বায়োলজিক্যাল মাদার
✍️ – কলমে: সোনালী মুখার্জী
আড়ুপাড়া,সাঁতরাগাছি,হাওড়া
ডায়েরিটার পাতা উল্টে দেখতে দেখতে সব মনে পড়ে যাচ্ছে,চোখের কোলে জল চলে এলো সব ঝাপসা লাগছে অনুপমা দেবীর।প্রত্যেকটা পাতায় হাত বুলিয়ে চলেছেন, ঘটনা চোখের সামনে।
নববধূ রূপে সাদা কাপড়ের উপর আলতা পায়ে গৃহে প্রবেশ।কত আশীর্বাদ,কত মানুষের কত রকমের কথা কানে যেত লাগলো।সব কথা মনে গাঁথলে বাড়িতে বাস করা যাবে না।তোমাকে বাড়ির সকলকে ভালো রাখার দায়িত্ব নিতে হবে তোমার তুমিকে ভুলে যাও।
স্বামী সে তো সবার মাঝেই একজন। খুব ভালো বিনা পয়সার একজন দাসী আনতে গিয়েছিলেন।বৌভাতের রাতে তাঁর কথা ছিল যে,আমার বাড়ির লোক তোমার বাড়ির লোক।এদের সম্বন্ধে কোন কথা তুমি আমাকে বলবে না। অনুপমা দেবী বললেন,এরা তোমার আমার নিজের লোক এদের সুবিধা অসুবিধার কথা বলবো না?
আমি বলছি,তুমি তো সবার শেষে ঘরে ঢুকবে। তাই বাড়িতে কী হলো আর না হলো ওসব কথা বলার জন্য আমার ঘুম ভাঙাবে না। সকালে শাঁখ বাজলে তুমি তো আমার আগেই বাইরে বেড়িয়ে কাজ করবে।দিনের বেলা আমার সাথে কথা হবেই না।তুমি কাজের মধ্যে সকলের সাথে কাটাবে।আমি তো দুপুরে দুটো খেতে আসবো।
অনুপমা দেবী আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছলেন। এত শৌখিন মেয়ে তার কী হলো?বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বন্ধুদের বিয়ের যে গল্প শুনেছিলেন নিজের বিয়ের সাথে মিলিয়ে দেখলেন আকাশ পাতাল তফাৎ। এখানে শুধু সংসারের কাজ,বাড়ির বড়োদের সেবা আর ছোটদের যত্ন করো।কাপড় কাচো,বাসন মাজো,আনাজ কাটো,খেতে দাও,পুরো বাড়ি ধোয়া মোছা করো।তুমি কী খাবে,কী খেতে ভালোবাসো সেদিকে কারো নজর নেই।অথচ একটু কাজের এদিক ওদিক হলেই ছোট থেকে বড়ো সবাই কথা বলবে।স্বামীর তো প্রশ্ন ই নেই,একটা পরের মেয়েকে এনেছে তার সুবিধা অসুবিধা দেখার লোক তিনিই তো।অথচ কত উদাসীন।
এদিকে অনুপমা দেবী বাচ্ছাদের ভীষণ ভালোবাসেন,বাচ্ছারা তাঁর অনুগত।কিন্তু তাদের মায়েরা তাতে সন্তুষ্ট নয়।বাচ্ছাদের কানে কী বিষ ঢেলেছে ওরা সব সময় অনুপমা দেবীর কাছে থাকে।থাকতে ভালোবাসে।আসলে অনুপমা দেবী যখন বিস্কুট দেন হাতে দেন কারো মুখের দিকে দেখতেন না।সেই সুযোগ ওরা কাজে লাগাতো একজন দুবার ছেড়ে তিনবার ও বিস্কুট নিয়ে যেত। একদিন অনুপমাদেবী বিস্কুট বেশি খরচ করার জন্য ভীষণ অপমানিত হলেন।তারপর আর ভুল হতো না। বাচ্ছারা ভালো কিছু রান্না হলে বার বার চাইতো। উনি না করতে পারতেন না।এই নিয়েও ওনাকে ভীষণ অপমানিত হতে হয়েছে।বাচ্ছাদের খাবারের দিকে,পড়াশোনা,শরীর খারাপের দিকে ভীষণ খেয়াল রাখতেন। বাচ্ছাদের খুব ভালোবাসতেন।বাচ্ছারা ও।যে যতই বাজে কথা বলুক না কেন অনুপমা দেবীর মুখ দিয়ে কোনকথা বের হতো না। স্বামী তো নিজে যখন জেগে উঠতেন তখন যতটুকু নিজেদের মধ্যে সময় কাটাতেন তবে তেমন কোনো আগ্রহ তাঁর ছিল না।এমন টা নয় যে অন্য কোথাও কোন সম্পর্কে জড়িয়ে ছিলেন।আসলে ওনার প্রকৃতি টাই ওই রকম। সম্পর্কের গভীরতা থাকতো,মাখামাখি থাকতো না। এমন ভাবে পরিশ্রম করতে করতে অনুপমা দেবী অসুস্হ হলে বাপের বাড়ি পাঠানো হলো।
কেবল জল বমি।ডাক্তার এসে বললো,লিভার ক্যান্সার।একটা ইনজেকশন দিয়ে হসপিটালে ভর্তি করার কথা বললেন। অনুপমা দেবী জ্ঞান হারিয়েছেন।ঐ অবস্হায় তাঁকে ভর্তি করা হলে,ডাক্তার বললেন,রোগী মেরে এখানে আনবেন তারপর ভাঙচোর করবেন। এখুনি ওটি দিতে হবে।রক্ত রেডি করবেন।যে কোন সময় রোগী ডেড হয়ে যেতে পারে।বাহাত্তর ঘন্টা সময় দিলাম।
ও টি তে নিয়ে গেলো।শুক্রবার ভর্তি হলো,মঙ্গলবার ডাক্তার বাবু অনুপমা দেবী ব্যারিকেড খুলে আস্তে আস্তে তুলে বললেন,তুই শুক্রবার অজ্ঞান অবস্হায় ভর্তি হ য়েছিস,আজ মঙ্গলবার তোর অপারেশন হ য়েছে,ব্লাড,অক্সিজেন,স্যালাইন চলেছে।গতকাল রাতে তোর একটু একটু করে জ্ঞান এসেছে।কী হ য়েছে তোর জানিস?না ডাক্তারবাবু।তোর এক্টোপিক প্রেগনেন্সী হয়েছে।প্রেগনেন্সী?আমি জানি না তো? ডাক্তারবাবু বললেন,সব যদি তোরা জানবি তাহলে আমরা জানবো কী?
তোর ফ্যালোপিয়ান টিউবের ভিতর বেবী এসে ব্লাস্ট করে ছে।এই রকম ঘটনা একলক্ষে একজনের হ য়।আমি একটা টিউব বাদ দিয়েছি।অপর টিউব দিয়ে বেবী আসবে বলে ডাক্তার বাবু চলে গেলেন।
বাড়ির লোক কাছে এসে কান্নাকাটি করলো,কেমণ যেন একটা কষ্টের তাকানো। ওদিকে আয়া দুপুরের খাবার খাওয়া হ য়ে গেছে ভেবে সব খাবার নোংরায় নামিয়ে দিয়েছে।যখন অনুপমা দেবীকে খাওয়ানোর কথা হলো তখন উনি বললেন,আমি আনছি খাবার,ক্যান্টিন থেকে মাছ ভাত আনলেন।অনুপমা দেবীকে আদর করতে করতে তাঁর ভুলের কথা জানালেন।
বিকেল থেকে সবাই দেখতে এলো।শ্বশুর বাড়ি থেকে কেহ আসেনি। তাদের মধ্যে একজন বললো,তোমার আর বাচ্ছা হবেনা।
স্বামী র কাছে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন অনুপমা দেবী। উনি বললেন,কে কী বললো কানে নিওনা।ডাক্তারের কথা শোন।
সবাই চলে আসার পর অনুপমা দেবী নার্সের টেবিলে গিয়ে সরাসরি জানতে চাইলেন তাঁর কী হয়েছে? নার্স সব এঁকে বুঝিয়ে দিলেন কী হ য়েছিল।এখন কী করা উচিত।চিন্তা না করে একবছর কাটলে বেবী আনার চিন্তা করতে তবে বসে থাকা নয় সবটাই ডাক্তারের পরামর্শ মতো।
ছুটি হলে অনুপমা দেবী বাবার বাড়ি এলেন।এদিকে শ্বশুর বাড়ি থেকে বলে গেছে নিশ্চই বাচ্ছা নষ্ট করেছে নাহলে এসব হবে না।শহরের উচ্চশিক্ষিত মেয়ে বাচ্ছা নিলে শরীর নষ্ট হবে তাই এত কান্ড।
এরা বাচ্ছা নষ্ট ছাড়া আর কিছু তো জানে না।কেই বা জানতো যদি না অনুপমা দেবীর এই ঘটনা ঘটতো।শুনতে হবে,জানতে হবে।নিজেরা সব জানি ভাব একটা ওদের।শরীরে কত রকম জটিল বিষয় আছে আমরা তার কতটুকু ই বা জানি।
এরপর শ্বশুর বাড়ি গেলে সকলের এক কথা যা হবার একটা হ য়ে যাক।দিলে দিক নাহলে বুক বাঁধুক।জঠরের জ্বালা ও আর কী বুঝবে?নানা রকম কথা,পেটে না খাওয়া নিত্য দিনের কাজ শুরু হলো।সংসারের অতো কাজ করতে করতে ব্লিডিং শুরু হলো। এবার আরো যন্ত্রণা কাজ করতে না পারলে যে যার খেয়ে নিত।খেতেও ডাকতো না। না খেয়ে খেয়ে শরীর দূর্বল হ য়ে গেলো নূতন উপসর্গ হলো নানাজনের নানা কথা শুনে সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হতে লাগলো অনুপমা দেবী।সে কী কান্ড।ওনার স্বামী কিছুই কী বুঝতেন না?ডায়েরিতে সব কথা লেখার অভ্যাস অনুপমা দেবীর।
এদিকে সেদিন সকাল থেকে শুরু হয়েছে মূর্ছা যাওয়া।ওনার স্বামী বাড়িতে ডাক্তার আনলেন।ডাক্তারবাবু বললেন,ওনার মানসিক সমস্যা।উনি ভীষণ দূর্বল।খাওয়ান ভালো করে।ওঁর সাথে ভালো করে কথা বলুন,ভালোবেসে জানতে চান ওনার কী হ য়েছে?কী চান উনি?
বাড়ির লোক এবার বলতে থাকে একটা পাগলের সাথে বিয়ে হ য়েছে।সব সময় ঘরে থাকতে ভালোবাসে।ওনার স্বামী কখনো খোঁজ নিতেন না অনুপমা দেবী খেয়েছেন কি না?
সেদিন রাত এগারোটা।ওনার স্বামী খাচ্ছিলেন তখন অনুপমা দেবী বললেন, তুমি তো আমায় বিয়ে করেছ। তুমি তো আমার দায় দায়িত্ব নিয়েছ।আজ ক’দিন খাইনি তুমি জানো?
ওনার স্বামী খাবার ফেলে চলে এলেন। সে রাতেই ডাক্তারের দেওয়া সমস্ত ওষুধ খেলেন অনুপমা দেবী।ডায়েরী বুকে নিয়ে শুলেন।গোঙানির শব্দ পেয়ে তাঁর স্বামী তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিয়ে গেলেন। ডায়েরিটাও ওরা ভুলে নিয়ে যান।
অনুপমা দেবীর জ্ঞান এলে ডায়েরী ডাক্তারের হাতে পরলো।ডাক্তার থানায় জমা দিলেন।অনুপমা দেবীর বাপের বাড়িতে কোন খবর দেননি ওনার স্বামী।পুলিশ মারফৎ সব জেনে অনুপমা দেবীর বাড়ির লোক থানায় ডায়েরী করতে গেলে থানায় বললো,আপনারা ডায়েরী করবেন করুন তবে একটু ভেবে করুন এরা সাজা পাবে আপনার মেয়ের সারাটা জীবন আছে।
অনুপমা দেবীর স্বামী বললেন,আমি এখানেই আত্মঘাতী হবো।পুলিশ বললো,আপনার স্বামী ধোওয়া তুলসী পাতা ন য়।
অনুপমা দেবীর বাড়ির লোক মেয়েকে নিয়ে গাড়িতে ওঠার সময় অনুপমা দেবীর স্বামীও গাড়িতে উঠলেন।
উনি বললেন, এতদূর হবে আমি বুঝতে পারি নি।ও সুস্হ হলে ওখানেই নিয়ে যেতাম আমি।
এরপর অনুপমা দেবী একটু একটু করে সুস্হ হতে থাকলেন।ডাক্তারি পরীক্ষা নিরীক্ষা চলতে শুরু করলো।
এবার ডাক্তার বাবু বললেন,সন্তান হবে তবে স্বাভাবিক উপায়ে নয়।বেবী স্বাভাবিক নাও হতে পারে,মা ও না থাকতে পারে তবে সবটাই ঈশ্বরের ভরসা।উনি চাইলে সব স্বাভাবিক হতে পারে।
অনুপমা দেবী বললেন,আমাদের একটা দত্তক সন্তান নাও।ওনার স্বামী বললেন,অনাথ কে অনাথ করার অধিকার আমাদের নেই।তাছাড়া আমার বাড়ির লোক এই বাচ্ছাকে টিকতে দেবে না।অনুপমা দেবী বললেন,বাজার থেকে ফুল এনে দেবতার পূজা করি।কেহ তো দেখিনা কোন গাছে ফুটেছে?
দ্যাখো,নিজের ছেলেমেয়ে বাবা মাকে দেখেনা সেখানে দত্তক সন্তান আমি নিতে পারবো না।
অনুপমা দেবীর সব দরজা বন্ধ।
উনি মা।ওনার মাতৃত্ব আছে নেপথ্যে। উনি বোকা।বোকাদের জন্য এই পৃথিবী বড়ই নিষ্ঠুর।একটু ভালো কথা পেলেই উনি ভাবেন সবাই ভালো।আসলে মানুষ যাচাই করার বোধ বুদ্ধি ওনার নেই।উনি নিজের মনে জানেন উনি মা।কার কখন কী দরকার অন্তরালে উনি আছেন।এক হাতে চোখের জল মুছতে মুছতে দেখলেন।সন্ধ্যা হয়ে গেছে।ডায়েরি টা বন্ধ করে ঘরের আলো জ্বালালেন।