একটা বিস্কুটের জন্য
কলমে – সোনালী মুখার্জী
আড়ুপাড়া,সাঁতরাগাছি, হাওড়া
রাতুল বাবু ব্যবসা করেন।ছেলেমেয়ে,বৌ নিয়ে সুখের সংসার।দুই মেয়েকে দেখতে খুব সুন্দর। ছেলে স্কুলে পড়ে।মেয়েরা মাধ্যমিক দিয়ে আর পড়েনি।শান্ত শিষ্ট আর ভদ্র।পাড়ায় সকলে বেশ ভালোবাসে।
রাতুল বাবুর দুই ভাই,ভায়েদের বৌ,দুই ভাইপো,দুই ভাইঝি আর মা কে নিয়ে সংসার।সকলে এক বাড়িতেই থাকে। যে যার আলাদা সংসার।
মা যখন যার কাছে পারেন খেয়ে নেন।তা নিয়ে কোন সমস্যা নেই।জমিজমা নিয়েও কোন সমস্যা নেই।দুই ভাই অপরের দোকানে চাকরী করে।
দুই বোনের বিয়েও বাবা দিয়ে গেছেন। এক বোনের একটি মেয়ে,আর এক বোনের এক ছেলে।ওরা সব কলেজে পড়ে।
খুব ছোট বেলায় বোনেদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছে বাবা।
বোনেরাও যে যার সুবিধা মতো ভাই,দাদার কাছে আসে।সবাই বেশ আনন্দেই থাকে।
ওরা ধনী নয় বটে তবে মন বেশ ভালো।সকলে মিলেমিশে থাকে।একে অপরের পাশে থাকে বিপদে- আপদে।
রাতুল বাবুর বড়ো মেয়েকে দেখে পছন্দ করেছে পাশের গ্রামের এক ভদ্রলোক তার ভাগ্নের জন্য।
লেখাপড়া বেশি শেখা হয়নি বাপ মরা ছেলেটির।বাবা মারা যাবার পর চালের কারবার ছেলে দেখাশোনা করে।বাড়িটা হালফিল দোতলা করেছে।ছেলের মা, বৌ আনতে চায়।
রাতুল বাবুর মেয়ে সোমাকে খুব পছন্দ ওদের।বাড়িতে ওই তো মা আর ছেলে।রাতুল বাবু ছেলের বাড়ি গিয়ে সব দেখেশুনে ভায়েদের নিয়ে আলোচনা করে মেয়ের বিয়ের ঠিক করল।
পঞ্চাশ হাজার নগদ, দশ ভরি সোনা,দানসামগ্রী,ছেলের হার,আঙটি এই সব।
ধূমধাম করে মেয়ের বিয়ে হয়ে গেল। মেয়ে অষ্টমঙ্গলায় ঘুরে গেলো।জামাই মিশুকে নয়।ঘর কুনো।কারো সাথে অতিরিক্ত কথা তো নয়,চুপচাপ ছিল।
মেয়ের মুখ শুকিয়ে ছিল স্বামীর ব্যবহারে।ভাইবোন,দাদাদের সাথে ভালো করে কথাই বলেনি।কোথাও বেড়াতে যাওয়া তো দূরের কথা।
বাড়িতে লোকজন চলে যাবার পর ওরা এবার মাত্র তিন জন।
সোমা সকালে উঠে সব কাজ করে স্নান করে চা করতে রান্নাঘরে গেলো। শাশুড়ি কে চা করে দেবে।শাশুড়ি বললো বৌমা,আমরা কেহ চা খাইনা।জল আর একটা করে বাতাসা খাই।কেউ এলে চা করে দেবো না? না বৌমা,জল বাতাসা দেবে।
বাচ্ছারা তো বিস্কুট খায়,তাছাড়া অনেকক্ষন খালি পেটে না থেকে দুটো বিস্কুট খেলেও তো হয় মা।না বৌমা, ওই সব সাহেবিয়ানা আমাদের নেই।
শোনো বলি,সকালে জল বাতাসা,বেলায় মুড়ি আলুর তরকারি নাহলে পান্তাভাত আলুসেদ্ধ। দুপুরে ভাত,ডাল তরকারি,শাক, অম্বল প্রতিদিন। মাছ হবে একদিন রবিবার।মঙ্গল,বৃহস্পতি আর শনি নিরামিষ। দুদিন ডিমের তরকারী আর একদিন পিঁয়াজের তরকারি।রাতেও ভাত তরকারি।লুচি পরোটা উপোস তিরেখে বুঝেছ।ছেলে আমার টিফিন বাইরে করে।দুবেলা ভাত খায়।
প্রতি মঙ্গলবার বাজার করে কারন চালপটি বন্ধ থাকে।সেদিন বাজার দোকান করে রাখে।
তোমার শ্বশুর মরে যাবার পর থেকে আমার ছেলে অনেক কষ্ট করে সব করেছে।বৌমা তুমি তৈরি সংসারে এসেছ।খরচ পাতি বুঝে করতে হবে।
ছেলে মেয়ে হবে প্রচুর খরচ তাদের বড়ো করতে।
এখানে সোমা যেমন কোনো বাড়তি খাবার পায়না তেমন বাড়তি কথাও কেহ বলে না।
ফাঁকা সময়ে চালের কাঁকড় বাছতে হয়,থলে সেলাই করতে হয়।রাতের বেলা শোবার ঘরে পাখা চলবে।অন্য সময় ফাঁকে থাকতে হবে।কারেন্টের টাকা বেশি খরচ হবে। দুবেলার ভাত,কাঠের জ্বালে হবে।একবেলার রান্না গ্যাসে।গ্যাসের যা দাম বাড়ছে।
সেদিন বিকেলে সোমার বাবা এলো,বিস্কুট,চানাচুর,ফল মিষ্টি নিয়ে।বেয়ান বসতে বলে চলে গেল। মেয়ে তো বাবাকে ঘরে নিয়ে যেতে পারছে না।পাখা চালালে যদি কিছু বলে বাবা তো মেয়ের জন্য কষ্ট পাবে।তাই বাইরের দোরে ফাঁকায় বসে কথা বলছিল।সোমার শাশুড়ি মিষ্টি জল দিল।আপনার আনা মিষ্টি আপনি ই খান।আপনি আসবেন জানলে কিছু খাবারের ব্যবস্হা করতুম।রাতুল বাবু হেসে বললো না,আমি এখুনি চলে যাবো আজ জামাইবাবা বাড়িতে আছে বলে চলে এলুম।আমার ছেলে তো ছুটিতে বাড়িতে থাকে না এখানে মঙ্গলবার বিকেলে হাট বসে।ঐ হাট থেকেই প্রতি সপ্তাহে আমাদের দোকান বাজার আসে।
তা ঠিক আছে।
সামনের শুক্রবার আমার ছেলের জন্মদিন আপনারা তিনজন সকালে চলে যাবেন।
সাথে সাথে বেয়ান বললো,কিছু মনে করবেন না বেয়াই মশাই বেশি নেমতন্ন এখানে করতে হবে না।আমরা পছন্দ করি না।জন্মদিন তো লেগেই থাকবে।তাবলে সব সময় আসা -যাওয়া চলবে না।
ঠিক আছে জানা রইলো,এবারে চলে যাবেন।এরপর আর আসবো না।মেয়েটার মন খারাপ করবে না হলে।
আপনার মেয়ে ঠিক কথা,আমাদের বৌ তো?আমাদের নিয়মে ওকে চলতে হবে।ওর সংসার ওকে মন পেতে করতে হবে।খালি এধার -ওধার করলে হবে না।আমি নিজে যদি মন পেতে সংসার না করতুম আপনার মেয়ে দোতলা বাড়ি পেতো না।তাই বলছি আপনার মেয়েকে মন পেতে সংসার করতে দিন আপনার নাতি নাতনি ভালো থাকবে।
রাতুল বাবু মনে মনে ভাবলেন,এত কদিন মেয়েটা ও বাড়ি থেকে এসেছে এখুনি সব ভুলবে কী করে?
দুঃখ চেপে,ঠোঁটে হাসি টেনে বললো যেটা ভালো বুঝবেন করবেন।
মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,আসছি রে মা।বড়োদের কথা শুনবি।
রাতে খাওয়া সেরে ঘরে গিয়ে স্বামী কে তার বাবার আসার কারণ বললে,সে বললো,মায়ের কথা শেষ কথা।আমরা কোনো নেমতন্ন বাড়ি যাই না।কারণ একটা আমাদের অত টাকা নেই উপহার কেনার।
এসব কী বলছো?ঠিক বলছি।সব খেয়েমেখে শেষ করে ফেললে ছেলেমেয়ে মানুষ হবে কী করে?
এই দুমাস বিয়ে হয়েছে,কোথাও তো বেড়াতেও নিয়ে যাওনি।ভায়ের জন্মদিনে নিজেদের বাড়িতেও যাবো না?
নিজেদের বাড়ি তো এটা।ওটা বাপের বাড়ি।বেশি ঘ্যান্ ঘ্যান না করে ঘুমাও।
ডায়েরি লেখার অভ্যাস ছিল সোমার।প্রতিদিনের কথা প্রতিদিন মন খুলে লিখে রাখতো।
কলের জল খরচা করতে দিত না।পুকুরে স্নান করতে হত।সোমার বাবার সব ব্যবস্হা বাড়িতেই।এদের ও সব ব্যবস্হা আছে কিন্তু ব্যবহার করতে দিতো না।
জন্মদিনেরদিন সোমা বাপের বাড়ি গেলো না।ওর মা,রাতুল বাবুকে বললো,মেয়েটাকে বলোনি?
জন্মদিন একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠান এতে আবার বলতে হবে কেন? কী হয়েছে তোমার?মেয়ের বিয়ে হয়েছে বলে ও কী পর হয়ে গেলো?
শোনো,মেয়েটাকে সংসার করতে দাও।
জামাই ষষ্ঠী চলে এলো,সোমার বাবা মেয়ের বাড়ি গেলো নানান জিনিষ নিয়ে।এবার বাতাসা জল দিল শাশুড়ি।বললো,মেয়েকে আপনারা আগেরদিন নিয়ে যাবেন।ছেলে আমার দিনের দিন যাবে। আমাদের একসাথে যেতে নেই।
বেশ তাই হবে।বলে সোমার বাবা চলে গেলো।
বাড়িতে গিয়ে কোনদিন কোন কথা বলতো না। এবার বললো,ষষ্ঠীর আগের দিন মেয়ে আসবে আর পরের জামাই আসবে।
মেয়েকে আমাদের নিয়ে আসতে হবে।যথারীতি সোমা তার পিসতুতো দাদার সাথে বাপের বাড়ি এলো।ওর দাদা বললো,কী কৃপণ তোর শাশুড়ি।একটু জল বাতাসা দিয়ে ছেড়ে দিল।ভাবলুম বোনের বাড়ি কবজি ডুবিয়ে খাবো।সোমা বললো,খাওয়াবো দাদা চিন্তা করিস না।
বাপের বাড়ি এসে সোমা যেন প্রাণ ফিরে পেলো।কিন্তু প্রাণ খুলে কথা বলতে পারলো না।কত আদুরে মেয়ে,যখন যা খুশি খেতো।কত বাইরের খাবার খেতো।হরেক রক বিস্কুট কৌটতে ভরা থাকে ওদের।সোমা বেশি ভাত খেতে পছন্দই করে না।লুচি পরোটা ওর প্রিয়।মাছ ছাড়া ভাত সোমার গলা দিয়ে নামবে না।
শাশুড়ি র একটা কথাও সোমা তার বাপের বাড়ি বলেনি।ভায়ের জন্মদিনের কথা দিব্বি চেপে গেল।
জামাই পরের দিন এলো খালি হাতে।না একটু মিষ্টি না একটা শাড়ি।জামাই এর যত্নে কোন অসুবিধা রাখেনি সোমার বাবা।
রাতে সবাই মিলে সিনেমা যাবে ঠিক করলে সোমার বাবা সিনেমার টিকিট কাটিয়ে দিল।পরের দিন সকালে ব্যাগ ভর্তি করে জিনিস নিয়ে সোমাকে নিয়ে জামাই বাড়ি ফিরলো।
শাশুড়ি বললো,খুব ভালো জিনিস দিয়েছে তোমার বাবা।যতবার আসে কত খাবার নিয়ে আসে আমাদের জন্য।ঐজন্যে বলে মেয়ের বাবা।
আমার নাতি চাই।নাতনি হলে অনেক খরচ।
এভাবেই নানা সমস্যা নিয়েই সোমা সংসার করে।ওরা নেই।দিতে জানেনা।এখন আর বাপের বাড়ির লোকজন আসতে চায়না ওদের বাড়িতে।শ্বশুর বাড়ির সবাই জানে রোগের চিকিৎসা করায়নি শ্বশুর খরচের ভয়ে।শেষে মরেই গেলো।
রোজ এক কথা নাতি চাই আর নাতি চাই।ছেলের এক কথা দুবছর হলো এখনো একটা ছেলে হলো না।
সেদিন সোমা বললো,দুধের খরচ অনেক,বাচ্ছা হলে কী খাওয়াবে?জল বাতাসা আর ভাতের ফ্যান?
সেদিন স্বামী আর শাশুড়ি দুজনেই সোমার গায়ে হাত তুললো।
বিয়ের তিন বছর পর সোমার কোল জুড়ে এলো ছেলে শান্তু।
বাপের বাড়ির সব খরচা।সোমা ছেলে কোলে নানা নিধি জিনিস নিয়ে শ্বশুর ঘরে এলো।
মায়ের দুধ খায়,সাবু খায়,গরুর দুধ অল্প করে নেয়। ছেলে বড়ো হয় তবে ওজন খুব একটা নয়।
সোমার নিউমোনিয়া হলো ঠান্ডায় পুকুরে স্নান করে আর কাজ করে। জ্বর হলে বলে বলে ওষুধ আনে।কিছু খেতে পারে না।শরীর ক্ষীন হয়ে চলেছে। সেদিন ঘুমের মধ্যে সোমা অজ্ঞান হয়ে গেল। সকালে মাথার কাছ থেকে তার স্বামী একটা ডায়েরি পেলো তাতে লেখা একটা বিস্কুটের জন্য।
হসপিটালে ভর্তি করলো।সোমার ছেলে ঠাকুমার কাছে রয়ে গেলো।
150 total views, 6 views today