সরকারি রেশনের ঘুম
কলমে – বনানী শিকদার
রাতে সানির মাঝে মাঝেই ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। আর ঘুম ভাঙলে এক ঘণ্টা, দেড় ঘণ্টা করে জেগে থাকছে। চাকরিতে কাজের চাপের চিন্তা, সংসারের ঝামেলা, বাড়ির ইএমআইন এবং বউ-এর ঝগড়ার অতীত ও বর্তমানের ইতিহাস সানিকে জাগিয়ে রাখছে। বেশ কিছুদিন ধরে এমন চলার পর এখন সে রীতিমতো অসুস্থ বোধ করতে শুরু করেছে। আজ রাতে বিছানায় গিয়েই তার মাথায় এক অদ্ভুত চিন্তা এল—ইশ, বাজারে যেমন চাল, ডাল, তেল, নুন কিনতে পাওয়া তেমন ঘুমকেও যদি কিনতে পাওয়া যেত! যদি বাজারের কোনো দোকানে প্যাকেটে লেখা থাকত—ঘুম। ভাবনা তার আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল—যদি প্যাকেটে ঘুমের ধরন এবং দাম লেখা থাকত। যেমন—
গভীর ঘুম—৮ ঘণ্টা। ৪০ টাকা
স্বপ্নসহ ঘুম—৮ ঘণ্টা। ২০ টাকা
কি করত সানি তাহলে? এখন তার টাকার সমস্যা। সুতরাং আপাতত স্বপ্নসহ ঘুমই সে কিনত।
ভাবতে ভাবতে সানি তার ছাড়া ছাড়া সংক্ষিপ্ত ঘুমের প্রথম পর্যায়ে ঢুকে পড়ল।
অল্প সময় পরেই অদ্ভুতভাবে স্বপ্নও দেখতে শুরু করল সে। সত্যিকারের বাজারে সে যেমন শুধু চায়ের দোকান থাকে তেমন স্বপ্নে একটা শুধু ঘুমের দোকান দেখল। গেল সে সেখানে। দেখল সাইনবোর্ডে এক কেজি ঘুমের নানা রকম অফার আছে এবং সেই নানা রকম ঘুম কিনতে লোক লাইনের তোয়াক্কা না করে দোকানদারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে।
কেউ বলছে দাদা আমাকে স্বপ্ন-ফ্রি ঘুম দিন।
কেউ বলছে মশার কামড়মুক্ত ঘুম দিন।
কেউ বলছে আমাকে বউয়ের বকাঝকা-প্রুফ ঘুম দিন।
কেউ বলছে আমাকে সোমবার-প্রুফ ঘুম দিন।
বাকিগুলো সানি বুঝল। কিন্তু সোমবার-প্রুফ ঘুম! সেটা আবার কি? ভিড়ের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা লোককে সে জিজ্ঞেস করল। ‘এই সোমবার-প্রুফ ঘুমটা আবার কি?”
লোকটা উলটে তাকে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি করেন মশায়?”
“চাকরি।”
“আপনার সাপ্তাহিক ছুটি কবে?”
“শনি এবং রবি।”
“দু’দিন ছুটি কাটিয়ে সোমবারে আপনার অফিসে যেতে খুব ইচ্ছে করে বুঝি?”
“একদমই না।” বলেই সানি তার বোকামির জন্য লজ্জা পেল। ‘বুঝেছি বুঝেছি।”
তারপর সেখানেই সে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল এবং ভিড় কম হলে দোকানদারের কাছে গেল। “আপনি ঘুমে অফার…মানে ঘুমে কিছু টাকার ছুট কেন দিচ্ছেন?”
দোকানদার বলল, “এটা একটা সরকারি দোকান। বহু লোকের ঘুমের সমস্যা এবং তার সঙ্গে যুক্ত শারীরিক অসুস্থতার কারণে সরকারই ভর্তুকিযুক্ত দামে অর্থাৎ সাবসিডিতে ঘুম বিক্রি করছে। আপনারা হলেন দেশের নাগরিক। তাই রেশনে যেমন গরীব নাগরিকদের চাল, ডাল, তেল, নুন সরকার কম দামে দিয়ে থাকে তেমন…বুঝলেন না? এটাকে একটা সরকারি রেশনের দোকান বলেই ভাবতে পারেন।”
“সরকারি রেশনের দোকানে খরিদ্দারের হাতে রেশন কার্ড কেন দেখলাম না?”
“সরকার জানে ঘুমের খরিদ্দাররা কখনো ফ্রড হয় না, তাই।”
সানি বলল, “আমার অনিদ্রা যাবে এমন ঘুম আছে আপনার কাছে?”
“আছে, কিন্তু দাম একটু বেশি পড়বে।”
সানি ভাবল, রেশনে কতই আর দাম বেশি হবে। “ঠিক আছে সেটাই দিন।”
দোকানদার তাকে একটা বোতল দিল। সানি দেখল বোতলের গায়ে লেখা আছে—“VIP ঘুম।”
“কত টাকা?”
“১৫,০০০।”
সানি চমকে উঠল, “পনেরো হাজার! আমার এক মাসের বেতনের সমান!”
“দাদা, এক কেজি ঘুম আপনার রোজ ২ গ্রাম করে ৫০০ দিন চলবে। এর আসল মূল্য ছিল ৩০,০০০ টাকা। ৫০ শতাংশ সাবসিডি, ভাবতে পারছেন?”
“ওহ্, কিন্তু আমার প্রতি মাসের স্যালারি তো বউ-এর হাতে চলে যায়। কি করে কিনব?”
দোকানদার চিন্তায় পড়ল। কিছুক্ষণ গালে হাত রেখে ভেবে সে বলল, “একটু দাঁড়ান তো। আমার কাছে একটা ছোট্ট ফ্রী-স্যাম্পল বোতল ছিল।” ভেতরে সম্ভবত স্টোররুমে গেল সে এবং মিনিট দুই পরে ফিরে এসে বোতলটা সানির হাতে ধরিয়ে দিল। “দশ গ্রাম আছে। আপাতত এটা নিয়ে যান। পাঁচদিন নিয়ে দেখুন।”
বোতল খুলল সানি। দেখল তার ভেতরে পাঁচটা কাগজের টুকরো। পাঁচটাতেই লেখা আছে—বিছানায় যাওয়ার অন্তত দু’ঘণ্টা আগে মোবাইল স্ক্রিন লক করুন, বিছানায় গিয়ে চোখ বন্ধ করুন এবং মাথায় ভালো-খারাপ চিন্তার যে ঘরগুলো আছে সে সবের দরজা বন্ধ করে দিন।
সানি বলল, “মোবাইল স্ক্রিন লক করব কেন বুঝলাম, কেননা মোবাইলের স্ক্রিনের আলোটা চোখকে বড় উত্তেজিত করে; চোখ বন্ধ করার কথাও বুঝলাম, কেননা আমি ঘোড়া নই যে চোখ খুলে ঘুমোতে পারব; খারাপ চিন্তার দরজা বন্ধের কারণটাও বুঝতে পারলাম, কেননা ওই চিন্তাগুলোই আমাকে ঘুমের সত্যনাশ করে রেখে দিয়েছে। কিন্তু ভালো চিন্তার ঘরের দরজাও বন্ধ করব কেন?”
“কেননা ভালো চিন্তা ওজনে ভারি হয়ে গেলে ২ গ্রামের ভিআইপি ঘুমও আপনার অনিদ্রার রোগটা সারাতে পারবে না।”
সানি বাড়ি এল। বিছানায় গেল এবং ২ গ্রাম ভিআইপি ঘুম নিয়ে পাঁচ মিনিট চোখ বন্ধ করে রইল।
সেই রাতেই সানি ঘুমের দোকানের স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে এসে গভীর ঘুমে প্রবেশ করল। উঠল একেবারে সকালে একদম সতেজ হয়ে। জানালার কাছে গিয়ে সে ভাবল—ইশ, যদি দোকানটা সত্যি হত, সত্যিই কত মানুষ লাইনে দাঁড়াত
182 total views, 4 views today