অণুগল্প – সময় মহার্ঘ
কলমে – সুমিত রায়
VILL. SUBHASNAGAR (Jalpesh Road), Ward no. 14, P.O. & P.S. MAYNAGURI
DIST. JALPAIGURI, PIN CODE: 735224, WESTBENGAL, INDIA
সকালে, কাগজটাও পড়ার সময় পান না অমলেন্দু স্যার। বড়ছেলের ঘরে নাতনির সাথে খেলা করতেই, সকালে সময় কেটে যায় তাঁর। অন্য রবিবারের তুলনায় আজ রবিবারটা অনেকটাই ব্যস্ততায় মধ্যে সময় কাটবে, অমলেন্দু স্যারের। তাই পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী চলতে, অন্যদিনের চাইতে একটু আগেই স্নানটা সেরে নিলেন তিনি। শীতের রোদে বসে কাগজপত্র ঠিক করতে করতে বৌমাকে বললেন,-“বৌমা, আজ একটু তাড়াতাড়ি খাবার দেবে, হাতে সময় খুব কম।”
“কেন বাবা, আজ এত তাড়াতাড়ি? আজ তো রোববার। আপনার তো আজ ছুটি কাটানোর সময়!”
“হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো, কিন্তু আজ আমি এক আলোচনা সভায় যোগ দিতে যাব। আজ এক ব্যতিক্রমী বিষয় ‘সময়’ এর উপর বক্তব্য রাখবো।”
“বা: বিষয়টা তো চমৎকার!”বৌমা খাবার দিতে দিতে বলল।
“হ্যাঁ, বিষয়টা চমৎকার বটে, কিন্তু এই সময়কে কতজনই বা মূল্য দেয়? অথচ বেশিরভাগ লোকই, অনেক সময় কাজ থেকে রেহাই পেয়ে যান – সময়ের দোহাই দিয়ে। সহজে বলে ফেলেন,-‘সময় পাইনি’। আশ্চর্য! এটা আজকালকার মানুষের একটা- স্বভাব বলতে পারো । আসলে বর্তমান সময়ে, বেশির ভাগ মানুষের সঠিক পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। তুমি তো জানো, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বিজ্ঞানী যিনি, সব সময় ব্যস্ত থাকা সত্বেও পিয়ানো বাজানোর সময় বের করে, শ্রুতিমধুর সুর সৃষ্টি করতেন। তিনি নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী সি. ভি. রমন।”
ভাত খেতে খেতে এই কথাগুলো অমলেন্দু স্যার অনর্গল বলে গেলেন । হাতঘড়িতে চোখ বুলিয়ে নিলেন কতটা সময় হল। বছর চারেক পরে অবসর নেবেন শিক্ষকতার পদ থেকে। চাকুরী জীবন ত্রিশ বছর অতিক্রান্ত। দীর্ঘ এই সময়কালে তিনি অনেক বাস্তবের সম্মুখীন হয়েছেন, যা তাঁর অভিজ্ঞতার সিঁড়িতে পা রাখলেই বোঝা যায়। কোন বিষয়ে তাঁর জ্ঞান কম আছে- এটা সাধারণ অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ধরা পড়বে না। যেকোনো জায়গায় উল্লেখিত সময়ের পূর্বেই উপস্থিত হওয়া ছিল অমলেন্দু স্যারের ছোট বেলা থেকেই অভ্যেস। সময়ের মূল্য তিনি খুব ভালোভাবে দিতে জানতেন। কোনভাবেই সময় নষ্ট করতে তিনি পছন্দ করতেন না। যখনই ফাঁকা সময় পেতেন তখনই হাতের কাছে যে বই থাকতো, তাই পড়ে ফেলতেন। পড়ার ক্ষেত্রে তাঁর কোনো আলস্য কেউ কখনও লক্ষ্য করে নাই। এই কারণেই আজকের সময়ে তিনি এক আদর্শ পরামর্শদাতা। যেকোনো বিষয়ে আলোচনা সভায় তাঁর ডাক পড়ে যায় মাঝে মাঝেই।
স্নান শেষে উঠোনে বসে স্ত্রী প্রমিলাদেবী ভেজা চুল শুকোতে সময় খরচ করছেন- শীত রোদের কাছে। ছোট নাতনি অদ্রিজা, শৈশব সময় কাটাচ্ছে, পুতুল নিয়ে খেলতে খেলতে।
কাঁধে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ ঝুলিয়ে সময়ের গতিতে বাড়ি থেকে বেরোলেন অমলেন্দু স্যার। কোথাও না থেমে সোজা পৌঁছলেন আলোচনা সভায়। মঞ্চে তিনি একা। সামনে বসে আছে কিছু শ্রোতা। শোনার আগ্রহে তাকিয়ে আছে মঞ্চের দিকে। অমলেন্দু স্যার অস্থির হয়ে উঠছেন। বারবার হাতের ঘড়িতে তাকিয়ে সময় দেখছেন। ভাবছেন- উল্লেখিত সময় অনেকক্ষণ আগেই পার হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও, এখনো সভার আলোচনা শুরু হচ্ছে না কেন? আমি কি ভুল সময়ে এসে পৌঁছেছি? নিজের চোখকে সন্দেহ করে, আরও একবার নিমন্ত্রণ চিঠিটা ব্যাগ থেকে বের করে দেখলেন- আলোচনার সময়সূচী। না, তিনি কোন ভুল সময়ে এসে পৌঁছাননি। নির্ধারিত সময়ের কয়েক মিনিট আগেই তিনি উপস্থিত হয়েছেন। চেয়ারে বসে আছেন প্রায় এক ঘন্টা ধরে-একা।সময়কে তিনি মান্যতা দিয়ে থাকেন সবসময়।সময়কে এইভাবে নষ্ট হতে দেখে- মনে মনে ভাবছেন,- “আজকের আলোচনার বিষয় ‘সময়’, অথচ সময়ের দিকে কারও কোন নজরই নেই।”
যাইহোক নির্ধারিত সময়ের পর থেকে প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে সভায় এক এক করে বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত হওয়ার পর, সভার আলোচনা শুরু হলো। সবার প্রথমে সভার আহবায়ক অজিতেশ বাবু বক্তব্যে বললেন,-”অনেকটা দেরি করে সভার কাজ আরম্ভ করার জন্য- আমি দুঃখিত! আজকে আমাদের মহান অতিথিরা ‘সময়’ এর উপর তাঁদের মূল্যবান বক্তব্য তুলে ধরবেন।আমরা সকলে অধীর আগ্রহে তাঁদের মূল্যবান বক্তব্য শুনবো। অনেকক্ষণ সময় ধৈর্য সহকারে বসে থাকার জন্য আপনাদের জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ। আমি আর আমার বক্তব্যে সময় নষ্ট করতে চাইছিনা।”
আহবায়ক এর সংক্ষিপ্ত ভাষণে অমলেন্দু স্যার মনে মনে বললেন,-”বা: বা: কী সময় পড়েছে! অনেকের মূল্যবান সময় এতক্ষণ নষ্ট করে, আজকের আহবাহক ‘দুঃখিত’ শব্দটি দিয়েই মুক্তি পেয়ে গেলেন।”
কয়েকজন নেতা মন্ত্রীর বক্তব্যের পর নির্দিষ্ট সময় বেঁধে অমলেন্দু স্যারকে তাঁর মূল্যবান বক্তব্য রাখার জন্য ঘোষণা করা হলো। অমলেন্দু স্যার মাউথপিস হাতে নিয়ে বলতে লাগলেন,-“শুভ অপরাহ্ন। যথাস্থানে সকলকে যথাযোগ্য সম্মান জানিয়ে আমি আজকের বিষয় ‘সময়’-এর উপর আলোকপাত করছি।
‘সময়’ থেমে থাকে না কারও জন্য, তা সে যত বড়ই নেতা-মন্ত্রী হোক না কেন। কারও কোন অনুরোধ কিংবা অর্থ দিয়ে যাকে আটকে রাখা যায় না, সেটি হল ‘সময়’- আজকের আলোচনার বিষয়। ‘সময়’ আমাদের চোখের পলক ফেলার আগেই চলে যায়। কোন শর্ত দিয়ে সময়কে ধরে রাখা যায় না। এই কারণেই ‘সময়’ মহার্ঘ! ‘সময়’ ভীষণ মূল্যবান সম্পদ! যারা এই সময়ের মূল্য বোঝে তারা ভবিষ্যতে সুখ পায়, অন্যথায় তারা কখনো সুখ পায় না।সময়ের মূল্য সম্বন্ধে সচেতন না হলে ব্যর্থতা অনিবার্য হয়ে যায়।
এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে যত সফল মানুষ জন্মেছেন তাঁরা সবাই সময়ের মূল্য দেওয়ার ব্যাপারে সব সময় সচেতন থাকতেন। যার হাতে কিছুই নেই, তার হাতেও সময় থাকে। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক থিওফ্রেস্টাস সময়কে নিয়ে বলেছিলেন,-‘তুমি যা কিছু খরচ করো, সময়ই তার মধ্যে সবচেয়ে দামি।’
সাধারণ মানুষ সময় কাটানোর চেষ্টা করে, আর অসাধারণ মানুষ সময়কে কাজে লাগানোর চেষ্টা করে।সময়ের মূল্য সম্বন্ধে সচেতন না হলে আমরা কর্মজীবনের উপযোগী হয়ে উঠতে পারি না। সংসার জীবনেও ব্যর্থতা নেমে আসে সময়ের অপব্যবহারে।
ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে- time is money অর্থাৎ সময়ের সঠিক ব্যবহার জীবনে এনে দিতে পারে আর্থিক সমৃদ্ধি। সম্পত্তি হারিয়ে গেলে তা পুনরুদ্ধার করা যায়। হারানো স্বাস্থ্য ফিরে পাওয়া যায় কিন্তু অতীত সময় কোন মূল্যেই আর ফিরে পাওয়া যায় না। সময়ের মূল্য সম্বন্ধে সচেতন না হলে ব্যর্থতা প্রকটরূপ ধারণ করে জীবনে।
তোমরা অনেক কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সময় পার করবে,হতাশা, একাকীত্ব, বিষণ্নতা, প্রিয়জনদের দেয়া কষ্ট তোমাদের ছাড়তে চাইবে না-তবুও সময়কে নান্দনিক উপায়ে রাঙিয়ে বেঁচে থাকাটাই তোমাদের জীবন!যারা জীবনে সফল হয়েছেন, খ্যাতিমান হয়েছেন তাদের বিশেষ গুণ হলো- তারা প্রত্যেকেই সময়কে মর্যাদা দিয়ে চলতেন।”
ঘড়ির কাঁটা বরাদ্দ সময় সীমা অতিক্রম করতেই অমলেন্দু স্যার সকলকে আবারও অভিনন্দন জানিয়ে মাউথপিস তুলে দিলেন ঘোষকের হাতে। সমস্ত হলঘর করতালির শব্দে ভরে গেল।
অনেক দেরিতে সভার কাজ শুরু হওয়ায় সভা শেষ হলো নির্ধারিত সময়ের প্রায় দু’ঘণ্টা পর। হলঘর থেকে বেরিয়ে অনেকে শীতের ঠাণ্ডা হাওয়ায় কাঁপতে শুরু করলো। তাদের ধারণা ছিল না, সভা এত দেরিতে শেষ হবে।তাড়াতাড়ি করে যে যার গন্তব্যস্থলে যাওয়ার জন্য দ্রুত হাঁটতে লাগলো। অমলেন্দু স্যার আর দেরি না করে বাড়ির রাস্তা ধরলেন। বাড়ি ফিরেই শুনতে পেলেন, বিশেষ প্রয়োজনে পুরনো বন্ধু নিখিলেশ বাবু অনেকক্ষণ তার জন্য অপেক্ষা করে অবশেষে বাড়ি ফিরে গেছেন। বৌমার হাতে দিয়ে গেছেন একটি কাগজের টুকরো, যাতে লেখা, -‘ অমলেন্দু,
খুব আশা করে তোর কাছে এসেছিলাম। ছেলের পড়াশুনার ব্যাপারে তোর কাছে একটা উপযুক্ত পরামর্শ নিতে। তুই তো জানিস আমার পড়াশোনার দৌড় কতদূর। তাই তোর পরামর্শ নিয়ে চললে ছেলেটা হয়তো মানুষ হত। আমি আর অপেক্ষার জন্য সময় দিতে পারছিনা, বিকেল পাঁচটায় ট্রেন।- বন্ধু নিখিলেশ। “
অমলেন্দু বাবু খুব দুঃখ পেলাম। আজ সবার আলোচনা নির্ধারিত সময়ে শুরু হলে তার বন্ধু নিখিলেশ বাবুকে এভাবে চলে যেতে হতো না। বৌমার হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে পেপার দেখতে দেখতে চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন।
রোজ ভোর পাঁচটায় রুটিন মত অমলেন্দু স্যার হাঁটতে যান সামনের রেলস্টেশন পর্যন্ত । স্টেশন পৌঁছাতেই অমলেন্দু স্যারকে দেখতে পেয়ে কয়েকজন এগিয়ে এলেন। অমলেন্দু স্যার বুঝতে পারলেন, ইনারা গতকাল সভায় উপস্থিত থাকা শ্রোতাবৃন্দ। তারা বললেন,-‘স্যার, গতকাল আপনি ভাষণে যা বলেছিলেন, তার ফল আমরা গতকাল থেকেই পেতে শুরু করেছি। আলোচনা দেরিতে শেষ হওয়ার কারণে আমরা কয়েকজন ট্রেন ধরতে পারিনি। গতকাল বাড়ি ফেরা আর হলো না। স্টেশনেই সারারাত ঠান্ডায় কষ্টের মধ্যে আমাদের কাটাতে হয়েছে।কাল যদি সঠিক সময়ে আলোচনা শুরু হতো এবং সঠিক সময় আলোচনা শেষ হতো তাহলে আমাদের এই দুর্ভোগ হতো না। আপনাকে আমরা প্রণাম জানাই। আপনার সুমিষ্ট বক্তব্য দ্বারা যদি কেউ ‘সময়’ সম্পর্কে একটু সচেতন হয়ে থাকেন, তাহলে আমাদের মত অনেকের উপকার হবে।”
অমলেন্দু স্যার চুপ করে থাকলেন। শুধু বললেন,-‘সারাদিনে কোন এক সময়ে নিজের মধ্যে একটু একটু করে নিজেকে খুঁজতে শেখো।
অমলেন্দু স্যার বাড়ি ফিরে বৌমাকে বললেন,-”জানো বৌমা, গতকাল সভার কাজ নির্ধারিত সময় পেরিয়ে অনেকক্ষণ পর আরম্ভ হওয়ার কারণে কত লোকের কত অসুবিধা হয়েছে। স্টেশনে গিয়ে দেখি বেশ কয়েকজন গতকাল বাড়ি ফেরার ট্রেন পায়নি। কত কষ্টে তারা রাত্রি পার করেছে। বাড়িতে আমার দীর্ঘদিনের পুরনো বন্ধু নিখিলেশের সাথে আমি দেখা করতে পারলাম না। হয়তো আমার পরামর্শে তার ছেলেটা ভালো হয়ে যেতে পারত। শান্তি ফিরে পেত নিখিলেশ। এভাবে সময়ের মুল্য না দিতে পারার কারণে, আরও কত মানুষের যে কত কষ্ট হয়েছে- তা আমার অজানা খাতায় পুঞ্জিভূত হয়ে চলছে। জানিনা, মানুষ আর কবে সময়ের সঠিক মূল্য দেবে?”