শিরদাঁড়ার হাড়ের একটি জটিল সমস্যা। শিশু যখন জন্মায় তখন বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, হাড় বা হাড়ের সন্ধিস্থল বা বোন জয়েন্ট যেমন অবস্থায় থাকে, সেগুলো নিয়েই সে বড় হতে থাকে। পরবর্তীকালে হাড় বা হাড়ের সন্ধিস্থল বা বোন জয়েন্ট  ক্রমাগত ব্যবহারের ফলে ক্ষয় হতে থাকে।

মনে রাখা প্রয়োজন স্পন্ডিলোসিস হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বয়সের সীমারেখা নেই। তবু সাধারণত ৩৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষের এই সমস্যা শুরু হয়। আজকাল অবশ্য আমরা দেখি যেখানে ২৬/২৭ বছরের গৃহবধূ কিংবা তরুণ কর্পোরেটরাও এই সমস্যায় ভুগে থাকেন।  সাধারণত বিভিন্ন রকমের কাজের চাপ থেকে স্পন্ডিলোসিস হতে পারে। নিয়মিত একই ভাবে বসে বা দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ কাজ করার অভ্যাসের কারণেও স্পন্ডিলোসিস হতে পারে। ঘাড়ের দিকের অংশে এই রোগ হলে তাকে বলা হয় সার্ভাইক্যাল স্পন্ডিলোসিস। আবার শিরদাঁড়ার নিচের দিকের অংশে অর্থাৎ পিঠের নিচের দিকে হলে তাকে বলা হয় লাম্বার স্পন্ডিলোসিস।

যারা আক্রান্তের ঝুঁকিতে

পুরুষ বা মহিলা উভয়েই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। সাধারণত ঘাড় সামনে ঝুঁকিয়ে কাজ করতে হয় এমন সব পেশার মানুষের এ রোগটি বেশি দেখা যায়।

যেমন চেয়ার- টেবিলে বসে কাজ করে এমন এক্সিকিউটিভ, কম্পিউটারে একনাগাড়ে কাজ করে যাওয়া, কর্পোরেট প্রভৃতি। ঘাড়ের ঝাঁকুনি হয় এমন কাজে নিযুক্তদের যেমন নর্তকী, গাড়ি- মোটরসাইকেল ও সাইকেলে নিয়মিত যাতায়াতকারীদের এই রোগ হতে পারে।

ব্যথার নানা রূপ

ঘাড়ের ব্যথা অনেক সময় কাঁধ থেকে উপরের পিঠে, বুকে, মাথার পেছনে বা বাহু হয়ে হাত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই রোগের সবচেয়ে মারাত্মক দিক হলো, স্পাইনাল কর্ডের উপর চাপ পড়া। এর ফলে হাত-পায়ে দুর্বলতা, হাঁটতে অসুবিধা হতে পারে। পায়খানা ও প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এই রোগে আক্রান্ত হলে ঘাড় নাড়াতে গেলে ব্যথা লাগে। ডানে-বাঁয়ে ঘাড় ঘুরাতে সমস্যা হয়। ঘাড় শক্ত হয়ে যায়, ব্যথা হয়। হাতে, বাহুতে ঝিনঝিন বা শিরশির, অবশ ভাব বা সূঁচ ফোটানোর মতো অনুভূতি হয়। কাজ করতে যন্ত্রণা হয়।

এই সমস্যা হলে অনেকে বলেন হাত তুলতে সমস্যা হচ্ছে বা হাত দিয়ে কাজ করতে পারছেন না। আবার অনেকের মাথা ঘোরে। তবে মাথা ঘোরার আরও অনেক কারণ থাকে। স্পন্ডিলোসিস তার মধ্যে একটি।

ট্রিটম্যান্ট

স্পন্ডিলোসিসের তিন ধরনের চিকিৎসা হয়ে থাকে। রোগীকে ব্যথা নিরাময়ের ওষুধ দেয়া হয়। এক্ষেত্রে আমরা নন-স্টেরয়েড পেইনকিলার দিয়ে থাকি। শুধু ওষুধ দেয়াই নয়, ওষুধ খাওয়ার পাশাপাশি তাদের কাজ করার ভঙ্গিমাও পাল্টাতে হবে। কারণ  ঘাড় বা পিঠ বেঁকিয়ে দীর্ঘক্ষণ বসার অভ্যাস থেকেও এই রোগ জটিল হতে পারে। এই সমস্যা থেকে রেহাই পেতে এভাবে দীর্ঘক্ষণ বসে বা দাঁড়িয়ে থাকা এড়াতে হবে। ঘাড় সোজা রেখে কাজ করতে হবে। আর চেষ্টা করতে হবে সব সময়ে ঘাড় সোজা ও পিঠ সোজা রেখে বসা। রোগীকে চিকিৎসকের পরামর্শ মতে অবশ্যই ফিজিওথেরাপি নিতে হবে। নির্দিষ্ট কিছু ব্যায়াম আছে, যেগুলো স্পন্ডিলোসিসের সমস্যার সময়ে রোগীদের দেয়া হয়। বিশেষত স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ। ব্যথা যেখানে হচ্ছে তার আশপাশের মাংসপেশিকে শক্ত রাখার জন্য বিশেষ ব্যায়াম দেখিয়ে দেয়া হয় রোগীকে। বাড়াবাড়ি হলে রোগীকে বেল্ট, কলার ব্যবহার করতে বলি আমরা। সময় বিশেষে ট্র্যাকশানও দেয়া হয়। এতেও না কমলে যদি উপায়ান্তর না থাকে সেক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের দিকে যাওয়া হয়।

করণীয়

এই রোগের থেকে দূরে থাকতে হলে স্ট্রেসফুল কাজ  কমাতে  হবে। শিরদাঁড়াকে ঠিকঠাক রাখতে হবে। ক্যারামের ঘুঁটি যেমন সাজানো হয় তেমনি আমাদের শিরদাঁড়া। ক্যারামের ঘুঁটিগুলো যেমন পর পর সমান্তরালভাবে না সাজিয়ে এলোমেলোভাবে সাজিয়ে রাখি সেটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। শিরদাঁড়াও তাই। তা যদি এলোমেলোভাবে থাকে তত বেশি চাপ পড়বে। আমাদের শিরদাঁড়া যদি শুধু হাড় দিয়ে তৈরি হতো তাহলে আমাদের সেই শিরদাঁড়া এদিক ওদিক নড়াচড়া করে ঘাড় বা পিঠ বেকিয়ে কাজ করতে অসুবিধা হতো। আমাদের শিরদাঁড়ায় পর পর বেশ কিছু ডিস্ক রয়েছে। ক্রমাগত ব্যবহারের ফলে তো সব জিনিসেরই ক্ষয় হয়। তেমনি শিরদাঁড়ার এই ডিস্কও ব্যতিক্রম নয়। ৩০-৩৫ বছরের পর এই ডিস্ক ক্রমশ নষ্ট হতে শুরু করে। তখন আশপাশের হাড়ের ওপরে, মাংসপেশির ওপরে চাপ পড়তে থাকে। সেই কারণে আমরা সকলকে সোজা হয়ে বসা বা দাঁড়ানোর ওপরে জোর দিতে বলি।

কখন চিকিৎসক দেখাতে হবে

কারও যদি মনে হয় হাতে-পায়ে ব্যথা, অবশ হয়ে যাওয়া বা ঝিনঝিন করছে তাহলে সেই সমস্যা পুষে রাখা উচিত হবে না। এতে সমস্যা আরও বাড়বে। প্রথম অবস্থাতেই দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। হয়তো হাঁচি দিতে গিয়ে বাঁ-দিকে তাকালেন। আর ঘাড় আটকে গেল। অথবা একটানা কাজ করছেন, কিন্তু ঘাড়ে একটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। থেকে থেকেই ঘাড়কে একটু নাড়িয়ে নিতে হচ্ছে। কিংবা ধরুন, মেয়েদের খোঁপার কাছটায় একটা চিন চিনে ভাব। খোঁপাটাকে অসম্ভব ভারী মনে হচ্ছে। এগুলো স্পন্ডিলোসিসের একেবারে প্রথম ধাপ। এই সময়ই ডাক্তার দেখান।

যে ভুলগুলো করা উচিত নয়

এই সমস্যার লক্ষণগুলোকে অবহেলা করবেন না। অনেকে বারো-তেরো বছরের পুরনো ব্যথা নিয়ে পার করেন। সেই ভুলটা অন্তত করবেন না। দেরি হলে, অপারেশন ছাড়া উপায় থাকবে না। মনে রাখবেন, স্পন্ডিলোসিস হলো একটা লাইফস্টাইল ডিজিজ। তাই প্রথমেই আপনার জীবনযাত্রা ঠিক করতে হবে। রাতের ঘুম সবচেয়ে জরুরি। ছ’ঘণ্টা হোক কি আট ঘণ্টা, ঘুমোতে হবে রাতে। একটা ভুল ধারণা আছে যে, বালিশ ব্যবহার করা নিয়ে। কখনোই বালিশ ছাড়া ঘুমাবেন না।

সব সময় নরম একটা বালিশ নিন। আর ঘুম থেকে ওঠার সময় সোজা উঠবেন না। পাশ ফিরে উঠুন। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান। এক সঙ্গে বেড়াতে যান। বাচ্চার সঙ্গে খেলা করুন। কখনোই একটানা বসে টিভি দেখবেন না। চিকিৎসার ভাষায় বলে, স্পন্ডিলোসিস অনেকাংশে সাইকোসোমাটিক। ১৫ শতাংশই মানসিক। টেনশন খুব খারাপ রোগ। মন হাসি-খুশি ও রুটিনমাফিক চলতে  থাকলে স্পন্ডিলোসিস সহজে হবে না।

 

 

 

 

 

 

 

  

Loading