আমার জীবন

কলমেসোনালী  মুখার্জী

আড়ুপাড়া,সাঁতরাগাছি, হাওড়া

লড়াই ছিল অন‍্যরকম।অভাব গ্রাস করলেও অশান্তি গ্রাস করেনি সংসারে।শত অভাবেও মায়ের মুখে হাসি ছিল সর্বক্ষণ।কেহ কোনদিন জানতেও পারেনি  কীভাবে আমরা দিন গুজরান করেছি।পড়াশোনা করেছি আমরা।

আত্মীয়  স্বজন একটু ঈর্ষান্বিত  হত আমাদের পরীক্ষার ফলাফলে।যাদের দুবেলা খাবার জোটেনা ভালোভাবে তারা কীভাবে পড়া মনে রাখে?

আচ্ছা আশ্চর্য‍্য!

নিজেরা টিউশন করে পড়াশোনা চালিয়েও সংসারের দায় দায়িত্ব  পালন করতাম।বাবার পাশে থাকার চেষ্টা করতাম। অভাব এক একজনের কাছে এক এক রকম। আমরা পেট ভরে এবার দুবেলা খেতে পারতাম। বাইরে যাবার জন‍্য পোশাক ছিল।সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে চলতে পারতাম।আর এটাই ছিল আমাদের  অহংকার।

বাবা কমিউনিস্ট  ছিলেন।ভালোবেসে কাজ করতেন।কোন সুযোগ সুবিধা পাবার জন‍্য নয়।

আমরা তোষামোদ  করা পছন্দ করতাম না।বাবার  থেকে সেই শিক্ষা পেয়ে এসেছি। কোন সুযোগ সুবিধা  নেবার বিন্দুমাত্র  ইচ্ছা আমাদের ছিল না।

এখানেই বাধ সাধলো আমাদের  উন্নতি। নম্বর থাকলেই সব পাওয়া যায় না।

আমরা ব‍্যাগ ভর্তি ডিগ্রী নিয়ে বাড়ি বাড়ি টিউশন করতেই  লাগলাম।

এভাবেই  ছোট বোনেদের বিয়ে হলো। না,বিশাল কিছুই  নয়।সৎ পাত্র দুবেলা দুমুঠো জুটে যাবে।মাথা গোঁজার আশ্রয়  যথেষ্ট আছে।জমি জমাও আছে।বিদ‍্যেবুদ্ধিও যথেষ্ট। দেনাপাওনার ধার দিয়েও তারা যায়নি।

সংসারে সদস‍্য সংখ‍্যা কমলেও বাবা -মায়ের অসুস্হতা বাড়লো।

আমার  বাঁধাধরা একটা কিছু হলে একটু নিশ্চিন্ত হওয়া যেত।

সম্বন্ধ এলো,খোঁড়া মেয়েকে বিয়ে করলে ওরা সরকারী চাকরী করে দেবে।বাড়িটাও নূতন করে বানিয়ে দেবে।অভাব হবে না। জীবন টা আমার প্রতিবন্ধী করে দেবার নেশায় মেতে উঠেছে পাত্রীপক্ষ। প্রতিবন্ধী যদি হতেই হয় তবে কোন কিছুর পরিবর্তে নয় এমনিই  বিয়ে করবো খোঁড়া মেয়েকে।

বাবা বললেন,বিয়ে তোমাকে  করতে হবে না কোনোকিছুর বিনিময়ে। বিয়ে করতে হলে নিজের মতে নিজের মতো করে বিয়ে করবে।

মা বললেন,সারাজীবন তোমার কথা শুনে অভাবেই দিন কাটলো।সারাজীবন সুখের মুখ দেখতে পেলুম না।

একটা প্রতিবন্ধী মেয়েকে বিয়ে করে ছেলেটা প্রতিবন্ধী হবে না কী?কোন কিছুর বিনিময়ে  বিয়ে করলে মেয়েটা তো স্বাভাবিক  হবে না। তাই বিয়েটা এখন বন্ধ থাকবে।

বাবা আরো অসুস্হ হলেন। বেশির ভাগ মানুষ  আমাকে কিনে সুখ দিতে চাইলো।আমি বাবাকে সুস্হ করতে পারিনি।বাবার ক‍্যানসার হয়েছিল।দীর্ঘদিন ভোগার পর মারা গেলেন।

বোনেদের ভরাভর্তি সংসার।ওরা আসে বিশেষ সুবিধা নিয়ে।সব যেন বদলে গেল।মা দুঃখ করতে থাকেন,আর ভালো লাগেনা,দুবেলা রান্না করা।তাঁর ছুটি নেই।মাকে খুশি করতে পারিনি।বোনেরা নিয়ে যেতে চাইলে বলেন,কোথাও যাবার বিলি আমার নেই।রান্না করবে কে?মা কে বলেছি মা,দু চারটে দিন আমি দোকানের কেনা খাবার খেয়ে নেব।তুমি একটু ছুটি নাও।

মা বলেন,আমি ছুটি একেবারেই নেব।মা মিথ‍্যে অভিমাণ করেন আমার উপর।পরের মেয়েকে কষ্ট দেবার অধিকার  আমার নেই।

আমার  বোনেরা কষ্ঠে থাকলে আমার  তো কষ্ট হতো।আজ ওরা সুখে শান্তিতে আছে আমি ও ভালো আছি। মাকে বোঝাতে পারিনি। আমার অভাবের সংসারে কাহকে কষ্ট দিতে আনতে পারিনি।

এইভাবে বেশ কয়েক বছর কাটার পর একটা সরকারি  চাকরী পেলাম নিজের ক্ষমতায়।

দূরে বদলি হয়ে গেলাম।মা আর ছেলে।

হঠাৎ  করে বিনামেঘে বজ্রপাত।

মা সেরিব্রাল এ‍্যাটাকে মারা গেলেন। মাকে পোড়াতে গিয়ে ফেরার পথে রোড এ‍্যাক্সিডেন্টে আমার  পা দুটোই বাদ গেলো।

এখন কাঠের পা নিয়ে কোন রকমে নিজের টুকু চালিয়ে নিই।

না আমি কারো অনুকম্পা চাই না।

বিধাতা আমাকে শক্তি দিন এই আমার  প্রার্থনা।

সেই মেয়েটি যোগাযোগ  করেছিল,এখন আমরা দুজনেই এক পথের পথিক। চাইলে আমরা একসাথে বাকী পথ চলতে পারি।

আমি বলেছি,বাকি পথটা আমি ঈশ্বরের ভরসায় চলবো।ক্ষমা করবেন আমাকে।

 37 total views,  6 views today