“সুন্দরী ডুয়ার্স “

সুপ্তি বসু

“ভাবনা গুলো বাক্সে পুরে,বেরিয়ে পড়ো চায় যা মন। চলতে গিয়ে হোঁচট খেলে থমকে যেও একটুক্ষণ “।সত্যিই  তাই হলো। কর্তার ইচ্ছেতে কর্ম। আমার ক্ষেত্রেও তাই। বহু দিনের তার ইচ্ছে গাড়ি নিয়ে কলকাতা যাবে। আমি ত শুনেই ভিরমি খাচ্ছি। যাই হোক শেষ পর্যন্ত আমাকে বোঝানো হলো ” চিন্তা করো না, অনেক থেমে থেমে যাবো”। অগত্যা….।  যাই হোক অনেক জল্পনা, আলোচনার পর ঠিক হলো  ছেলের পরীক্ষা শেষ ৩০ শে মার্চ, ৩১ শে মার্চ ই বেরোবো। এবার শুধু কলকাতা নয়,তিনি ঠিক করেছেন উত্তরবঙ্গ ঘুরে আবার কলকাতা। আমার ত মাথা যেন বন বন, কী বলে?????  মনে একটু যে খুশির ঝিলিক দেয় নি, তা নয়, বেশ একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি হচ্ছিলো, আর বেরাতে কার না ভালো লাগে। আমরা ত প্রতিবছর হিমাচলে ই যাই এবার না হয় উত্তর বঙ্গ ঘুরেই আসি। দেখাই যাক, তাই ভাবনা গুলো বাক্সে পুরে, সেই প্রতীক্ষিত দিনটি চলে এলো ৩১ শে মার্চ মোটামুটি সংসার গুছিয়ে, ঈশ্বরের নাম নিয়ে চরৈবতি চরৈবতি।

ভোর ৬.৩০ টায় শুরু হলো আমাদের প্রথম adventure. বেরিয়ে পড়লাম। ঠাকুরের কৃপায় যাত্রা ভালো মতোই হয়েছিলো। তবে আমি এখানে দীর্ঘ যাত্রার কথা লিখছি না। সে সব পরে আবার ভ্রমণ কাহিনীতে বলবো। আমি আজ এখানে কলকাতা থেকে উত্তর বঙ্গ যাত্রার অভিজ্ঞতার কথাই লিখবো। আমরা ৮ ই এপ্রিল কলকাতায় পৌঁছোই। তারপর ১৫ ই এপ্রিল,বাংলা নববর্ষের শুভক্ষণে শুরু আমাদের দ্বিতীয় adventure উত্তর বঙ্গের উদ্দেশ্যে ভোর  ৬.৩০টায়।৪১০ কিমি পথ ১০ ঘন্টায় অভিক্রম করে বিকেল ৬ টায় রায়গঞ্জ এলাম।

তবে পথে গাড়িতেই  Breakfast সেরেছি। সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম। সময় বাঁচানোর জন্য। ফারাক্কায়  lunch.  তবে এখানে একটা কথা বলতেই হয় ,যে ফারাক্কায়   NTPC power plant এ আমার কর্তার কাজের সূত্রে  আমরা ছিলাম ,সেই township  এ ছেলেকে ঘুরিয়ে দেখানোর একটা ইচ্ছে ছিলো। এই সুযোগে সেটা হয়ে গেলো। এরপর রায়গঞ্জে রাত্রি যাপন।১৬ তারিখ রায়গঞ্জ থেকে breakfast করে ৮.৩০ নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম, ২০০ কিমি দূরত্ব প্রায় ৭ ঘন্টায় । বেলা  ১টা নাগাদ এলাম গাজল ডোবায়। নাম টা শুনে নাকটা কি একটু কুচকে গেলো?  পৌঁছেই এক মুগ্ধতায় প্রথম দর্শনেই মন কেড়ে নিলো।

গাজল ডোবার সাজানো গোছানো প্রাকৃতিক  সৌন্দর্য  বুঝিয়ে  দিলো নাম শুনেই তার গুণের মাপকাঠিতে যেও না। এই Resort এর  নাম আমাকে আরো চমকে দিলো “ভোরের আলো”। সত্যিই সে অহনা। দুপুরে সেখানে lunch সেরে প্রকৃতির কোলে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম। বিকেলে তিস্তা ব্যারেজে গেলাম। বিরাট ব্যারেজ মৃদুমন্দ হাওয়ায় হেঁটে পার হলাম। তিস্তার ওপারে সূর্যদেব অস্তগামী,গোধূলি আলোয় চারিদিকে এক আভা। সেখানে প্রচুর মাছ ভাজা নিয়ে বসেছে গ্রামের লোকজন। চিংড়ি, বরুলি। আমরাও একটু খেলাম। ফিরে এসে তাড়াতাড়ি রাতের খাওয়া সেরে শুয়ে পড়লাম। পরের দিন মানে ১৭ তারিখ ভোরের আলোর ভোর দেখে বেরিয়ে পড়লাম ৬.৩০ টায়। এবারের গন্তব্য জয়ন্তী। ১৫৩ কিমি দূরত্ব অতিক্রম করলাম ৪ ঘন্টায়। সকালের খাবার ওরা দিয়েছিলো। সকাল ১০ টায় জয়ন্তী তে পৌঁছোলাম। জয়ন্তী বনোদপ্তরের এলাকায় পড়ে, তাই টিকিট কেটে ঢুকতে হলো। জয়ন্তী প্রকৃতির কোলে নিজস্ব সৌন্দর্যে প্রতিভাত। একদিকে গভীর জঙ্গল, মাঝে জয়ন্তী নদী, একধারে আমাদের homestay  নামটাও সুন্দর ” মোহন চূড়া”মন ভরে গেলো।ডুয়ার্সের সব জায়গার নাম গুলো খুব সুন্দর।

তবে আমরা এক মুহুর্ত সময় নষ্ট না করে ওদের জিপে করে জয়ন্তী নদীর ওপর দিয়ে চললাম মহাকালের মন্দির দর্শনে।  এই গ্রীষ্মের দাবদাহে প্রায় শুকনো জয়ন্তী নদীর  ওপর দিয়ে  উঁচু নীচু পাথর ভেঙ্গে আমাদের নিয়ে চললো মহাকালের মন্দির দর্শনে। জিপ অনেক দূর গিয়ে আমাদের ছেড়ে দিলো সঙ্গে এক গাইড ছিলো, সে আমাদের সঙ্গে নিয়ে চললো আরো খাড়াই পাহাড় ভেঙ্গে মহাকাল দর্শনে। যা ভুটানেই অবস্থিত। আমরা আগে অনেক ওপরে এক যৌবনবতী ঝর্ণার উচ্ছলতা দেখে মহাকাল দর্শন করলাম।সে ভাবে মন্দির নেই।  একটা  লাইমস্টোন এর গুহার ভেতর এক পূজারী বসে আছেন মহাকাল মানে শিব লিঙ্গ আগলে। পূজো দিয়ে নেমে এলাম। জয়ন্তী নদীর জলে কিছুটা নেমে মুখে মাথায় জলের ধারায় এই দাবদাহে এক স্নিগ্ধতার পরশ পেলাম। আবার জিপে ফিরছি।ঠিক ছিলো পরের দিন ও জয়ন্তী থাকবো এবং সকালে জঙ্গল সাফারিতে যাবো। কিন্তু বাধ সাধলো নিয়ম। কিছুদিন আগে নিয়ম জারি হয়েছে মঙ্গল বার সব বন্ধ, জঙ্গল এলাকায় প্রবেশ নিষেধ। এবং আমরা যদি এখান থেকে বেরোই, প্রবেশ মানা। তাই আমরা মহাকাল দর্শন করে ফিরেই অন্য জিপে চলে গেলাম জঙ্গল সাফারিতে। প্রায় দেড় ঘন্টা গভীর জঙ্গলে চলে গেলাম জিপে। এই গরমে জঙ্গলের জীবেরা আর বাইরে বেরোতে চায় নি। আরো গভীরে ঠান্ডায় থাকাই ভালো মনে করেছে। আমরা নিরাশ হয়ে ফিরলাম। যেহেতু এতো নিয়ম, তাই পরের দিন মানে ১৮ তারিখ  আমরা breakfast করে একদম বেরিয়ে এলাম চিলাপাতায়, “মোহন চূড়ায়”র ই আরেকটি  homestay তে।যাবার পথে গেলাম সিকিয়াঝোরা। সেও এক জঙ্গল এলাকা। আসলে ডুয়ার্স সবুজ শ্যামলীমায় আবৃত এক সুন্দরী কন্যা। যেখানেই চোখ যায় সবুজ। এই সিকিয়া ঝোড়া জঙ্গল এলাকায় একটা  canal এর মতো আছে। সেখানে বোটিং হয়, আমরাও টিকিট কেটে নিলাম। এই অভিজ্ঞতা কেউ ছাড়ে? কিছু সহজ সরল মহিলারা খাবারের ব্যবস্থা করেন। যারা নৌকোবিহারে যাবেন, যাবার আগে দুপুরের  কি খাবেন ওদের বলে দিলে ওরা তৈরী করে দেবে।  আমরা ডিমের ঝোল ভাত বলে দিয়ে নৌকো বিহারে চললাম।

বেশ একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি। চারিদিকে ঘন জঙ্গল মাঝখানে দিয়ে আমরা চলেছি, যে কোনো মুহূর্তে হাতি এসে পড়তে পারে, বেশ একটা ভয় ভয় ভাব।এক ঘন্টা নৌকো বিহার করে ফিরলাম। এসে একেবারে আড়ম্বর হীন, কিন্তু ওদের আন্তরিকতায়,  খাবার তৃপ্তির সঙ্গে খেয়ে ফিরলাম  চিলাপাতায়। বিকেলে গেলাম আলিপুর দুয়ারে এক আত্মীয়ের বাড়ি। সেখানে দারুন আনন্দ করে  রাতের খাবার খেয়ে গা ছম ছম জঙ্গল পার হয়ে প্রায় রাত ১০.৩০ টায় ফিরলাম চিলাপাতায়। পরের দিন মানে ১৯তারিখ  সকালে  বেরিয়ে পড়লাম  মোহন চূড়া থেকে।  সঙ্গে আমার মজুত খাবার থেকেই breakfast  সারলাম। গেলাম কুচবিহারের রাজার প্রাসাদ দেখতে। এসেছি যখন ডুয়ার্সে সব দ্রষ্টব্য স্থান মন ভরে দেখে যাই। রাজার প্রাসাদ সত্যি ই প্রাসাদ। রাজার মতোই এক নিজস্ব দম্ভে দাঁড়িয়ে আছে। সেখান থেকে গেলাম মদনমোহন জীর মন্দির দর্শনে। অনেক ভক্তের মাঝে দাঁড়িয়ে পূজো দেখে চলে এলাম।  Lunch সেরে চলে এলাম চিলাপাতার আরেকটি resort এ Nalgarh Retreat এ। সেও এক আপন সৌন্দর্য এ প্রতিভাত। ডুয়ার্স সবুজ ত বটেই  তার মাঝে জবা,আর টগর ফুল প্রায় সর্বত্র, এবং ডুয়ার্সকে আরো মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে। ভীষণ গরম লাগছে, তাই এখানের ম্যানেজার বললেন সামনের গরুমাড়া নদীতে স্নান করবেন?”   লাফিয়ে উঠলো ছেলে আর বাবা। আমি পাড়ে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছি। তারা লাফিয়ে, ঝাপিয়ে মনের সুখে অবগাহনে শরীর, মন ঠান্ডা করে নিলো।  এই resort টা সুন্দরত  বটেই, ততোধিক সুন্দর ম্যানেজারের আতিথেয়তা।  আমাদের জোর করে খাওয়ানো, যতোক্ষণ খাচ্ছি, পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন। যেন বাড়ির অতিথি। এখানে রাত্রি যাপন, পরের দিন সকাল ৮ টায় breakfast সেরে চিলাপাতার Nalgarh Retreat থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

২০ তারিখ  Nalgarh retreat থেকে বেরিয়ে  ৪১ কিমি দূরত্বে টোটাপাড়ায় গেলাম। সময় লেগেছে ১ ঘন্টা ১৫ মিনিট

আমরা যেখানেই যাই সেই জায়গার একদম ভেতরে চলে যাই, তাদের জীবন যাত্রা জানা আর যেন প্রকৃতিকে আরো কাছ থেকে অনুভব করা যায়। অনেক ভীড়ের মাঝে যেন সব হারিয়ে যায়। যাইহোক এই টোটাপাড়ার, টোটা প্রজাতি প্রায় বিলুপ্তি র পথে। আমরা একদম গ্রামের ভেতরে চলে যাই। খুব কম লোক জন। একটি স্কুল আছে। চেষ্টা চলছে এই প্রজাতিকে রক্ষা করার। এদের জীবিকা সুপারি, ভুট্টা চাষ। সেখানে এক জীপের ড্রাইভার বললো এখানে লোকজন বেশি আসে না, তবে আমি আপনাদের আরো ওপরে এক সুন্দর ঝালর নামে একটি  জায়গায় নিয়ে যেতে পারি, যার কিছুটা অংশ ভূটানে অবস্থিত। আর আমাকে কিছু দিয়ে দেবেন। আমরা রাজি হলাম, তার মুখ থেকেই এদের কথা শুনলাম। ওপরে গিয়ে সত্যিই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। অপরূপ সৌন্দর্যে স্বমহিমায় ডুয়ার্স দাঁড়িয়ে আছে। তার এই রূপ যেন সে সবার আড়ালে একান্তে নিজের করে রেখে দিয়েছে। চারিদিকে সবুজ বনানী। অনেক নীচে গ্রাম। ওপারে তোর্সা নদী আর ভুটান পাহাড় প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে জানান দিচ্ছে আমি কাছেই আছি। মন্ত্র মুগ্ধের মতো অনেকক্ষণ এই দৃশ্য দু চোখ দিয়ে দেখলাম, মনের খাতায় লিখে নিলাম। আর সেই ড্রাইভার কে অনেক ধন্যবাদ জানালাম। এরপর গেলাম হাত্তুপাড়া। সেখানে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে চা বাগান। আমরা সেই বাগানের ভেতর চলে গেলাম। এরপর গারুচিড়া বলে আরেক জায়গায় যাবার কথা ছিলো, কিন্তু সময় জানান দিলো এখন যদি ওখানে যাই তাহলে আমাদের যে আসল গন্তব্য স্থল শিসামাড়ায় ,জলদাপাড়া রাইনো কটেজ, যেখানে রাত্রি যাপন, অনেক দেরি হয়ে যাবে। ওখানে আমাদের জন্য lunch বানিয়ে রেখেছে। তাই সোজা চলে গেলাম শিসামাড়ায় পৌঁছোতে একটু দেরিই হলো। যাইহোক একদম বাঙ্গালী খাবার ডাল, তরকারি, মাছ, ভাত খেয়ে শিসামাড়ার নদীর পাড় দিয়ে  অনেক দূর হেঁটে হেঁটে গেলাম। দুপাশে জঙ্গল। যে কোনো সময় হাতি চলে আসতে পারে। ভাবছিলাম তাহলে পালাবো কোথা দিয়ে। সেই দূরত্ব রেখে হাঁটছিলাম। রাইনো কটেজের মালিক বললেন বেশিদূর যাবেন না। অন্ধকার হবার আগেই চলে আসবেন। আমরাও কথা মেনে চলে এলাম। এই কটেজ টা এবং চারিদিকের পরিবেশ মনকে অজান্তেই কেড়ে নেয়। ডুয়ার্সেকে যতো দেখছি ততো মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। প্রচন্ড গরম সেও যেন স্নিগ্ধ বাতাসের পরশে জুড়িয়ে দিলো শরীর মন। সন্ধাতে রাইনো কটেজের মালিক গানের আসর বসালেন, তার এক বন্ধুকে দিয়ে। অপূর্ব লোকগীতি পরিবেশন করলেন, রাত ১০.৩০ টা পর্যন্ত। তারপর রাতের খাওয়া খেয়ে শুয়ে পড়লাম, কারন ভোর ৫ টায় যেতে হবে জঙ্গল সাফারিতে। পরের দি ২১ তারিখ ভোর ৫ টায় গাড়ি নিয়ে একটা জায়গায় গেলাম সেখানে টিকিট কেটে জীপে উঠলাম। সঙ্গে বনোসংরক্ষণের লোক ছিলো। Permission আগেই নেওয়া ছিলো। ঘন জঙ্গেলের মধ্যে দিয়ে জীপ চলেছে । আমরা সব জীপে দাঁড়িয়ে। প্রথমেই দর্শন হলো বাইসনের সঙ্গে, প্রচন্ড বলশালী, কালোকুচকুচে, পায়ের দিকে সাদা, আমার সব সময় মনে হয় যেন সাদা মোজা পড়ে আছে, খুব বিরক্তির সঙ্গে আমাদের দিকে তাকিয়ে চলে গেলো। এরপর দেখা পেলাম গন্ডারের। সে ত আপন মনে ঘাস, পাতা খেয়েই যাচ্ছে। কে, যাচ্ছে, আসছে কোনো ব্যাপার না। তাকে বিরক্ত না করলে সেও ঠিক। রাজকীয় চালে আমাদের থেকে কিছুটা দূর দিয়ে চলে গেলো। এরপর ময়ূরী সে তো ডেকেই যাচ্ছে তার সঙ্গীকে। জীপ এগোচ্ছে আমরাও সজাগ হয়ে আছি কিছুটা উদগ্রীব। হঠাৎ বৃংহণে আমরা সচকিত, সামনেই একাকী দাম্ভিকতার সঙ্গে দাঁড়িয়ে বিশাল এক হস্তী। তবে আমার অভিজ্ঞতায় জানি জঙ্গলে বন্য হাতি একা ভীষণ সাংঘাতিক। আমরা একবার বিপদে পড়েছিলাম। যাইহোক সে আরেক  কাহিনী। এখানে সে কাউকে পরোয়া না করে, যেন “আমি মানি নাকো কোনো আইন ” এই রকম ভাব নিয়ে এগিয়ে গেলো।আমরাও সব নিশ্চুপ হয়ে দেখলাম দম্ভ কাকে বলে। এরপর জীপ আরো এগোতে অদ্ভুত এক উড়ন্ত  পাখি দেখলাম, উড়ছে কিন্তু একই জায়গায়, একটুও এগোচ্ছে না। জানলাম এ বাজ পাখি। এইরকম গভীর জঙ্গলের কিছু প্রাণীদের সাক্ষাৎ করে ঘন্টা খানেক বাদে ফিরে এলাম। চা পান করে, স্নান সেরে breakfast  সেরে বেরিয়ে পড়লাম। এবারের গন্তব্য সুমারু লজ, জলদাপাড়া, মাদারিহাটার কাছে।

পথে আমরা গিয়েছি গারুচিড়া, যেটা আগে যাওয়ার ছিলো। গারুচিড়াতে  Eco village এ গেলাম, সুন্দর সাজানো গোছানো পরিবেশ,  মাঝে কটেজ। কিছুক্ষণ কাটিয়ে গেলাম  Banarhat Tea garden, Rati forest পার হয়ে চামোর্চিতে গেলাম।  ভূটান বর্ডারের কাছে। সেখানেও Eco village যাচ্ছিলাম, কিন্তু রাস্তা এতো খারাপ। আর গেলাম না। এখান থেক  ভুটান পাহাড় দেখা যায়। এরপর গেলাম আমাদের গন্তব্য স্থলে  জলদাপাড়ার সুমারু রিসোর্ট এ। ভীষণ সুন্দর একটি রিসোর্ট। অপূর্ব মনোরম পরিবেশ। সবুজ বনানীতে সাজিয়ে রাখা। তাদের ব্যাবস্থাপনা, ব্যাবহার তুলনাহীন। খাবার ভীষণ ভালো। সেখানে এক রাত কাটিয়ে পরের দিন ২২ তারিখ সুমারু লজ কে বাই জানিয়ে খয়ের বাড়ি এলাম। Tiger rescue centre এ। যেখানে তিনটি leopard আছে কিন্তু একটির দেখা পেলাম। খাঁচার ভেতরে ঠান্ডায় বসে আছে। তার নাম মিঠুন। অনেক ডাকাডাকিতে সে বেরিয়ে এলো। হ্যাঁ এখানে আমাদের গাড়ি রেখে একটা টোটো করে কিছুটা যেতে হলো। এরপর গেলাম ” লাল ঝামেলা বস্তি” নাম টা শুনেই চোখ প্রায় কপালে। কিন্তু কোনো ঝামেলা বিহীন প্রকৃতির অপরূপ শোভা দেখলাম। এবার আমাদের গন্তব্যস্থল  Gorumara forest resort যেখানে দুদিন ছিলাম। সেও তার নিজস্ব রূপে সেজে গুজে অতিথি অভ্যর্থনার জন্য দাঁড়িয়ে। এখানে পৌঁছোতে বিকেল হয়ে গিয়েছিলো।  পরের দিন ২৩ তারিখ ভোর ৫টায়  গেলাম গরুমাড়া জঙ্গল সাফারিতে জিপসি গাড়িতে। নিস্তব্ধ গভীর জঙ্গলে ঢুকতেই গা ছম ছম। দুপাশে শ্যেন দৃষ্টি দিয়ে দেখছি সবাই। সঙ্গে বনসংরক্ষণ দপ্তরের লোক। হঠাৎ এক দঙ্গল বাইসন এ জঙ্গল থেকে  আমাদের সামনে দিয়ে উল্টো দিকের জঙ্গলে ছুটে গোলো। পেছনে সাদা বক উড়ে যাচ্ছে পেছন পেছন, যেন কোন এক মহাসমারোহে যোগদানে যেতে হবে পাছে দেরি হয়ে যায়, তাই এতো  তাড়া। এই দৃশ্য দেখে আরো কিছুদূরে আমাদের একটা জায়গায় নামিয়ে বলা হলো দূর থেকে সব প্রাণীরা জল খেতে আসে। আর বনোদপ্তর থেকে নদীর ধারে নুন, গুড় রেখে দেয়। যাতে বন্য প্রানীরা খেতে আসে। ঠিক তাই, দূর থেকে দেখলাম মা  গন্ডার ও তার বাচ্চা, দুজনে মনের সুখে নুন খেয়ে যাচ্ছে। আমারা যে ওদের দেখছি তাতে কিছু যায় আসে না। আর আমাদের খুব কাছেই ময়ূরী ঘুরে বেরাচ্ছে। আগের দিন রাতে প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি হয়েছিলো, সকাল ৪.৩০টাতেও বৃষ্টি হয়। এখন সূর্যের আলোয় আকাশ ধীরে ধীরে সোনালী রঙে রেঙে উঠছে। আর ময়ূর আনন্দিত হয়ে পেখম তুলে নাচছে। প্রকৃতির কোলে এই দৃশ্য মনের মধ্যে রঙ ছড়িয়ে দিলো। কী দেখলাম!!!  তবে হাতি দেখার আশা পরিত্যাগ করে ফিরে এলাম। ফিরে এসেই চা পান করে, স্নান সেরে, breakfast সেরে বেরিয়ে পড়লাম, সারাদিনের জন্য বিভিন্ন দ্রষ্টব্য স্থান দেখতে। চাপড়ামারি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গেলাম গৌরী নিবাস, জলঢাকা, ঝালং, বিন্দু,ডালগাঁও, সামসিং টি গার্ডেন। এই সব জায়গায়ই প্রকৃতির এক একটি সৌন্দর্যের উৎসস্থল। সবাই নিজস্ব সৌন্দর্যে মহিমান্বিত। ডুয়ার্সের যতো গভীরে যাচ্ছি ততো মুগ্ধ, বিস্মিত হয়ে যাচ্ছি। এরপর চালসা হয়ে ফিরে এলাম আমাদের Gorumara forest resort এ। এই Resort এর কাছেই মূর্তি নদী। শান্ত, স্নিগ্ধ, তিরতির করে বয়ে যাওয়া নদীর ধারে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম সুর্য তখন অস্তাচলে, তার রক্তাভ আভা পড়েছে মূর্তি নদীতে। সে এক অতুলনীয় রূপ।  তারপর ফিরে এলাম Resort এ। সারাদিনের ঘোরার ক্লান্তি থাকলেও মন এক প্রশান্তিতে ভরে আছে, যা ক্লান্তি সহজেই দূর করে দেয়। রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়লাম। পরের দিন ২৪ তারিখ গন্তব্য গরুমাড়ার আরেকটি জায়গা য়্এ্য মি Kalipur Eco Resort. হ্যাঁ কিছু কথা বলা হয় নি। ডুয়ার্স কে  ভালো ভাবে দেখতে গিয়ে আমরা তার গভীরে, গ্রামে গঞ্জে চলে গিয়েছি। জানলাম অনেক কিছু। এখানে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের সংখ্যা ই বেশি। চাষ, আবাদই রোজগারের পথ। তবে যা দেখলাম খুব সহজ, সরল, অতি সাধারণ জীবন যাত্রা, এবং  এরা খুব বিশ্বাসী ,যা মনকে নাড়িয়ে দেয়। এখনো এরকম আছে? ডুয়ার্স তাই এতো সুন্দর। ডুয়ার্স ঘন সবুজে আবৃত, আমরা যেখানেই গিয়েছি সবই বনোদপ্তরের রিসোর্ট এ। খাওয়া দাওয়া খুব ভালো। একদম বাঙ্গালীয়ানা। ভাত, ডাল, আলু ভাজা, বা বেগুন ভাজা, আলুপটলের তরকারি, কখনো পোস্তো, চাটনী, পাপড়। বিকেলে চা পকোড়া। রাতে চিকেন, নিরামিষ, সেটা বলে দিলে সেরকম বানিয়ে দেবে।  যাই হোক আমরা বেলা ১টা নাগাদ কালিপুর এলাম। লাটাগুড়ি পার হয়ে এখানে ঢোকার পথ খুব সরু মেঠো পথ দুপাশে ঢাল নেমে গিয়েছে, আর দুধারে ঘন জঙ্গল। ওপাশ থেকে কোনো গাড়ি এলে খুব অসুবিধায় পড়তে হয়। আমাদের হয়েও ছিলো। যখন পৌঁছোলাম রিসোর্ট এ। মন ভরে গেলো পা দিয়েই। বিরাট জায়গা জুড়ে সবুজ ঘাসের কার্পেট। দুধারে ঘন জঙ্গল। এখানে চারটি কটেজ আছে। কংক্রিটের পিলারের ওপর বাঁশের সুন্দর রং করা ঘর, যার চারদিকে ঘোরানো বারান্দা। এই ভাবে উঁচুতে ঘর বানানোর কারন কি?  কারন হাতি। মহারাজ মাঝে মাঝেই এসে পড়েন। যদিও electric fencing আছে। কিন্তু মহারাজ এর কাছে এসব তুচ্ছ। আর ভারি সুন্দর  এই কটেজের নাম গুলো। মধুয়া, চেপটী, মালসা, ডাডঢা।  এই নামকরন বিভিন্ন  ঘাসের নামে। আমরা যেটায় আছি তার নাম মধুয়া। আমরা ত সেই বারান্দায় চুপ করে বসে রইলাম, ঘন জঙ্গলের  দিকে দৃষ্টি দিয়ে। তারপর দুপুরের খাবার দিলো খুব যত্ন সহকারে। দুটি অল্প বয়সী ছেলে। আতিথেয়তার ত্রুটি নেই। ওদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম ১২ বছর এখানে কাজ করছে। গতো চার মাস ধরে মাইনে পাচ্ছে না। খুব অবাক হলাম। অথচ মুখে হাসি নিয়ে সেবা করে যাচ্ছে। শুধু খাওয়া টা  ওরা পায়। মাইনে পাচ্ছে না কেন? কেউ জানে না, কেন র উত্তর । যতো জানছি ততো অবাক  হচ্ছি। এরপর বিকেল ৪ টে নাগাদ মোষের টানা গাড়িতে গেলাম একটা  মেদলি watch tower এ। দারুন রোমাঞ্চকর অনুভূতি।  Tower এ উঠে দূর থেকে বাইসন, গন্ডার, হরিণ দেখলাম। হঠাৎ আমাদের চমোকিত করে খুব কাছ দিয়েই বিরাট এক দাঁতাল হস্তী দুলকি চালে চলে গেলো। চোখ সার্থক। মন কানায় কানায় পূর্ণ। ফিরে এলাম আবার সেই মোষের গাড়িতে। রাতের ঘন অন্ধকারে বারান্দায় বসে ছিলাম এক ভয় মিশ্রিত মন নিয়ে। শুনছিলাম নিস্তব্ধ জঙ্গলের এক নিজস্ব শব্দ। কেমন যেন গা ছম ছম অনুভূতি। রাতে খুব তাড়াতাড়ি খাওয়ার দিয়ে দিলো। ওরা শুয়ে পড়ে তাড়াতাড়ি। কারন বন্য জীবদের আচরণ বোঝা দায়। দূরে এক leopard এর ডাক শোনা গেলো। আমাদের ছেলে দুটো বললো নীচে নামবেন না। ওহ, বলা হয় নি, এই চারটে কটেজের মধ্যে আমরাই শুধু অতিথি।  অদ্য শেষ রজনী এই সুন্দরী ডুয়ার্সে।  আজকের মতো শেষ করলাম ডুয়ার্স ভ্রমণ। কাল সকালে চলে যাবো পাহাড়ে রামধুরা তারপর দার্জিলিং। সে গল্প আবার অন্য কোথাও। এই ৯ দিনের ডুয়ার্স ঘোরা সমাপ্ত। তবে মন, চোখ ভরে নিয়ে গেলাম অনেক সৌন্দর্য। ভালো থেকো ডুয়ার্স এইরকম সুন্দর মন নিয়ে। স্থবিরতা  অশার করে চলোমানই গতি, জীবন পথে এগিয়ে চলো, চরৈবতি চরৈবতি।

………………………………………………………………………………………………….

  •  

  • __________________________________________________________

  •  

  •  

  •  

  • __________________________________________________________

  • _______

  •  

  •  

  •  

  •  

  •  

  •  

  •  

  •   

Loading