জীবনের কথকতা

গল্পকার — নীলিমা বিশ্বাস পাল

৩৮ রাজা রামমোহন রায় রোড, মাইতি পাড়া, কলকাতা – ৪১

লীনা  নম্র ভদ্র সুন্দরী, সামনে তার হায়ার স্টাডির স্বপ্ন, বিয়ে টিয়ে এই মুহূর্তে তার ধরা ছোঁয়ার বাইরে।এই নিয়ে বাড়িতে মত বিরোধ হতে ব্যাগ গুছিয়ে সোজা হোস্টেল। অবশেষে সেই কাঙ্খিত দিন রেজাল্ট বের হলো, লীনা ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট লীনা আনন্দে আত্মহারা, কিন্তু তুহিনের নো পাত্তা। লীনা সবকিছু অগ্রাহ্য করে বন্ধুদের নিয়ে বড়ো রেস্তোরাঁয় খানা পিনা,হৈ হুল্লোড়ে কাটিয়ে দু পেগ প্রথম রেড ওয়াইন খেয়েছিল, কিছুটা দুঃখ কষ্ট ভোলবার জন্য, কিন্ত আপনারাই বলুন সামান্য দু পেগ ওয়াইন কি পারে দুঃখের অবসান ঘটাতে?

লীনার ও পারে নি—–

পরের দিন সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় সিনিয়র দাদাদের ফুলের বুকে, মিষ্টি চকোলেট নিয়ে অভিনন্দন জানানোর পালা।এর ই মাঝে এসে পড়ে তুহিন ও অর্ধেন্দু, লীনা এদের সাথে দেখা করে নি, আগে থেকেই সিকিউরিটি গার্ড কে বলে রেখেছিলো সে দেখা করবে না,যেন বলা হয় লীনা হোস্টেলে নেই —-

লীনা নিজেকে একটু সময় দিতে চেয়েছিল। লীনা অতীত প্রেম ভুলে এক ই সাথে বি,এড ও এম,ফিল কোর্সে ভর্তি হয়।এম,ফিলের প্রথম ক্লাস লীনা উপস্থিত থাকতে পারে নি,সে গিয়েছিল কসবা, অর্ধেন্দু র সাথে সব সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসার জন্য। লীনা ভীষন আপ টুডেট, লীনার চেহারার মধ্যে আভিজাত্য ছিল, পায়ে পয়েন্টেড হিল,হাতে ফাইল, পরনে নীল সিল্কের শাড়ি,করিডর দিয়ে যাবার সময় আলোকেন্দুর  সাথে তার পরিচয় হয়, তারা দুজনেই এম,ফিলের স্টুডেন্ট। অলকেন্দু কে দেখা মাত্রই লীনা কোন কারনে ভীষন হেসেছিল,হাসি যেন থামতেই চায় না,ওই যে আগেই বলেছি লীনার হাসিটা ছিল লোভনীয়,আর ওই হাসি ই তার জীবনের শনি হয়ে দাঁড়ালো। লীনা মন থেকে চায় নি, অলোকেন্দুর  সাথে প্রেম ও পরে জীবনসঙ্গী হতে! কিন্ত অদৃষ্টের লিখন —-

তিনবছরের পরিচয়ে বাবা মার অমতে লীনা ম্যারেজ রেজিস্ট্রেশন করে ফেলে,বিয়ের পর লীনা অলোকেন্দু যে প্রতারক, বিশ্বাস ঘাতক, বিভিন্ন মেয়ের সাথে অবৈধ নোংরামো সম্পর্ক এসব কিছু জানতে পারে যা লীনার পছন্দের বাইরে, লীনা কিছুটা জীবন কে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করায়।

লীনার বাপী মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে সব মেনে নেয়, এমনকি সব দায় দায়িত্ব পালন করে, তবুও অলোকেন্দু  সুযোগ পেলেই লীনার বাপী মাকে অপমান করে চলে। লীনা কনসিভ করে, মেয়ে সন্তান হয়,সব দায়ভার লীনার বাপীর, লীনার জীবনে তার বাপীই একমাত্র আদর্শ, বারবার বাপীর অপমান সহ্য করতে না পারায়, তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে আসে,এখন সে সম্পর্ক তলানীতে এসে থেমেছে।

লীনার বাপী গত হয়েছেন, লীনার মনের কথা শেয়ার করার আপনজনের বড্ডো অভাব।

লীনার মেয়ে ব্যাঙ্গালোরে  এম,বি,এ পড়ছে,আর লীনা কোলকাতায় একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জব করে, একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে একাই থাকে। অলোকেন্দুর  সাথে লীনার বিবাহ বিচ্ছেদ হয় নি, তবে কাগজে কলমে এখনো স্বামী স্ত্রী,এর বেশি কিছু না।

লীনা এখন সাহিত্য জগতে বেশ নাম করেছে, বিভিন্ন কবি সন্মেলনে মাঝে মাঝে দেখা হয় আমাদের,ও আমার ছোট্ট বেলার বন্ধু, আমি ও এখন মেয়েকে নিয়ে কোলকাতায় থাকি। মাঝে মাঝে আমি লীনার সাথে দেখা করি, কখনো শপিং মলে, কখনো রবীন্দ্র সদন, নন্দন চত্ত্বরে, আবার স্টার থিয়েটারে, খুব ভালো লাগে, আমরা সুখ দুঃখ শেয়ার করি।

লীনা যে সাহিত্যের আঙিনায় এসেছে এই নিয়েও কম অশান্তি করে নি তার স্বামী নামক রাহুটি। পুরুষেরা ভাবে তাদের ই একচেটিয়া অধিকার নারী কে অপমান লাঞ্ছনা বঞ্চনা করার?

হে পুরুষ জাতি সময় বদলেছে , তোমাদের থেকে নারীরা কোন অংশেই কম নয়,তোমরাই আজ নারীদের নীচে, নারীরা প্রমাণ করেছে নারী মুখ বন্ধ করে থাকে মানে নারীরা অবলা নয়, তারা আত্ম সম্মানের ভয়ে চুপ থাকে কোন কোন সময়—

আর হে নরাধম পুরুষ কান খোলা রেখে শোন তোমরা ই কেবল পরকীয়া করতে পারো না, আমরা নারীরাও পারি, ইচ্ছে মতো তার সাথে স্বাধীন ভাবে,আর ভয় আমরা পাই না,জীবন টাকে রঙীন স্বপ্নের তরী তে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে আগ্রহী।

নারী ভেঙ্গে ফেলো,হাতের রুলি, ভেঙ্গে ফেলো,পায়ের পরাধীনতার শৃঙ্খল, মুছে ফেলো, সিঁথির সিঁদুর।

ওঠো জাগো, অনেক হয়েছে পুরুষের কুক্ষিগত থেকে,কি পেয়েছো?

লীনা এখন খুব ভালো আছে,তার একমাত্র মেয়ে ঐশী কে নিয়ে, ক্লাব পার্টি গেট টুগেদার,লিভ টুগেদারের মাঝে।

লীনা এখন স্বাধীন, লীনা আর অলোকেন্দুর  রাস্তা বিপরীত মুখী। লীনা যোগাযোগ রাখতে চায় না,ও এটাতেই শান্তি পাই।ওর ইচ্ছেরা এখন আহত পাখির মতো ডানা ঝাপটায় না, বরং নীলাকাশে নিত্য নতুন সাজে মনের মতো,যার সাথে খুশি তার ই হাত ধরে মিষ্টি মধুর হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়।

………………………………………………………………………………………………………………

 

Loading