মন ভাঙার ব্যথা শারীরিক কষ্টের মতোই যন্ত্রণাদায়ক। মনে হয় যেন পৃথিবীটা এখানেই শেষ।
সত্যি বলতে হৃদয়ের ব্যথা, সঙ্গী হারানোর যন্ত্রণা আসলেই কষ্টকর। আবার এটাও ঠিক- সম্পর্ক ছেদের ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এক সময় এই অবস্থা থকে বের হয়ে নতুন করে জীবন শুরু করা যায়।
কিন্তু সেটা কত দিনে?
এই বিষয়ে ‘দি জার্নাল অফ পজেটিভি সাইকোলজি’তে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের ‘মনমাউথ ইউনিভার্সিটি’র করা গবেষণার ফলাফলে বলা হয় হয়, সম্পর্ক ভাঙার পর প্রাক্তনকে ভুলে যেতে ১১ সপ্তাহ লাগতে পারে।
আবার যুক্তরাষ্ট্রের ‘অ্যালবার্ট আইনস্টাইন কলেজ অফ মেডিসিনি নিউ হেভেন’, ‘স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ নিউ ইয়র্ক’ ও ‘রাটগার্স ইউনিভার্সিটি’র করা গবেষণায় বলা হয়- বিয়ে ভাঙনের পর একজন মানুষের সেরে উঠতে ১৮ সপ্তাহ লাগে।
মনে রাখতে হবে, সম্পর্ক ছেদের ব্যথা, ভুলে যাওয়ার বিষয়টা একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম সময় লাগতে পারে। আর সম্পর্কের মাত্রার ওপরেও অনেক কিছু নির্ভর করে।
“বহুদিনের সম্পর্ক ভাঙার কারণে প্রাক্তনকে ভুলতে দেরি হতে পারে এমন কোনো কথা নেই। স্বল্প সময়ে গড়া সম্পর্ক ভাঙার পরও সেই সঙ্গীকে ভুলতে সময় লাগতে পারে”- ভেরিওয়েলমাইন্ড ডটকম’য়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে মন্তব্য করেন মার্কিন মনোবিজ্ঞানি ও ‘লাইসেন্সড ক্লিনিকাল সোশাল ওয়ার্কার’ অ্যামি মরিন।
যে কারণে সম্পর্ক ছেদে ব্যথা জাগে
কারও সাথে হৃদয়ঘটিত সম্পর্ক হওয়া মানে একজনের জীবনের ভিত্তি তৈরি হওয়া। যখন সম্পর্ক ভঙ্গ হয়, বিশেষ করে যাকে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ভাবা হচ্ছিল, সে চলে যাওয়ার পর মনে হয় জীবনের একটি অংশ হারিয়ে গেছে।
মরিন বলেন, “এই ধরনের অনুভূতি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এমনকি মনে হয় জীবনের বিশাল একটি অংশ হারিয়ে গেছে। সেই মানুষটি ছাড়া আর আগের মতো হতে পারবেন না।”
তিনি আরও বলেন, “তরুণদের ক্ষেত্রে দ্রুত ভুলে যাওয়াটা হয়ত সহজ হয়। কারণ বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রমে তরুণ বয়সে ডুবে থাকা যায়। আবার সময়টাও হাতে থাকে। অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে প্রাক্তনকে ভুলে যাওয়াটাও কঠিন হয় না। তবে বেশি বয়সে সঙ্গী হারানোর বেদনা ভুলতে বেশি দেরি হতে পারে। কারণ নতুন সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে বয়সটাও থাকে না। আবার অনেকের পারিপার্শ্বিক গণ্ডি এতটাই ছোট হয়ে যায় যে, অন্য কিছু তেমন করারও থাকে না।”
তবে এই ধরনের অনুভূতি যদি অনেকদিন ধরে চলে, অতীত যদি না ভোলা যায়- সেক্ষেত্রে অবশ্যই যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার দরকার আছে।
এই ক্ষেত্রে সময় নেওয়ার ও ধৈর্য্য ধরার পরামর্শ দেন, মরিন।
নিজের প্রতি সচেতন হওয়া, প্রাক্তনের কথা না ভেবে কী কী কারণে সম্পর্কটা কাজ করলো না সেই বিষয়গুলো মাথায় রাখা ইত্যাদিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
সময় নেওয়া
প্রাক্তনকে ভুলে যেতে একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এখানে তাড়াহুড়ার কিছু নেই। তারচেয়েও বড় কথা এই অবস্থায় নতুন কোনো সম্পর্ক গড়তে যাওয়া যাবে না।
অনুভূতিকে প্রাধান্য দেওয়া
ব্যথা কেউ সইতে চায় না। সেটা উপভোগ্য নয়। তবে সেরে উঠতে চাইলে ব্যথা অনুভব করতে হবে। অনুভূতি যত চেপে রাখা হবে ব্যথার স্থায়িত্ব ততই বাড়বে।
সাহায্য নেওয়া
সাধারণত দেখা যায় সম্পর্ক ভঙ্গের পর এক পক্ষ বেশি কষ্ট পায়। মানসিক ‘শক’ পাওয়া, হৃদয়ে ব্যথা, প্রত্যাখ্যাত হওয়া বা বিশ্বাসঘাতকতার মতো বিষয়গুলো মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে থাকে।
তাই নিজের কেমন বোধ হচ্ছে, সেসব বিষয় নিয়ে কাছের বন্ধুকে জানানো উচিত হতে। অন্যকে নিজের অনুভূতি জানানোর মাধ্যমে এক ধরনের মানসিক ভার মুক্ত হওয়া যায়। শুধু খেয়াল রাখতে হবে বন্ধুটি বা বন্ধুরা যেন হয় আপনার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়।
সব জায়গা থেকে প্রাক্তনকে মুছে ফেলা
হৃদয়ভঙ্গের পরে প্রাক্তনকে নজরে রাখার মতো কাজ প্রায় সবাই করেন। তবে ভুলতে চাইলে অবশ্যই সব ধরনের সামাজিক মাধ্যম থেকে তাকে ‘ডিলিট’ করে দিতে হবে। পাশাপাশি ফোন নম্বর, ফোনে থাকা বার্তা সবই মুছে ফেলতে হবে। কারণ- চোখের দূর তো মনের দূর।
মাতাল হয়ে যোগাযোগ করা যাবে না
দেবদাসের মতো মদ্যপ হয়ে প্রাক্তনকে ফোন করা বা ম্যাসেজ পাঠানোর মতো বাজে বিষয় আর হয় না। মাতাল অবস্থায় মাথা কাজ করে না। তখন মানুষ অনেক রকম যুক্তিহীন কাজ করে। নিজের অবস্থান ভুলে যায়। রাতে পাঠানো ‘গালাগালি’ পূর্ণ বার্তা, সকালে দেখে অনুশচনা হয়।
এই কারণেই ফোন, ইমেইল, সামাজিক মাধ্যম থেকে প্রাক্তনের সব যোগাযোগ নম্বর মুছে ফেলতে হবে। আর যে কোনো নেতিবাচক বার্তা পাঠানোর আগে অন্তত চিন্তা করুন- ওই ম্যাসেজ প্রাক্তন হয়ত অন্যদের দেখিয়ে আপনার সম্পর্কে বাজে কথা বলছে। সেই সুযোগ কেনো দেবেনে তাকে!
দোষারোপ ও রাগের অনুভূতি ঝেরে ফেলতে হবে
রাগ ধরে রাখা, দোষ দেওয়ার মতো বিষয়গুলো মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। এগুলো মানুষকে ভেতর থেকে খেয়ে ফেলে। মনে রাখতে হবে ক্ষমা করে দেওয়া মানে ভুলে যাওয়া নয়।
রাগ ধরে রেখে বা প্রাক্তনকে যতদিন দোষারোপ করা হবে ততই তাকে ভুলতে দেরি হবে। এমনকি অনুভূতিতে নেতিবাচক প্রভাব বাড়তে থাকবে। আর এসব করে তাকে ফেরতও আনা যাবে না।
তাই অতীত নয়, ভবিষ্যতের দিকে নজর দিয়ে নিজের জীবনকে কীভাবে সাজাবেন সেই চেষ্টা করতে হবে।
এখানেই শেষ নয়
সমুদ্রে যেমন মাছের অভাব নেই তেমনি একটা দরজা বন্ধ হলে আরও অনেক দরজা খুলে যায়। তাই নিজেকে বন্দী করে না রেখে নতুন মানুষদের সাথে মেশা শুরু করতে হবে। এক্ষেত্রে নতুন কোনো কর্মশালায় যোগ দেওয়া, ব্যায়ামাগার বা যেখানে অনেক মানুষ জমায়েত হয় কোনো কাজ করে বা শিখে এরকম জায়গায় নিজেকে জড়াতে হবে।
বলা যায় না, এভাবে নতুন মানুষদের সাথে মিশতে মিশতে নতুন এমন একজনকে পাবেন যে কি-না প্রাক্তনের চাইতেও বেশি সহানুভূতিশীল ও অনুরাগী হবেন।
__________________________________________________________
__________________________________________________________
_______