ছোট গল্প – সুইটি

কলমে – স্মরজিৎ দত্ত

 

বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান তন্বী। আজকের যুগের অন্যতম এক নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি। বাবা-মা দুজনই সংসার বহন করবার জন্য কর্মক্ষেত্রে যুক্ত। সন্তান যখন একদম ছোট ছিল তখন তাকে দেখাশোনা করবার জন্য একটা লোক থাকলেও সকলের সম্মতিক্রমে মেয়ের একটি সাথী জোগাড় করে দেবার উদ্দেশ্যে ঘরে নিয়ে এলো তন্বীর বাবা একটি সারমেয়কে। তন্বী সখ করে তার নাম রেখেছিল সুইটি।

সুইটিও নতুন বাড়িতে এসে তার মনিব দের যেমন প্রিয় পাত্র হয়ে উঠল তেমনি তন্বীরও একটা সাথী হয়ে উঠলো। খুব অল্পদিনেই সুইটি তন্বীর সারাদিনের ন্যাওটা হয়ে গেল। এক সময় দেখা গেল তন্বীকে তার বাবা-মা বকলেও সুইটি তাকে শাসন করছে। সুইটি আর তন্বী কেউই আর কাউকে ছাড়তে পারে না। সকালের খাওয়া থেকে রাতের ঘুম একজন আরেকজনকে ছাড়া একাকী খায়না। যেখানে তন্বী যাবে সেখানে সাথে সাথে সুইটিকেও যেতে হবে।

যখন তন্বী ক্লাস সিক্সে পড়ে তখন সুইটি ওদের বাড়িতে এসেছিল। আজ তন্বী মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে চলেছে সাথে সুইটিও যাচ্ছে। সারাদিন পরীক্ষা চলেছিল তন্বীর মা বাইরে অপেক্ষা করেছিল। সুইটিও তার সাথে বাইরে চুপটি করে অপেক্ষা করেছিল ওই তন্বীর জন্য। একদিনও বাদ যায়নি, প্রতিদিন গেছে অপেক্ষা করেছে। আজ সত্যিই সুইটি ওদের বাড়ির একজন হয়ে গেছে।

মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, বি.এ. এভাবেই পাশে থেকে গেছে সুইটি তন্বীর সাথে। বি.এ পরীক্ষা পাস করেছে। চাকরির পরীক্ষাও দিচ্ছে। বাড়ির বাবা-মা তন্বীর জন্য সম্বন্ধ দেখা আরম্ভ করলো। হঠাৎই দেখা গেল সুইটির একটা বড় পরিবর্তন; কেবলই এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায় সুইটি, আর উদাস মনে তাকিয়ে থাকে তন্বীর দিকে। মাঝেমধ্যে তন্বীও জিজ্ঞাসা করে তাকে; কিরে তুই অমন করে তাকিয়ে আছিস কেন কিছু খাবি। কিছু বলে না সুইটি, শুধু মুখের দিকে তাকায় আর সাথে সাথে পাশেই চুপটি করে বসে তাকিয়ে থাকে তন্বীর দিকে।

যথা সময়ে তন্বীর শ্বশুর বাড়ি যাবার ফাইনাল হয়। ঘটা করে বিয়ের আয়োজন, আত্মীয় পরিজন বন্ধু-বান্ধব কোন জায়গায় কোন আতিথেয়তার কোন ত্রুটি হয় না। তন্বীও মনে মনে ভাবতে থাকে আমার সুইটিকে আমার শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যেতে হবে।  ও তো আমাকে ছাড়া থাকতেই পারে না। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে মানবে কিনা তারও তো কথা। মনে মনে ভাবে শ্বশুরবাড়িতে সকলের সাথে বুঝিয়ে সে একটা রাস্তা তৈরি করবে। শ্বশুর বাড়িতে ঢুকেই তার বরকে সে প্রায় প্রথম দিনেই নিজের হাতে করে নিতে সক্ষম হয়েছিল । এক কথাতেই সে বলেছিল হ্যাঁ অবশ্যই সে তো থাকতেই পারে। সে তো ভালই হবে। কিন্তু হয়তো নিয়তি বলে একটা কথা আছে। যে নিয়তি অনেক আগেই বুঝিয়ে দেয় কোনটা ঠিক কোনটা ভুল । বর রাজি হলেও বাকিরা সবাই তেমনভাবে সম্মতি দেয় না। তবুও তন্বী মনে মনে হাল ছাড়েনি। অষ্টমঙ্গলায় সে আবার যাচ্ছে বাড়িতে। আগের দিন থেকেই সারাদিন তার মন উতলা হয়ে রইল। কতক্ষণে সে বাড়িতে পৌঁছবে আর সুইটিকে সে একবার কাছে টেনে নেবে। হতে পারে ওরা কথা বলতে পারে না;  তবে সারমেয় হলেও ওদের যে বোধ বা সেন্স তা যে সাধারণ মানুষের থেকে অনেক বেশি থাকে কলিং বেল বাজাতেই তন্বী খুব ভালো করেই বুঝতে পারে। বাবা দরজা খুললেও সাথে সেই সুইটি গেট খুলতে খুলতেই সে সামনে এলো। কিন্তু কেন জানি তন্বীর মনে হল পুরনো সুইটির যে উদ্মাদনা সেই উন্মাদনাটা আজ আর তেমন নেই। মাকে জিজ্ঞাসা করলো তন্বী;  সুইটির কি হয়েছে গো? মা বললো তুই যেদিন চলে গিয়েছিস সেই দিন থেকেই ও প্রায় খায় না বললেই চলে। বাবা ডাক্তার দেখিয়ে এনেছে । ডাক্তার বলেছে হয়তো ও কোন সক্ট পেয়েছে। ওষুধ দিয়েছে তবে বড় মর্মরা হয়ে পড়ে থাকে কেবল। সুইটি গা ঘেঁষে বসে তন্বীর পাশে। তন্বীও সুইটিকে কোলে নিয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকে, তুই এমন কেন করছিস সুইটি, আমারও কি কোন ইচ্ছে হয় না? আমাকেও তো একটু সময় দিতে হয় । আমিও তো চেষ্টা করছি, তোকে আমার কাছে নিয়ে যাবো। কিন্তু তুই খাচ্ছিস না কেন?  না খেলে তোর শরীরটা থাকবে? মন মানে না  তন্বীর। সে বাবাকে বলে কাল আমি ওকে আবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। আমি নিজের কানে শুনবো, তবে আমি শান্তি পাব। রাতে নিয়েও যায় ; ডাক্তার দেখিয়ে তার ওষুধ তার পথ্যের সমস্ত ব্যবস্থা তন্বী নিজের হাতেই করে। পরের দিন সকালে শ্বশুর বাড়ি যাবার সময় সুইটিকে আদর করে বলে, কথা দিচ্ছি আর কটা দিন একটু কষ্ট করে থাক ; আমি তোকে আমার বাড়ি নিয়ে যাবই।

বাড়ি ফিরে তন্বী কিছুটা উদাস মনেই শুয়ে থাকে। বর অমিতেশ এসে বলে তুমি এমন ভাবে শুয়ে আছো কেনো? শরীর খারাপ? তন্বী নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা অঝোরে কাঁদতে থাকে । বলে, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে সুইটি আর থাকবে না । আমি ওকে আমার কাছে নিয়ে আসতে পারিনি ও সেটা মনে মনে হয়তো মেনে নিতে পারেনি। ডাক্তার বলেছে ও কোন একটা কষ্ট পেয়েছে। সেটা রিকভারি না হলে হয়তো বড় কিছু ঘটতে পারে। খেতেও পারে না সে রাতে। ভোরে বিছানা ছেড়ে ওঠবার আগেই হঠাৎ মোবাইল বেজে ওঠে। এত সকালে সাধারণত তন্বীর ফোনে কোন ফোন আসার কথা নয়। ঘুমের চোখেই তন্বী মোবাইল হাতে তোলে । ভেসে ওঠে তন্বীর মায়ের নাম। এত সকালে মা ফোন করছে কেন?  বাবার কি কোন শরীর খারাপ? হঠাৎ তন্বী খুব উতলা হয়ে ওঠে। উতলা সাথে ভয় নিয়েই সে ফোনটা রিসিভ করে। অপর পাশ থেকে হঠাতই মা হাউ হাউ করে কেঁদে বলে তন্বী আর পারলাম না আমার মেয়েটাকে কাছে রাখতে। তন্বীরও বুঝতে অসুবিধে হয় না মায়ের অপর মেয়ে ওই সুইটি। তন্বীও হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে বলে, মা কেন সুইটির কি হয়েছে? তন্বীর মা বলে কাল তুই চলে যাবার পর, সুইটিকে খাবার খাওয়াতে গিয়ে ডাকলেও সুইটি ওঠেনা। খুব কষ্ট করে একবার তাকায়, ওকে কোলে করে নিয়ে খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করি। কিন্তু তেমন সাড়া দেয় না । আমি উতলা হয়ে ওকে পাশে নামিয়ে তোর বাবাকে ডাকতে যাই। বাবা ছুটে আসে। দেখি ছোট্ট সুইটি তার চোখটা বুঝে তোর ছবির দিকে তাকিয়ে বসে আছে। ডাক্তার ডেকেছিলাম । তিনিও এসেছিলেন ; পরীক্ষা করে জানায় সুইটির রিপিটেড স্ট্রোক হয়েছে। চোখের সামনে এভাবে চলে যাবে আশা করতে পারিনি। অঝোরে তন্বীও কেঁদে ওঠে। বলে অপেক্ষা করো আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই অমিতেশ আর তন্বী পৌঁছায় তন্বীর বাড়িতে। হতে পারে সারমেয়, কিন্তু তারও যে আপনজন আছে; শুধু যে তন্বী নয়, তাকে আড়ালে আবডালে তাদের এই আত্মীয়তা তাদের নিজেদের অজান্তে সুইটির আরো কত আত্মীয় বেড়ে উঠেছে, সেটা বোঝা গেল তন্বী বাড়িতে প্রবেশ করার পর। যত্ন করে একটা বিছানায় সায়িত আছে সুইটির মরদেহ। তন্বী ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে। পাশের বাড়ির সবাই হয়তো জানে না সুইটি, তাদের সুইটি আর নেই ;চলে গেছে। জানলা দিয়ে সেই বাড়িরই একটা সংগীত ভেসে আসে তন্বীদের বাড়িতে। “তুমি রবে হৃদয়ে মম”। তন্বীও কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে তোর জন্য উতলা হয়ে ছুটে আসতাম রে, আমার সেই উতলা তুই এভাবে ভাসিয়ে নিয়ে গেলি। ভালো থাকিস, সুখে থাকিস, সারা জীবন তুই যেমন ছিলি তেমন ভাবেই থাকবি আমার হৃদয় মাঝে।

Loading