রঙবদল
কলমে- মধুমিতা দেব
Deb Villa, 148/6 Mali Bagan, Lane no. 7, Kaikhali, Kolkata- 700052
ঠান্ডাটা একটু কমে এসেছে।ভোরের দিকটা একটু শীত শীত করে যদিও,তবু হালকা একটা চাদরেই কাজ মিটে যায়।ভোরের এই মিষ্টি আলো আর পাখিদের কল-কাকলি বড় প্রিয় সুরমার।রোজ ভোরের বেলাতেই বিছানার সাথে সম্পর্ক শেষ করে বারান্দায় বসে ও।বরাবরের অভ্যাস,সেই ছোটবেলায় বাপের বাড়ি থাকতেই অন্ধকার থাকতে,ঘুম থেকে উঠে পড়ত।অবশ্য তখন এলার্ম দিতে হত।ভোরে নিয়ম করে প্রায় ঘন্টা দুয়েক রেওয়াজ করে,ছাদে গিয়ে ওর প্রিয় ফুল আর গাছেদের সাথে সময় কাটাত।গাছের পরিচর্যা করা,জল দেওয়া সবই নিজের হাতেই করত।অবশ্য এই সময় ছাদে যাওয়ার অন্য আকর্ষণও ছিল সুরমার…ওর দাদার বন্ধু অজয় দা। ওদের পাশের বাড়িটাই ছিল অজয়দের।সুরমার দাদা সমরের খুব বন্ধু ছিল অজয়।লেখাপড়ায় তুখোড় অজয় প্রায়ই দাদার সাথে ওদের বাড়ীতে আসত।পড়াশোনার সাথে জমিয়ে আড্ডাও চলত। সেই সময় সুরমা দাদার ঘরে গিয়ে চা-জলখাবার দিয়ে আসত মাঝে মাঝে। সুরমা বাহানা খুজত ও ঘরে যাওয়ার। কিন্তু যার জন্য বাহানা খোঁজা, সে তো পাত্তাই দিত না সুরমাকে।রোজ ছাদে বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে পড়ে থাকলেও, একটা বারের জন্যও সুরমার দিকে তাকাতোও না অজয়।
-“বৌদি….ও বৌদি”…. “একটু দেখ না,বনি দিদিমনিরা এখনও উঠছে না কেন?”
বকুলের কর্কশ চিৎকারে,চমক ভাঙল সুরমার।
এই এক ঝামেলা!প্রায় দিনই মেয়ে দুটো রাত জেগে কি করে যে ছাই,সকালে তেনাদের ঘুমই ভাঙেনা।একটু বিরক্ত হয়ে সুরমা বলল, “ঘুমাচ্ছে ঘুমাক না,তুমি একটু ঘুরে এস না হয়।”
-“এই করি,রোজ এই করে আমার দেরী হয়…” গজগজ করতে করতে বকুল ছুটল অন্য বাড়ীর কাজে।
বনি আর তমশ্রী, এই দুজন আটমাস হল ভাড়া থাকে সুরমার বাড়ির একতলাতে।বছর দুই আগে অঙ্কুশ যখন চিরদিনের মত ছেড়ে চলে গেল,তখন রূপসা আর অর্ক ব্যাঙ্গালোরে। বাবার চলে যাওয়ার পর, সুরমাকে একা রেখে কিছুতেই যেতে চায়নি সে,মাকে ওদের সাথে নিয়ে যেতে চেয়েছিল ব্যাঙ্গালোরে,অর্কও অনেক বুঝিয়েছিল।কিন্তু সুরমাই মেয়ে জামাইকে বুঝিয়ে ফিরে যেতে বলে।বলেছিল,”আমার আর ক দিন… এ কটা দিন এই স্মৃতির সাথেই আমাকে কাটাতে দে তোরা।”
প্রথম দিকে খুব একা একা লাগত,কখনও কখনও ভুল করে দু কাপ চাও বানিয়ে ফেলত।ভালবাসার টান না অভ্যাস…কে জানে?বিয়ে হয়ে পর এ বাড়িতেই আসা অঙ্কুশের হাত ধরে।তখন শাশুড়ি-মাও বেঁচে।ওর ননদ রেখার তখন বিয়ে হয় নি।দেবর অঙ্কুর আর তার স্ত্রী সুনীতাও এই বাড়িতেই থাকত।পুরো বাড়ীটা তখন লোকজনে গমগম করত। এরপর এক এক করে, রেখার বিয়ে হল, অঙ্কুর সস্ত্রীক পারি দিল বিদেশে,রূপসা আর অর্কের
চারহাত এক হয়ে যাওয়ার পর,অর্কের চাকরি সূত্রে দুজনেই চলে গেল ব্যাঙ্গালোরে। শাশুড়ি মাও গত হলেন আর অঙ্কুশ চলে যাওয়ার পর হারাধনের একটি সন্তানের মতো টিম টিম করে জ্বলতে থাকল শুধু সুরমার জীবন প্রদীপ।আগে স্থান সংকুলান হত না, আর এখন যেন ফাঁকা বাড়ীটা গিলে খেতে আসে।তবু মায়া কাটানো কি অতই সোজা…কত স্মৃতির টুকরো ছড়িয়ে চারদিকে।মা-বাবার ইচ্ছেকে সন্মান দিয়েই সেদিন অঙ্কুশের সাথে বিয়েতে মত দেয় সুরমা।সেইসময় দুচোখ বন্ধ করলেই তার মুখটা ভেসে উঠত সামনে।সেই বসন্ত-পঞ্চমীর দিন সকালবেলা,তখন ষোড়শী সুরমা দশম শ্রেণীর ছাত্রী,একটা হালকা বাসন্তী রঙের শাড়ী, হালকা লিপস্টিক আর কোমর ছাপানো এলোচুলে, একটা হলুদ চন্দ্রমল্লিকায় ওকে মা সরস্বতীর মতই লাগছিল।ও স্কুলে যাওয়ার তাড়ায় তাড়াতাড়ি বেরোচ্ছিল বাড়ী থেকে,হঠাৎই সামনে দেখল একজোড়া মুগ্ধ চোখ ওর দিকে তাকিয়ে আছে।ওর চোখে চোখ রেখে বলে অস্ফুটে বলে উঠল,”কি অপূর্ব সুন্দর লাগছে তোমায়…”
এই কথাটাই তো ওর কাছ থেকে এতদিন শুনতে চাইতো সুরমা।কিন্ত আজ অজয় দা-র মুখে কথাটা শুনে সারাগায়ে কাঁটা দিয়ে,লজ্জায় মুখ লাল হয়ে উঠল।”ধ্যাৎ,কি যে বল!” বলে,দু হাতে মুখ ঢেকে ছুটে পালাল সে।এর পর থেকেই অজয়ের চোরাদৃষ্টি মাঝে মাঝেই অনুভব করত।সুরমা ছাদের গাছগুলোকে আরো বেশী করে পরিচর্যা করা শুরু করল।এভাবেই চলছিল বেশ কয়েক বছর….চোরাচাউনি, একটু দেখা,একটু ছোঁয়ার বেড়া পার করে যখন সুরমা অষ্টাদশী তখন অজয় দা নিজে স্নাতকোত্তর পড়ার সাথে সাথেই টিউশনি করছে। সেইদিন সুরমাকে দেখতে আসার কথা ছেলের বাড়ি থেকে।সে ছুটে যায় ওর অজয় দার কাছে।এতদিনের অব্যক্ত কথা অকপটে জানায় তাকে।কিন্তু এ কথা কি অজয় জানত না?সে তো জানত সবই,
গরীব ঘরের বেকার ছেলে,তার উপর নীচু জাত, সুরমাদের বাড়িতে মেনে নেবে কেন? সুরমা অজয়ের দু হাত ধরে বলেছিল, “চল, পালিয়ে যাই দুজনে।”
অজয় মাথায় হাত রেখে বলেছিল, “না, চোরের মত পালালে, পুরো পরিবার ছোট হয়ে যাবে।বাবা মা-য়ের সন্মানের কথা একবার ভাবত।তার চেয়ে ক দিন সময় নিয়ে বাড়িতে বুঝিয়ে বল।”
না, বোঝানো যায়নি কাউকে, মা-বাবা সকলের সন্মানের কথা ভেবে বড়লোক বাড়ীর সরকারী চাকুরে অঙ্কুশের সাথেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হল আর ধুসর থেকে ধুসরতর হয়ে মিলিয়ে যেতে লাগল সুরমার কৈশোর-প্রেম।কিন্তু সত্যিই কি মিলিয়ে গেল?হৃদয়ের এক কোনে যত্ন করে কি রাখা নেই ওই শুকনো গোলাপটা?হয়ত ভালই হয়েছে, সংসারের জটিলতায় হয়ত বা মূল্যহীন হয়ে যেত প্রেম….
বকুলের দরজা নাড়ার শব্দে ঘোর কাটল সুরমার।নীচের বনিদের ঘরে ঢুকল।এই মেয়ে দুটো বেশ ভাল,কোন ঝুটঝামেলা নেই,কোন বন্ধুদের নিয়ে পাড়া কাঁপিয়ে আড্ডা মারা নেই,ঘরে যখন তখন কোন ছেলে বন্ধুদের নিয়ে আসা নেই,এরা শুধুমাত্র দুজনের জন্যই।প্রথম যেদিন ওরা আসে,সে দিন সুরমা কড়া ভাষায় ওদের সব নিয়মাবলী বুঝিয়ে দেয়।আরো বলেছিল, বেচাল দেখলে সাথে সাথেই বের করে দেবে। কিন্তু, ওদের বেচাল দেখা তো দূর,ওরা এত মিশুকে আর মিষ্টি ব্যবহার যে কোন অভিযোগ-ই থাকে না।সময়মত মাসের ভাড়াটাও দিয়ে যায়।বনি সল্টলেকে আই টি সেক্টরে কাজ করে,আর তমশ্রী একটা বেসরকারী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ায়।রোজ সারে ন টা নাগাদ বনির স্কুটিতে দুজনে বেড়িয়ে যায়।বনি, তমশ্রীকে ওর স্কুলে রোজ ছেড়ে দেয় আবার রাতে একসাথেই ফেরে। যাওয়ার সময় রোজ সুরমাকে হাত নেড়ে যায়।ছুটির দিন বেশ নতুন নতুন রান্না করে আবার সুরমাকে দিয়ে যায়।এই প্রাণবন্ত মেয়ে দুটোর উপর বেশ মায়া পরে গেছে ওর।
সাড়ে নটা বেজে গেছে।এখন ঘড়ি দেখার দরকার হয় না সুরমার। বনি স্কুটি বের করে হাত নাড়ল, দুটো ব্যাগ হাতে তমশ্রী বেরিয়ে এসে, স্কুটিতে উঠল,তারপর সুরমাকে বিদায় জানিয়ে ঝড়ের বেগে দুজনে চলে গেল।ওরা যাওয়ার পর বকুল এসে কাজ শুরু করল।সুরমা রান্নাটা নিজেই করে,একা মানুষ,যা হোক একটু ফুটিয়ে নিলেই হল।বকুল শুধু বাকী কাজগুলো করে।তাতেই ওর বাজে বকবকানিতে ওর মাথা ধরে যায়।এ বাড়ি,ও বাড়ির সমালোচনা,এখন আবার নতুন শুরু হয়েছে, বনি-তমশ্রীদের গল্প।ওরা ঘর নোংরা করে, আজে বাজে জিনিস খায়, বেলা করে ওঠে….ওর বকবকানি শেষ হলেই সুরমা বোঝে ওর কাজ শেষ হল,ঘড়িতে ঠিক এগারোটা বাজল।
বকুল চলে গেলে ছোট হাঁড়িটায় একমুঠো চাল বসাল,সাথে দু-এক কুচি পেঁপে, গাজর, বিন ছেড়ে দিল।ফুটে উঠলে,ফ্যান ঝড়াতে দিল বড় গামলায়।সুরমা গীজারটা অন করে দিল,স্নানটা সেরে নেবে এবার।আজ একবার বুবলুর কাছে যাওয়ার ইচ্ছে আছে।বুবলু ওর দাদার ছেলে।
আবার কলিংবেলটা বেজে উঠল।একটু অবাক হল সুরমা,এ সময়ে আবার কে আসবে? সেলসম্যান?কে জানে…
দরজা খুলে দ্বিগুন বিস্ময়ে চমকে উঠল সুরমা।চুলে পাক ধরেছে, বয়সের ভারে স্থূলতাও বেড়েছে বেশ কিছুটা কিন্তু চিনতে অসুবিধা হয় না।অপর পক্ষের চোখেও বিস্ময় কিছু কম ছিল না।সে ঘোরের মধ্যেই বলে উঠল, “সুর!তুমি এখানে?এ কি অবস্থা!”
প্রাথমিক ঘোর কাটলে,অজয় মোবাইলে তমশ্রীর ছবি দেখাল সুরমাকে।
-“চেন একে?”
-“হ্যাঁ, কেন?কি হয়েছে?”
এক অমঙ্গল আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠল সুরমার।
-“তমা আমার মেয়ে।বছরখানেক আগে বাড়ি থেকে পালিয়েছে।আমার এক বন্ধু কিছুদিন আগে এখানে ওকে দেখতে পায়,সেই ওকে ফলো করে এই অ্যাড্রেস আমাকে বলে।”
-“পালিয়েছে?”অবাক হয় সুরমা।
-“পালাল কেন?এত ভাল মেয়ে তোমার অজয় দা…”
-“কি আর বলি সুর, আজকালকার মেয়ে, আমাদের পছন্দে বিয়ে করতে চায় নি,তাই….”
কথা শেষ হলনা অজয়ের,তার আগেই মুখ ঝামটা দিয়ে সুর বলল, “বেশ করেছে,আর কত কম্প্রোমাইজসড করবে?সবার মান রাখতে আমাদের অবস্থা দেখ…ওদের নিজেদের খুশিতে বাঁচতে দাও অজয় দা।ওর পছন্দের ছেলের সাথেই ওর বিয়ে দাও না….”
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অজয় অস্ফুটে বলল, “পছন্দের ছেলে হলে তো কথাই ছিল না, কিন্তু এ যে পছন্দের মেয়ে….”
বিস্ফোরিত চোখে তাকাল সুরমা….
অস্ফুটে বলল,”বনি…!”
দু চোখ দিয়ে অজান্তেই জলের ধারা নেমে এল।
দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ নীরব হয়ে থাকল।সুরমাই নীরবতা ভাঙল…
-“অজয় দা,দুনিয়া বদলে গেছে,আমাদের ভালোবাসা, আমাদের আত্মত্যাগের দিন আর নেই গো….আর এই আত্মত্যাগে কিই বা পেয়েছি আমরা। অথচ দেখ, আমাদের বিয়ের পর যাদের জন্য আত্মত্যাগ তারা কতটুকু সঙ্গ দিয়েছে আমাকে? এ বাড়ির কোন সমস্যার কথা বললে,
মানিয়ে চলার কথাই বলে গেছে সবাই। সমঝোতাতেই এত বছর কাটল….ভালবাসা ছিল কতটুকু?তোমার কথা তো জানি না,কিন্তু আমি যে সারাজীবন একটি মানুষকে ঠকিয়ে গেলাম….এই পাপের ভাগীদার তো আমিই….
তাই, তমশ্রীকে আর আমার মত পাপের ভাগীদার কোর না, একসাথে তিনটে জীবন নষ্ট হবে।তারচেয়ে ওর পছন্দের মেয়ের সাথেই ওকে থাকতে দাও। একবার আত্মত্যাগ করেছিলে মা-বাবার সন্মানের জন্য, সন্তানের জন্য না হয় আর একবারটি আত্মত্যাগ কর….”
আর কোনও কথা বলতে পারল না অজয়।শুধু একটা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে চোখ থেকে দুই ফোঁটা জল সুরমার হাতের উপর।
210 total views, 4 views today