্ছে, তা আর কারও জানতে বাকি থাকে না। বিজেপি পশ্চিমবঙ্গকে যত ‘সাম্প্রদায়িক বিভাজন’-এর রাজনীতি দিয়ে ভাগ করে দখল করতে চাইবে এবং ‘মুসলিম বিরোধী’ জিগির তুলবে, তার প্রভাব তো প্রতিবেশী বাংলাদেশেও পড়বে। ঠিক যেমনভাবে বাংলাদেশে হিন্দু মন্দির ধ্বংস হলে পশ্চিমবঙ্গে তার প্রভাব পড়ে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের এক দলীয় শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ভারতবর্ষ যেহেতু একটা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং বহু দলীয়, বহু ধর্মীয় সমাজের প্রতীক, সেক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের মতো একটি সীমান্ত রাজ্যের নির্বাচন এবং নির্বাচনের ইস্যুগুলো গুরুত্বপূর্ণ।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ব্রিগেড থেকে হিন্দুত্ববাদের জিগির না তুললেও এর আগে তাঁর সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘অনুপ্রবেশ’কে ইস্যু করতে গিয়ে সব অনুপ্রবেশকারীকে ‘উঁইপোকা’ আখ্যা দিয়েছিলেন। যা নিয়ে ভারতবর্ষের ভিতরে তো বটেই, ঢাকাও যথেষ্ট কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। আমাদের মাথায় রাখতে হবে, পশ্চিমবঙ্গে শুধু ২৭ শতাংশ মুসলিম বাস করেন না, আন্তর্জাতিক মানচিত্রের দিক থেকেও এই রাজ্যের অবস্থান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ইতোমধ্যেই হিন্দু প্রধান দেশ নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আর খুব মধুর নয়। এবং আশ্চর্য সমাপতন, সেই নেপালের সঙ্গেও পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত রয়েছে, আর জনজাতির দিক থেকে কাঠমান্ডুর সঙ্গে যে গোর্খাদের ‘আত্মিক’ সম্পর্ক, সেই দার্জিলিংয়ের গোর্খা নেতৃত্বও এই নির্বাচনের আগে বিজেপির বিরুদ্ধে সরব।

তাহলে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন জিততে গিয়ে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি জনসংখ্যার কত অংশকে রুষ্ট করতে পারে এবং কয়টি প্রতিবেশী দেশের বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে, সাংবাদিক হিসেবে সেটা আমার কাছে নজর রাখার মতো বিষয়। তৃণমূল থেকে দলে দলে যোগদান করিয়ে বিজেপি এটা প্রমাণ করে দিয়েছে এতদিন তারা মমতার বিরুদ্ধে যে দুর্নীতি বা স্বজনপোষণের অভিযোগ করত, আসলে তারাও সেটাই অনুসরণ করতে চায়। তাহলে বিজেপি আলাদা কোথায়? পশ্চিমবঙ্গের মতো একটি সীমান্ত রাজ্যে ‘সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ’-এর ক্ষেত্রেই একমাত্র তারা আলাদা। পশ্চিমবঙ্গে তাদের সেই কৌশল সফল হয় কিনা, সেটাই দেখার।

(এরপর আগামী কাল)

Loading