অণুগল্প – শ্রীমতি
কলমে :- নবলতা শীল
নিউ ব্যারাকপুর, কলকাতা
গায়ে সাদা পাঞ্জাবি হাতে লাঠি টুকটুক করে হাঁটতে হাঁটতে, কানা গুলির দিকে যেতে যেতে শ্রীমতি কে দেখে , পান চিবাতে চিবাতে কালো দাঁতে হাসতে হাসতে, অবনী বাবু বললেন কিরে মাগী এই ভর সন্ধ্যা বেলায় যাচ্ছিস কোথায় ? তোর কাছেই তো যাচ্ছিলাম ?
আমার নাগর এয়েছে বুঝি ?আপনার তো মেয়েছেলে নিয়ে দরকার একটা হলেই হল, তা চলে যান অনেকেই তো আছে।
– না-রে তোর মধু বেশি তুই একটু আলাদা, তোর গায়ের গন্ধ খুব ভালো।
-ও তাই বুঝি,আপনার অসুবিধা হবেনা বাবু ?
মতি বিবি আছে।খাতির যত্নে ভালই পাবেন। আমার ছেলের আজ রেজাল্ট বেরিয়েছে তাই একটু মন্দিরে যাচ্ছি পুজো দিতে যাব ?
-ওরে বাবা বেশ্যার আবার ছেলে ?
কেন তার ছেলে থাকতে নেই বুঝি তবে ছেলেটা কার রে? ওর বাপ কে ?যদি বলি আপনি?
আমার কাছে তো প্রথম থেকেই আসেন ? প্রথম খদ্দের ,আমি আপনার কেনা বাদী?না হওয়ার তো কিছু নেই।
মানে কি বলছিস তুই ?আমার ছেলে হতে যাবে কেন রে ?
কেন আপনি তো রোজই আসেন এতো ভালো কথা বললেন ?এখন সব দায়িত্ব আপনার —
আমার ছেলের কথা শুনে মুখ শুকিয়ে গেল ?
-ঠিক আছে, আজ গেলাম, কাল আসবো।
-পুজো দিয়ে ফেরার সময় চেনা গলার দিদি ডাক শুনে ,পিছন ফিরে তাকাতেই —
মামাতো ভাই সুমন,গলায় ক্যামেরা ঝোলানো
-কোথায় ছিলিরে দিদিভাই এতদিন ?
-শ্রীমতির চোখে জলের বন্যা
-আমরা তোকে সব জায়গায় খুঁজে বেড়িয়েছি? আমার পোড়া কপাল রে ভাই ?
বিনুদাকে তুই বিয়ে করেছিলি না ?তোর বিয়ের তিনমাস পরে সে মারা যায় এক্সিডেন্টে?
-তারপর তোকে খুঁজে কোথাও পাইনি
পাবি কি করে? আমাকে তো কানা গলিতে বেচে দিয়ে গেছে। তখন আমি দুই মাসের গর্ভবতী। ছেলে আছে একটা, রামকৃষ্ণ মিশনে পড়ে ।
ও জানে আয়ার কাজ করি নার্সিংহোমে, এই মাধ্যমিক পাশ করলো।খুব ভালো রেজাল্ট করেছে।
কানা গলির দামিনী মাসির কাছে আমাকে বিক্রি করেছিল সে আমাকে সাহায্য করেছে ছেলের জন্য।সেও বিক্রি হয়ে এসেছিল।
তিনি আমাকে মেয়ের মত দেখে আমি পেশায় যৌনকর্মী রে ভাই,মা’বাবা কেমন আছে?
– পিসেমশাই মারা গেছে,পিসি একা আছে,দেখবে কে বল ?তুই তো তার একমাত্র সন্তান। আমিই যাই,এখনো তোর অপেক্ষায় আছে এখন ও–
-শ্রীমতীর চোখের জলে,যেন সব পাপ ধুয়ে যাচ্ছে।তুই বাবুকে নিয়ে মায়ের কাছে দিয়ে আয়।তুই বাড়িতে কাউকে বলবি না। আমি কি কাজ করি।
-তোকে পেয়ে নিশ্চিন্ত হলাম। আমি বাড়িতে আর কোনদিন যাব না, তুই ছেলেটাকে দেখে রাখিস।
ও জানেনা , আমি কি কাজ করি।
-বাড়ি এসে কাঁদতে কাঁদতে বলল মাসি ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।
-খুব ভালো কথা রে মা, কি বললি তাহলে?
আমার তো দিন শেষ হয়ে এসেছে তারপর তোকে কে দেখবে ?
ছেলে যদি জানতে পায় তোর কথা তুই কি কাজ করিস, তোকে দেখবে ?
এখনকার ছেলে। কাল কথা বলিস যা এখন খেয়ে দেয়ে শুয়ে পর।
-আজ অনেকদিন পর শিশু বয়সের কথা মনে পড়ে গেল, মার কাছে শুনেছিল সে যখন জন্মেছিল বাবা খুব খুশি হয়েছিল বলছিল আমার রাজকন্যা।
ঠাকুরমা বলেছিল দেখিস রাজকন্যা আবার যেন পণ্যে পরিণত না হয়। অলক্ষী একটা জন্মেছে। আমার পোড়া কপাল।
সত্যিই ঠাকুমার কথা বিফলে যায়নি আছে সত্যি পণ্য।
ঠাকুমার ছিল দুই চোখের বিষ বলতে মেয়ে সন্তান আদিখ্যেতা কম করবে। ছেলে হলো না হলে বুঝতাম মেয়ে আমার কি কাজে লাগবে। পরের ঘরে যাবে।
এদিকে যখন আমি জন্মাই ডাক্তার বলেছিল মাকে, আর সন্তান তো হবে না।
তাতে ঠাকুমা খেপে লাল, আমার সঙ্গে সব সময় ঝগড়া অশান্তি লেগে থাকতো। ছেলে সন্তানের জন্য বাবাকে বিয়ে করার জন্য বলেছিলে। বাবা আমার মাকে এতো ভালোবাসে সে আর রাজি হয়নি।
বাবা বলতো আমার কপালে ছেলে নেই তাহলে প্রথম সন্তানই ছেলে হতো। এ নিয়ে আমার কোন সমস্যা নেই।
তবে বাবার ছিলাম চোখের মনি, সব দিকে পারদর্শী ছিলাম আমি
কোথা থেকে যে কি হয়ে গেল জীবনটাই বৃথা গেল।
বাবার ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করেছিল। বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের আপত্তি ছিল।
কাকা বলেছিল বাড়িটা তার নামে লিখে দিতে। ঠাকুরদা এক সময় বাবা কাকার নামে সম্পত্তি লিখে দিয়ে গেছিল আলাদা করে।
মেয়ে সন্তান বিয়ে হয়ে যাবে পরের ঘরে যাবে পরের বাড়ির ছেলে এসে ভোগ দখল করবে। এটা পৈত্রিক সম্পত্তি।
মায়ের খুব খারাপ লাগতো। আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে কাঁদতো। বাবা বলতো আমি তো আছি, আমি সব কিছু ব্যবস্থা করে দিয়ে যাব আমার অবর্তমানে তোমার কোন কষ্ট হবে না। আমি তো সরকারি চাকরিও করি। আমি মারা গেলে তুমি পেনশন পাবে।
ঠাকুমার মায়ের হাতে খেতো না ছেলে সন্তান হয়নি বলে। কাকার সঙ্গেই থাকতো ঠাকুমা, তার একটা ছেলে।
-নিত্য নতুন অশান্তি লেগেই থাকতো ঘরে। একদিন বাবা গিয়ে তার সম্পত্তি মাও আমার নামে দলিল করে দিল।
সেই থেকে দুই পরিবারের মধ্যে মুখ দেখাদেখি বন্ধ উঠনের মাঝখান থেকে বড় পাঁচিল হয়ে গেল।
কেউ কারো মুখ দেখেনা। ঠাকুমা মারা গেলে তার মুখটা বাবাকে দেখতে দেয়নি কাকা।
-কলেজে যাওয়ার সময় বিনুদার সঙ্গে পরিচয়। খুব সুন্দর নায়কের মত চেহারা দেখে আমার ভালোই লেগেছিল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতো।
-সাইকেলে করে আমাকে রোজ কলেজে পৌঁছে যেতে নিয়ে আসতো।
-আমাকে একদিন বলল আমাকে খুব ভালোবাসে। আমার মাথায় এটা ঢোকেনি যে সে কি কাজ করে বাড়ি কোথায়? কিছুই না জেনে ভালবেসে বসলাম।
-মা জানতে পেরে বকাবকি করেছিলে, আমি অস্বীকার করেছিলাম, মা জানতো বিনুদা ভালো না।
-আমি প্রেমে অন্ধ। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম ঘরে দরজা বন্ধ করে থাকতাম। বললাম বিয়ে করলে বিনুদা কে করব।
-শেষে মা হার স্বীকার করে বলেছিল ভাল বাসছিস বাস, ও ছেলেটা ভালো না কিন্তু। নিজে কষ্ট পেলে বুঝবি, তবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে চাকরি কর তারপর বিয়েটা করিস।
-এরপর থেকে মা আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল, আমিও আর কথা বলতাম না।
-বাবা খুব কষ্ট পেয়েছিল আমার এই সিদ্ধান্তে। বলেছিল মামনি একদিন বুঝবি যখন আমি থাকবো না।
-ভেবেছিলাম মেয়ে সন্তান মানুষের মতো মানুষ করব। পাঁচজনকে দেখিয়ে দেব মেয়েরাও পারে।
-আজ চোখের জলে বালিশ ভিজছে, বাবার কথা খুব মনে পড়ছে, অনেকদিন পর বাবার মৃত্যুর খবর শুনে। ভাই আসবে কাল বাবার মন্ত্র পড়তে হবে। সেই কথা ভেবে সারারাত ঘুম হলো না।
-সুমন সব শুনে এসেছে ব্রাহ্মণের কাছ থেকে, সকাল থেকে সে হাজির দিদিকে নিয়ে বাগবাজার যাবে গঙ্গার পারে শ্রাদ্ধ শান্তি সারবে।
-মৃত্যুর সময় পিসেমাসের মুখে সে জল দিয়েছিল বলেছিল মামনিকে একটু এনে দিবি আমার কাছে, মেয়ে মেয়ে করে তার প্রাণ ত্যাগ হলো, মৃত্যুর পরেও দেখা গেছে চোখ দুটো খোলা। মনে হয় মামনিকে খুঁজছিল।
-আজ শ্রীমতির সারাদিন গঙ্গার ঘাটে চলে গেল, মন্ত্র পড়ে বাবার কাজ করলো,
সুমন বলল দিদি? এত দিনে মনে হয় পিসুর আত্মার শান্তি পেয়েছে।
-সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি সে দেখল , পান চিবাতে চিবাতে অবনী বাবু এসেছে।
-সুমন কে বসে থাকতে দেখে বলল তুমি কে গো ছোড়া ? এখানে কি মনে করে।
– শ্রীমতি বলল আমার মামাতো ভাই।
তা এতদিন পর এখানে কি মনে করে।
-আপনি না জেনে শুনে কোনরকম মন্তব্য করবেন না। আপনি আমার দিদির সম্পর্কে কি জানেন? ও কত বড় বাড়ির মেয়ে আপনার ধারনা আছে ? কলকাতা শহরে ওর তিনতলা বাড়ি আছে । এই পথে কি করে এসেছে আপনি জানেন ? কোনদিন কি জিজ্ঞাসা করেছেন ?
-তিনি চুপ করে রইলেন , মনে মনে ভাবলেন সত্যিই তো মেয়েটা তো আর পাঁচটা পতিতা মেয়ের মতো না, চালচলন স্বভাবে একটু অন্যরকম। হে হে করে হেসে বললেন তা বল শুনি।
-সুমনের সব কথা শুনে মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। বললেন তুমি তো কোনদিন বলোনি এসব ।
শুনতো তো চাননি কোনদিন।
ভাই তোমার দিদির এত ঘটনা আমি জানিনা আসলে শুনতে চাইনি কোনদিন এই লাইনটা তো বড় খারাপ।
তবে তোমার দিদি জীবনের দ্বিতীয় পুরুষ বলতে আমি তাকে আমি অন্য কারোর কাছে যেতে দেয়নি। বিয়ে করিনি পরিবার আছে বলে তবে আমার কথা শুনে সে সব সময় চলেছে।
-দামণী মাসি বলল আমি সব জানি, আমি ওকে সেই জন্য অন্য কোন পুরুষের সাথে মিশতে দেয়নি আমি এইভাবে এসেছিলাম বলে। একজনকে তো বাঁচাই।
-তবে একটা মেয়ের স্বামী মরে গেলে দ্বিতীয় বিবাহ সে করতেই পারে সেটা নিয়ে কোন ঝামেলা হয় না।
-তবে তুমি ওকে ওর মার কাছে নিয়ে যাও আমি তো বেশি দিন বাঁচবো না আমার ক্যান্সার ধরা পড়েছে।
-তবে মাসি আমার একটা অনুরোধ আছে তুমি এই বাড়িটা আমার নামে লিখে দিয়েছো এর বাড়িটা এখানে যত অনাথ শিশু থাকে তাদের নামে লিখে দাও।
-মাসির চোখে জল টলটল করছে, ঠিকই বলেছিস মা। আমি তোকে ঠিক চিনেছিলাম।
-অবনী বাবু বলল তবে এই লাইনে অনেকে মেয়েরা সমস্যায় পড়ে আসে। আমিও এখানকার অনাথ শিশুদের জন্য একটা স্কুল খুলে দেবো। পড়াশুনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে।
-সুমন বললো আমি সব রকম সহযোগিতা করব। তবে দিদি মাসিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে চল। পিসিমা তোর অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছি। তোর কথা বলেছিলাম,বলেছে ছেলেটাকে আর মামনিকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে আয়।
-এরপরে শ্রীমতি দামিনী মাসী ছেলেকে নিয়ে তার মায়ের কাছে চলে গেল।