ভৌতিক রাতের ঘটনা

কলমে

প্রদীপ মিশ্র

হলদিয়া

 

ঘটনাটা ২০১৯-র এক শীতের রাতের, ডিসেম্বরের শেষ অথবা জানুয়ারির শুরু। আমি তখন সল্টলেক সেক্টর ২ এ কলসেন্টারে চাকরি করি। ঘুম থেকে উঠতে উঠতে দুপুর হয়ে যায় তাই বিকেল পাঁচটা থেকে রাত একটার শিফটের কমন পাপি আমি। অন্যান্য দিনের মত সেদিনও বাড়ির সামনে যখন অফিসের গাড়ি নামিয়ে দিয়ে গেল রাত তখন ১.৫০।

ঠাকুরদা ঠাকুমার হার্টের অসুখ, রাতের বেলা বিন্দুমাত্র আওয়াজ করা নিষেধ। প্রায় বিড়ালের মত নিঃশব্দে নিচের তলার কলাপসিবল গেট খুলে চারতলায় উঠে গেলাম আমার চিলেকোঠাটায়। টেবিলে ভাত ঢাকা দেয়া, জমে যাওয়া মুরগির মাংস আর পালং শাকির চচ্চড়ি। হাপুস-হুপুস করে দুই মিনিটের মধ্যে ভাত শেষ করে জামা-জুতো ছেড়ে একটু চোখে মুখে জল দিয়ে নিলাম। রাত ২.০৬, অনেকের জন্য মাঝ রাত আর আমার বেলায় রাতের শুরু।

গাড়ি থেকে নেমেই খেয়াল করেছিলাম, ওলটানো রুপার থালার মত ঝকঝকে একটা চাঁদ আকাশে। একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে একটা গোল্ড ফ্লেকের মাথায় আগুন জ্বালাতে জ্বালাতে ছাদে এসে দাঁড়ালাম। বাড়ির পাশেই  সাউথ সিটির বিশাল বালির মাঠ, চাঁদের আলোতে চকচক করছে আর সাথে বোনাস হিসেবে এলোমেলো উত্তুরে হাওয়া। বুকের মাঝে সুখের হুটোপুটি, এমন রাতেই বুঝি মানুষ ফেসবুক পোস্ট দেয়, “লাইফ ইজ বিউটিফুল”। নিজের মধ্যে এতটাই ডুবে ছিলাম, হুঁশ ফিরলো আঙুলে সিগারেটের ছ্যাকায়। “ধুর বো*কা*চো*দা” নিজেকে নিজে কয়েকটা কষে গাল দেয়ার পরে মাথাটা একটু ঠান্ডা হল। ঘুরে পা বাড়ালাম ঘরে যাবার জন্য।

জমাট অন্ধকার সাবধানে দু’পা ফেলে সামনে তাকালাম দরজার দিকে আর জমে গেলাম বরফের মত। জীবনে ভয় পেয়েছি প্রচুর, লাইফ এন্ড ডেথ সিচুয়েশনেও দেখেছি আমার মাথা থাকে পরিষ্কার। সবসময় দেখে এসেছি মারাত্মক সিচুয়েশন গুলোতে কিংবা অকল্পনীয় প্রেসারের মধ্যে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে কিভাবে যেন আমার ভিতরের ভয়টা বেমালুম উবে যায়, সে সময়কার নেয়া ডিসিশানগুলো সব দিক থেকেই বেস্ট হয়। কিন্তু এবার উল্টো কাহিনি, শরীরের সাথে সাথে মাথাও জমে গেছে সামনের দৃশ্য দেখে। আমি জানি আমার চোখে প্রব্লেম আছে, চোখের চশমা আজ এগার বছর ধরে সেই প্রব্লেমের সাক্ষি দিয়ে আসছে। কেউ যখন বলে, “নয়ন তুমি ভুল দেখেছ” আমি মৃদু হেসে প্রতিবারই বলেছি, “মানুষ মাত্রই ভুল। কিন্তু সেদিন রাতে যা দেখেছিলাম তা একদম শতভাগ সঠিক দেখেছিলাম, চাঁদের আলো আর দরজার ফাঁক চুইয়ে আসা আলোতে একদম পরিষ্কার দেখেছিলাম।

কি দেখেছিলাম? এই লেখাটা লেখা শুরু করার আগেও অনেকক্ষন ভেবেছি কিভাবে বর্ণনা করা যায় “জিনিসটা”কে। আচ্ছা বর্ণনা দেয়ার আগে একটু অন্য কথা বলে নেই। আমার জন্ম হাওড়া সাঁতরাগাছি তে। বয়স যখন এগার মাস তখন চারপাশে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়ায় বাবা আমাকে আর মাকে ঢাকুরিয়ায় ঠাকুরমার কাছে দিয়ে যান, সেই থেকে আমি ঢাকুরিয়াতেই। এয়ারপোর্টের কাছাকাছি এই জায়গাতেই আমার নাড়ি পোঁতা। অন্ধকার আমার কাছে অপরিচিত নয়, কিন্তু কখনো স্বাচ্ছন্দ্য বোধও করিনি আঁধারে। ভুত-প্রেত এগুলি সম্পর্কে বরাবরি আমার মনোভাব ছিলো এমন যে কখনো হেসে উড়িয়ে দেইনি কিন্তু এগুলির অস্ত্বিত আছে তার পক্ষে সাফাইও গাইনি। বন্ধুদের প্রশ্নের জবাবে হাসিমুখে বলে এসেছি,“ভুত-পেত্নি থাকলে আছে না থাকলে নাই, না থাকলে তো কথাই নাই কেস ডিসমিস। থাকলে যেন আমার সামনে না পড়ে, আমার হার্ট দুর্বল।” মনে মনে সব সময় বলেছি “ভূত আমার পুত পেত্নী আমার ঝি! রাম লক্ষণ সাথে আছে, করবে আমায় কি?”গলায় যদিও ঠাকুমা একটা লকেট ঝুলিয়ে দিয়েছিল কোন তান্ত্রিক বাবার থেকে তা জানি না! বলেছিল কোনদিন আমাকে কোনরকম ভুতের ভয় পেতে দেখা যাবে না আর এই লকেটের জোরে সত্যি বলতে কি আমি ভূতেদের থেকে অনেক দূরেই ছিলাম। রাত্রিবেলা কাজ থেকে আসার পরে, ঠাকুরদার ঠাকুর মাকে ডিস্টার্ব করতাম না! এই একলা চিলেকোঠায় ফোনে প্রেমিকার সাথে বাকি রাতটা গল্প করে কাটিয়ে দিতাম। কোন একপক্ষের ঘুম এসে গেলে দুই পক্ষ চুপ করে যেতাম। সেদিনকে প্রেমিকাকে ফোন করার পরে জানতে পারলাম ওর কিছু একটা বিশেষ অসুবিধা আছে কিছুক্ষণ পরে আমাকে ফোন করবে।

সেদিন আমার প্রশ্নের জবাব আমি পেয়েছিলাম। জিনিসটা কি ছিলো আমার কোন আইডিয়া নেই । তান্ত্রিকদের ভাষায় কোন অশুভ আত্মা, হয়ত ছোট বেলার মামদো ভুত, স্কন্ধকাটা কিংবা অতৃপ্ত কোন আত্মা।

লম্বায় আমার থেকে হাতখানেক উঁচু হবে। চাঁদের আলোতে সাদা  কাপড়ে মোড়া অবয়ব বোঝা যাচ্ছে পরিষ্কার। আগাগোড়া মোড়া, মনে হচ্ছে মাত্রই স্নানের শেষে পরিয়ে দেয়া হয়েছে কাপড়খানা। আমার দিকে কেমন করে তাকিয়ে রয়েছে। চোখগুলো আগুনের মতন জ্বলছে, হাত পায়ের নখগুলো ভীষণ রকম বড়। খুব শীর্ণকার মানুষ কিন্তু হাড়গোড় দেখা যাচ্ছে। মাথার পিছনের চুল জীবনে প্রথমবারের মত সরসর করে দাড়িয়ে গেছে। আমি আমার অবিশ্বাস ভরা দু’চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছি। মাথা কোন দিকেই কাজ করছে বললে ভুল বলা হবে।

তখন আমার চিন্তা ভাবনার ৮০ ভাগ হচ্ছে ভয়, বাকি ২০ ভাগ মিশ্রিত মৃত্যু চিন্তা আর রাজ্যের প্রশ্ন আর কোন একটা, যেকোন একটা ভগবানের নাম গান মনে করার আপ্রাণ চেষ্টা। আর দশটা সাধারণ হিন্দু মানুষের মতন বিপদে পড়লে ভগবানের নাম নেওয়ার কথা মনে পড়ে। কিংবা হনুমান চল্লিশা পাঠ করতে হয়। যেমন হিন্দুরা কখনো ভুলে যায় না মন যদি যাওয়ার কথা। কিংবা কোন মন্দিরের সামনে দিয়ে যাতায়াত করলে হাত জোড় করে নমস্কার করার কথা। এইসব কথা কোন হিন্দুকে শিখিয়ে দিতে হয় না তারা আজন্ম এইসব করে থাকে, যেমন পূর্বদিকে হাত জোড় করে নমস্কার করা কিংবা গুরুজনদের ভক্তি ভরে শ্রদ্ধা করা। কিন্তু সেই দিন কোন কথা মাথায় আসেনি একটি বর্ণ সংস্কৃত উচ্চারণ মুখের ডগায় চলে আসেনি, এত মন্ত্র জানা সত্ত্বেও কেন যে কোন মন্ত্র উচ্চারণ করতে পারলাম না কিংবা কোন ভগবানের নাম নিতে পারলাম না সেইটা বলতে পারব না। মাথা তখন নিরেট শূন্য হয়ে গিয়েছে, বিন্দুমাত্র চিন্তা ভাবনা করার কোন অবকাশ নেই, কি করবো! আর কি না করব? এখন আমি কোন ভগবানের শরণাপন্ন হবো? এর পরবর্তীতে আমার কি পদক্ষেপ হবে? সম্পূর্ণ কিংকর্তব্য হীন অবস্থা! পা সামান্য হলেও নড়ছে না! সম্পূর্ণ জড়ভরত হয়ে গিয়েছি। ছাদের থেকে লাফ দিয়ে নিচে নেমে যাব? পূর্ব পাশের বিল্ডিংতো দোতলা, চোখ বন্ধ করে লাফ দিলে বেশি হইলে হাত-পা ভাঙবে, মরবো তো আর না। হায় ভগবান এইটা কি জিনিস। অন্য দিকে তাকা নয়ন ওইদিকে তাকাস না, এইরকম কেন ভোদাই। অন্য দিকে তাকা চোখ নামা ভাই না ভালা। এইট কিছুনা তোর চোখের ভুল। হে বজরঙ্গি গুনো বীর সাগর……., ধুর বাল বাল বাল। এইটা এখনো যায় না কেন? আমিতো ভয় পাচ্ছি। যা হুঁশ হুঁশ… বোকচো* এইটা কি তোমার মত মুরগি যে তাড়ালে চলে যাবে? জয় শ্রী রাম জয় হনুমান এখন আমি কি করবো? কিছু কেন করা যাচ্ছে না, মুখ কেন আড়ষ্ট হয়ে রয়েছে!!!” মুখ দিয়ে একটা শব্দও বাইরে করতে পারি ছিলাম না। একটা শব্দও না। হঠাৎ মনে হল জিনিসটা ভাসতে ভাসতে আমার দিকে আসছে। ওইটার নিচের দিকে একবারো খেয়াল করার কথা মনে হয় নাই, মন্ত্রমুগ্ধের মত মাথার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। পরিষ্কার মনে হল আবার অবয়বটা আমার দিকে এগিয়ে আসছে!!! “জয় শ্রীরাম জয় হনুমান” বলে আকাশ বাতাস ফাটিয়ে একটা চিৎকার দিতে চাইছিলাম ভগবানের নামে শপথ করে বলছি! কিন্তু বাস্তবে গোঁ গোঁ কিসিমের একটা আওয়াজ করে জ্ঞান হারিয়ে ছিলাম।

জ্ঞান ফিরার পরে একবার চোখ খুলে গাঢ় অন্ধকার দেখে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলছি ভয়ে। মাথার বামপাশে টনটন করছে ব্যাথায়। বুকের মধ্যে ব্রাজিলিয়ান সাম্বা আর ইন্ডিয়ান ঢোলের যুগলবন্দী। একটা বড় শ্বাস নিয়ে ডিসিশান নিলাম চোখ খোলা যাবেনা। যাই হোক না কেন চোখ খোলা যাবেনা। বামহাতটা শরীরের নিচে চাপা পড়ে আছে, ইঞ্চি দুয়েক নাড়িয়ে টের পেলাম পকেটে সিগারেটের প্যাকেট জায়গা মতই আছে। ভরসা আরো বাড়ালো ভরসা ম্যাচের উপস্থিতি। বিশ্বাস করেন প্লিজ, আমি ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির মাঝেও চলন্ত রিকশায় বসে সিগারেট জ্বালাতে পারি। কিন্তু সেদিন যেন অনন্তকাল পার হবার পর নাকে আসল বারুদ পোড়া গন্ধ অনুমানে একটু বেশি নড়া দেওয়ার পরে ফুসফুসে ঢুকল নিকোটিন। খুশিতেই বোধ হয় খক খক করে কেশে উঠলাম। মাথা ঠান্ডা হচ্ছে এখন, লজিক ক্লিয়ার। হনুমান চল্লিশা মনে পড়ে গেছে, “ জয় হনুমান জ্ঞান গুণসাগর

জয় কপীস তিহুঁ লোক উজাগর…”

 মনে মনে দুইবার পড়ার পরে একটু সাহস আসার পরে একবার একটু জোরে জোরে পড়লাম।

সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে ঠিক করলাম এইবার আমি উঠব। প্রথমে ম্যাচের একটা কাঠি জ্বালিয়ে ওই জিনিসটা যেদিকে ছিলো সেদিকে একবার তাকাবো যদি এখনো ওখানে থাকে তাহলে দু কদম দৌড়ে পূর্ব পাশের ছাদে লাফ দিবো আর না থাকলে দৌড় দিবো ঘর বরাবর। হাতে সিগারেটের আগুন আছে তারপরও ম্যাচ জ্বালাব, চান্স নেয়ার কোন মানে হয়না। ভয় এমনি জিনিস বাপ! হুহু…

ম্যাচ জ্বালানো, চোখ খোলা, হুড়মুড়িয়ে উঠে ঘরে ঢুকে দরজা লাগানো সব মিলে সময় লেগেছে পাঁচ সেকেন্ড, ট্রাস্ট মি অনলি পাঁচ সেকেন্ড। ঘুরেই দেখি টেবিলে রাখা আমার মোবাইল ঘুরছে ভয়ের চোটে আবার জ্ঞান হারানোর আগেই মনে পড়ল ভাইব্রেশন মুড নামে একটা জিনিস আছে। রিসিভ করার সাথে সাথে ওপাশ থেকে একগাদা হুমকিধামকি গালি-প্রশ্ন হযবরল… আরো দুইটা সিগারেট আর অনেক অনেক তোতলামির পরে প্রেমিকাকে পুরো ব্যাপারটা বলার পরে সে যখন মেঘ স্বরে বলল, “আর কত মিথ্যে কথা বলবি তুই, কলকাতার ছেলেদেরকে খুব ভালো মতই চিনি আমি। আরেক ফোনে কার সাথে কথা বলছিলিস সেইটা কে হারামি” তখন মনের দুঃখে  স্তব্ধ আর বোবা হয়ে গেছিলাম, “ শালার এতদিন প্রেম করার পরে নিজের গার্লফ্রেন্ড কেই যদি বিশ্বাস না করাতে পারলাম তাইলে আর মানুষ বাল বিশ্বাস করব!”

মন্দিরের ভোরের ঘন্টা বাজার আগে পর্যন্ত  কত কিছুর প্রতিজ্ঞা শপথ করতে হয়েছে, কত হাজার শব্দ খরচ করতে হয়েছে সেটা খালি আমি জানি, সেই গল্প আমার কাছেই থাক। আপনাদের উপর কোন প্রেসার নাই। চাইলে বিশ্বাস করবেন নাইলে না, আমার কিছু যায় আসে না। তবে মন থেকে বলছি, যদি বিশ্বাস নাই করেন উল্টা এই ব্লগ পোস্টে এসে আমাকে মিথ্যা খারাপ বলে যান তাইলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রার্থনা করব যাতে তিনারা আপনারে একবার হইলেও দর্শন দিয়ে যায়। তাইলে বুঝবেন, কত ধানে কত চাল! হুহ!

বি.দ্র.: প্রেমিকার সাথে কথা বলার সময় এক ফাকে ঘড়ির দিকে তাকিয়েছিলাম। রাত তখন চারটে দশ।

 87 total views,  2 views today