দু:সাহসীক প্রেম

কলমে –-শ্রী সুবোধ চন্দ্র সরকার

এম,কম, এলএল,,বি আইনজীবী

Phone 9477443110

 

রমেন দা, দাঁড়াও, তোমার সাথে একটা কথা আছে। ট্রেন থেকে নেমে কিছুদূর যাবার পর একটু নিরালা জায়গায় সুরেলা কন্ঠে কার গলায় কথাটা শুনে পিছন ফিরে তাকিয়ে রমেন যাকে  দেখে অবাক হয়ে গেল, উষ্কো খুশকো চুল চোখ লাল অদ্ভুত এক চাহনি, নারীর এই রূপ রমেন প্রথম দেখলো। এ যে শ্রাবণী ,তার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে কথা বলছে,একদমে বলে ফেলল রমেনদা, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই, তুমি না বলতে পারবে না, আমি তোমাকে ভালবাসি ,–রমেনদা, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। রমেন বলল ,কি আশ্চর্য! হঠাৎ তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাইছ কেন? আমাদের মধ্যে সেরকম তো কিছু হয়নি। এটা এখন অসম্ভব, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে ,আমি কিছুতেই তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। এই কথা শুনে শ্রাবণী বলল, দেখো রমেনদা, সত্যি করে বল তুমি আমাকে ভালোবাসো কি না? তুমি মুখে বলতে পারোনি ,কিন্তু আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো। কি পাগলের মতো বকছো, এখন আর কোনমতেই সম্ভব নয়। সম্ভব নয় ,এই কথা বলে শ্রাবণী তার কোমরে গোজা পিস্তলটা বের করে রমেনকে নিশানা করে একটা গুলি করে ফেলল। গুলিটা রমেনের  পেটে লাগলো। মাগো! বলে চিৎকার করে রমেন মাটিতে পড়ে গেল। এই দৃশ্য দেখে শ্রাবণী  নিজেকে ও একটা গুলি করল, এবং সেখানে পড়ে গেল। আশেপাশের লোকজন ধরাধরি করে তাদেরকে হাসপাতালে নিয়ে গেল।

রমেন, অর্থাৎ রমেন রায়  ধনী পিতার একমাত্র সন্তান, পড়াশুনার অত্যন্ত মেধাবী, এমএসসি পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে পাশ করে । চাকরির পরীক্ষায় পাশ করে রেলের স্টেশন মাস্টারের পোস্টে বছরখানেক হলো চাকরি পেয়েছে। পরিবার

আত্মীয়-স্বজন খুব খুশি ,রমেনের মা সুলতা দেবী রমেনের বাবা, কিশোরী মোহন কে রমেনের বিয়ের জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলো। কিছুদিন হলো রমেনের বিয়ের যোগাযোগ করে বিয়ের সমস্ত কিছু ঠিক হয়ে গেল।  যার সাথে রমেনের বিয়ে ঠিক হল, বন্দনা সেন অফিসে করণিক পদে চাকরি করে, পড়াশোনা গ্রাজুয়েট পর্যন্ত। দুপক্ষ দেখাশোনা করে বিয়ের দিন স্থির হয়ে গেছে বিয়ের আর মাত্র ১৫ দিন বাকি আছে তারই মধ্যে এই অবাঞ্ছনীয়  ঘটনা ঘটে গেল। দুজনকে হাসপাতালে নিয়ে গেল, পুলিশ ও হাসপাতালে পৌঁছল। ডাক্তার বাবুরা অনেক চেষ্টা করে দুজনের শরীর থেকে গুলি বের করে দিল এবং তারা উভয়েই  প্রাণে বেঁচে গেল । সুস্থ হওয়ার পর  খুন করার উদ্দেশ্যে মামলায় শ্রাবনী কে পুলিশ আদালতে পেশ করলো। বিচারে শ্রাবণীর তিন বছর  জেল হয়ে গেল । এ দিকে রমেনের বিয়ে ভেঙে গেল, কারণ মেয়ে পক্ষ আর সাহস পেল না। এরকম ছেলের সাথে বিয়ে দিতে তারা রাজি হতে পারল না।

এর মধ্যে রমেনের দু’বছর চাকরি হওয়ার পরে অন্যত্র বদলি  হয়ে গেল। কিছু দিন চাকরি করার পর সেখানে তার এক সহকর্মী রূপসা রায়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব গাঢ় হল। বন্ধুত্ব থেকে তারা এখন কাছাকাছি হয়ে উভয়ে উভয়ে কে ভালবাসতে শুরু করল। এখন তারা দুজনে প্রেমিক-প্রেমিকা, তারা দুজনে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখতে লাগলো । রূপসা রায় কে একটা রবিবারে রেস্টুরেন্টে দেখা করতে বলল রমেন। রমেন বলেছিল দুজনে রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া করে একটু দূরে ঘুরতে যাবে ঠিক করেছিল।

রবিবার সকাল থেকে রমেন প্রস্তুতি নিচ্ছিল, সবকিছু করে সময় যেন আর কাটতেই চাইছিল

 না । রমেন বেলা দেড়টার সময় বেরিয়ে পড়ল রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে। ভাবল বাড়িতে অস্থির হবার চেয়ে রেস্টুরেন্টে বসে চা কফি খাবে ,তাতে সময়টা কেটে যাবে।

কিন্তু রেস্টুরেন্টে ঢুকে রমেন এ কি দেখলো! রূপসা রায় একজন যুবকের সাথে টেবিলে বসে কি খাওয়া-দাওয়া করছে আর গল্প করছে এবং মাঝে মাঝে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। রমেন সাবধানে আড়ালে দাঁড়িয়ে তাদের কথাগুলো শুনতে লাগল। পুরুষ বন্ধুটি রুপসা কে বলল যতই আনন্দ করি, তোমাকে কি আমি পাব, তোমার অফিসের রমেন বাবু তো তোমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, বেস্ট ফ্রেন্ড। ওর সঙ্গেই হয়তো ভবিষ্যতে ঘর বাঁধবে।

 রূপসা বললো, ক্ষেপেছো, আমি ওকে বিয়ে করব? ওর জীবনের সব কথা আমাকে বলেছে, ওকে বিয়ে করতে না পেরে, একজন জেলে বন্দি আছে,  মুক্ত হয়ে সে কি করবে বলা যায় না। ধনী ঘরের সন্তান, ভালো চাকরি, অনেক রোজগার তাই ওকে ভালোবাসার অভিনয় করে কিছু কামিয়ে নেওয়া যায়। এখন তো ওর গাড়িতে অফিসে যাতায়াত করি। ওর পয়সায় টিফিন খায়, মাঝে মাঝে গিফট কিনে দেয়, মন্দ কি! দুটো আদর করে কথা বলা, একটু গা ঘেসে চলা ব্যস, এই পর্যন্ত।

তুমি একটা পাগল! তুমি একথাটা কি করে বলতে পারলে? তোমার আমার প্রেম কি আজকের, দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা এই কথা বলে দুজনে হেসে ফেটে পড়ল।

এই দৃশ্য দেখে রমেনের হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। এ  সে কি দেখল! যে রূপসা তাকে ছাড়া বাঁচবে না বলে, আবার এখানে আর এক কথা বলছে ।

রমেন আর সেখানে দাঁড়ায়নি ,ওখান থেকে চলে এলো বাড়িতে। এসে সাত পাঁচ ভাবতে লাগলো, কি করবে সে এখন? ভাবতে ভাবতে শরীরটা অবসন্ন হয়ে আসছিল, এবং সে জানেনা কখন সে ঘুমিয়ে পড়ল। ওদিকে বিজয় বিশ্বাস, রুপসা কে বলল আমি এখন চলি ,তোমার রমেন বাবুকে তুমি এখন সামলাও। পরে সব কথা ফোন করে জানবো ,বলে ওখান থেকে চলে গেল।

 তিনটে বাজল, সাড়ে তিনটে ,চারটে বেজে গেল তবুও রমেন এলো না। রুপসা একটা ফোন করলো কোন অসুখ-বিসুখ করলো কিনা কিন্তু ফোনটাও সুইচ অফ। আর কিছুক্ষণ পরে রুপসা বাড়ির পথে রওনা হল।

এদিকে তিন বছর কারাদণ্ড ভোগ করে শ্রাবণী ছাড়া পেল। শ্রাবণী খুব কাজের মেয়ে ছিল, তাই পুরনো অফিসে যোগাযোগ করলে আবার তাকে কাজে যোগ দিতে বলল। তার অফিস মেনে নিল অপরাধ করেছে, শাস্তি হয়ে গেছে আর কোন ভুল নিশ্চয় সে করবে না। তার অফিস একটা টেন্ডার জমা নিয়েছিল, আগামীকাল তার সাক্ষাৎকারের দিন, রেলের পারচেজ অফিসারের সাথে কথা বলার জন্য শ্রাবণীকে ভার দেওয়া হলো। পরদিন শ্রাবণী কাগজপত্র নিয়ে রেলের পারচেজ অফিসারের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য রওনা হল। শ্রাবণী রেলের অফিসে ঢুকে যখন অফিসারের ঘরে ঢুকতে যাবে, বলল, মে আই কামিং স্যার। এবং অফিসার কে দেখে শ্রাবণী চমকে উঠল এ সে কি দেখছে! অফিসারের চেয়ারে বসে আছে রমেন রায় ,যাকে সে খুন করতে গিয়েছিল। রমেন বলল ইয়েস কাম্ ইন্, বলে শ্রাবণীকে দেখে সে অবাক হয়ে গেল। একসঙ্গে দুজনে বলে ফেললো– তুমি। শ্রাবণী বলল ব্যক্তিগত কাজ পরে হবে আমি অফিসের যে কাজে ,এসেছি সেটা   দেখ। অবশ্যই রমেন বলল,এবং কাগজ দেখতে বসে গেল। এই কাগজগুলো একটা জায়গায় জমি দিতে হবে। চল, আমরা ক্যান্টিনে একটু চা খাই। শ্রাবণী বলল তা খাওয়া যাক। বলে দুজনে ক্যান্টিনে এসে  কফি এবং  টোষ্টের অর্ডার  দিয়ে দুজনে মুখোমুখি দুটি চেয়ারে বসে পড়ল। শ্রাবণী বলল বিয়ে তোমার হয়নি। আমি জানতাম বিয়ে হবে না,কারণ যার প্রেমিকা বিয়ের জন্য গুলি করে তাকে কে বিয়ে করবে? সত্যি বলছো রমেন বলল। শ্রাবণী বলল, তোমাকে মারতে চেয়েছিলাম, ঠিকই কিন্তু আমিও বেঁচে থাকতে চাইনি, দুজনে একসঙ্গে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিলাম। আমি পরে বুঝেছিলাম, তুমি আমাকে কতটা ভালবেসেছিলে, রমেন বলল।    আচ্ছা, আমরা আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে পারি না। এইভাবে কথা বলতে বলতে কখন রমেন শ্রাবণীর হাত ধরেছিল সে বুঝতে পারিনি। শ্রাবণী, কেঁদে ফেলেছিল ।এবার ওঠা যাক , রমেন বলল ,আমার কথাট—। শ্রাবণী বলল ,ভেবে দেখব।

পরের দিন রূপসা অফিসে এসে জিজ্ঞাসা করল, কাল রেষ্টুরেন্টে এলে না কেন? আমি তোমার জন্য চারটে পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। রমেন বলল,শরীরটা ঠিক ছিল না। ফোনটা সুইচ অফ করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তাছাড়া একটা জিনিস দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, আমি সঠিক দেখলাম না ভুল দেখলাম। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে বাড়ি এসে শুয়ে পড়েছিলাম। টিফিনের সময় রূপসা কে রমেন ক্যান্টিনে ডেকে নিয়ে যায় এবং গতকালের সব কথা যখন জানালো রূপসার মুখটা ছোট হয়ে গেল। কিছু না বলে সেখান থেকে চলে গিয়েছিল।

রূপসা বিজয় বিশ্বাসকে সব কথা খুলে বলল এবং রুপসা বিজয় বিশ্বাস কে কিভাবে রমেনকে শিক্ষা দেওয়া যায় সে বিষয়ে দেখতে বললো। রুপসা রমেন কে একটা ফোন করলো,এবং বলল, আমি রুপসা বলছি, আমার দশ লক্ষ টাকার দরকার, তোমাকে দিতে হবে, যদি না দাও, তাহলে আমার সঙ্গে যে এফিয়ারস গুলো করেছ ,তা ভাইরাল করে দেবো, এবং তোমার বিরুদ্ধে মামলা করব। এতদিন আমায় লোভ দেখিয়েছো এবং ভোগ করেছো এবং ঠকিয়েছো। ফোনে কথাগুলো শুনে রমেন হতবাক হয়ে গেল। বলল তুমি যা খুশি কর আমি দিতে পারবো না বলে ফোন রেখে দিল।

রমেন একবার শ্রাবনীকে ফোন করলো, বললো, শ্রাবণী তুমি একবার আমার সাথে দেখা করবে, খুব দরকার আছে। শ্রাবণী বলল অফিসের পরে কল্পনা রেস্টুরেন্টে এসো ,সেখানে  কথা হবে। রমেন বলল ঠিক আছে বলে ফোন ছেড়ে দিল।

যথা সময় তারা দুজনে কল্পনা রেস্টুরেন্টে পৌঁছালো এবং রমেন অকপটে সব কথা শ্রাবণী  কে বলল। শ্রাবণী সব কথা শুনলো, এবং  তার চোখ দিয়ে যেন আগুন বেরহয়ে আসছিল। তারা খেয়ে দেয়ে উঠে পড়ল এবং রমেনের হাত চেপে ধরে শ্রাবণী বলল,কোন ভয় নেই দেখছি, আমি ,কি করা যায়।

পরের দিন আবার ও রুপসা রমেনকে ফোন করলো বলল কিছু ঠিক করলে আমার টাকা টার জন্য। রমেন বলল আমি তো বলেই দিয়েছি, আমি টাকা দিতে পারব না বলে ফোন ছেড়ে দিল। রমেন ফোনের কথাটা শ্রাবনীকে জানালো । ঠিক আছে ,আমি চিন্তা করছি দেখি কি করা যায়।

শ্রাবণী পরের রবিবার বিকেলে একটা চার চাকা গাড়ি নিয়ে বের হলো এবং যে রেস্টুরেন্টে রমেনকে রূপসা যেতে বলেছিল, সেখানে গিয়ে দেখল রুপসা এবং বিজয় দুজনে রেস্টুরেন্টে  বসেই গল্প করছে। শ্রাবনী রেস্টুরেন্টে খাবার অর্ডার দিয়ে ওদের গতিবিধি লক্ষ্য করতে লাগল। এইবার কিছুক্ষণ পর রুপসা বিজয় একটা স্কুটারে চড়ে যাত্রা শুরু করল। শ্যামলী চারচাকা গাড়িতে বসে ওদেরকে অনুসরণ করতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষন যাওয়ার পর শ্রাবণী একটা নির্জন জায়গায় জোরে বিজয় দের স্কুটার কে ধাক্কা মারল। তারা দুজনে পড়ে গেল খালে স্কুটার সমেত এবং স্কুটার ও ওদেরকে আর দেখতে পাওয়া গেল না। শ্রাবণী খুব সন্তর্পণে  ফিরে এল কাউকে কিছু জানালো না। পরের দিন খবরের কাগজে বের হলো দুজন প্রেমিক প্রেমিকা স্কুটারে যাচ্ছিল দুজনের প্রাণ হারিয়েছে। তাদের নাম দিয়েছে যুবকের নাম বিজয় সেন এবং তরুণীর নাম রুপসা রায়।

 শ্রাবণী ফোন করে রমেনকে বললো রমেন দা কাগজ পড়েছ? দেখো ঈশ্বর ওদেরকে নিয়ে নিল। আমাদের ভালোবাসার জয় হলো, এবার আর আমাদের সংসার করার কোন বাধা থাকলো  না। রমেন বলল হ্যাঁ পড়লাম। এবার আমরা নিশ্চিন্তে সংসার করতে পারব। শ্রাবণী ঈশ্বরের দূত হিসেবে কাজ করেছে। এই কাহিনী সম্পূর্ণ কাল্পনিক, যদি কারো জীবনের সাথে মিলে যায় তাহলে লেখক দায়ী নন। তবে একটা কথা না জানিয়ে পারছি না, সে প্রেম হোক বা ভালোবাসা কতটা দুঃসাহসী হতে পারে তার প্রমাণ শ্রাবণী মিত্র।

Loading