ধনতেরাস বা ধনত্রয়োদশীর মাহাত্ম্য

প্রফেসর ডক্টর কুশল সেন

অধ্যাপক (ফলিত সংখ্যাতত্ত্ব), Astrological Research Institute of Krishnamurti Paddhati (ARIKP)

সদস্য, মার্গদর্শক মন্ডল, ভারতীয় বৈদিক জ্যোতিষ সংস্থানম্‌, বারানসী

e-mail :  kooshoeg@gmail.com

ভারতীয় সংস্কৃতি ও উৎসবের নিরিখে শাস্ত্রানুসারে, দীপাবলির উৎসব পাঁচ দিনের প্রথম ধনতেরাস বা ধনত্রয়োদশী, দ্বিতীয় নরক চতুর্দ্দশী বা ভূত চতুর্দ্দশী, তৃতীয় দীপাবলী, চতুর্থ অন্নকূট এবং পঞ্চম ভাইফোঁটা। ধনতেরাস প্রকৃতপক্ষে ছিল অবাঙালীদের উৎসব। কালক্রমে এই উৎসবটি বাঙালী জীবনেও ছড়িয়ে পড়েছে। কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশ তিথির দিনটি ধনত্রয়োদশী। পুরাণকথা অনুসারে, সমুদ্র মন্থনের পরে এই পূণ্য দিনটিতেই ধন্বন্তরি অমৃত কলস হাতে নিয়ে উঠেছিলেন জীবের জীবন অমৃতময় করতে।

ধন্মন্তরির আত্মকথা – ভগবান বিষ্ণুর অবতার হিসাবে ধন্বন্তরি অমৃতের কলস হাতে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন প্রথম। তাঁর দেহাকৃতি ছিল অপূর্ব এবং অলৌকিক। সাধারাণ মানুষের তুলনায় তাঁর হাত ছিল অসম্ভব মোটা এবং লম্বা ;  দেহের আকার ছিল শঙ্খের মতো, গাত্রবর্ণ ছিল শ্যামবর্ণ। গলায় মালা, কানে সুসজ্জিত মণিকুন্তল। সমস্ত দেহ ছিল স্বর্ণালঙ্কারে আবৃত। তাঁর এক হাতে অমৃত কলস এবং অন্য হাতে বরাভয়  (অভয়মুদ্রা) । সমুদ্র মন্থনের সময় সমুদ্র থেকে ধন্বন্তরীর উৎপত্তি বলে ভগবান বিষ্ণু তাঁকে অভিহিত করেছিলেন ‘অবু’ নামে। এই ‘অবু’ই ক্রমে বিষ্ণুর কৃপা প্রার্থীর হওয়ার জন্য কঠোর তপস্যা শুরু করেন। ভগবান বিষ্ণু সেই তপস্যায় তুষ্ট হয়ে অবুকে বলেছিলেন – ‘এই জন্মে তুমি ভাগ্যদেবতকে জয় করতে পারবে না। পরজন্মে মাতৃগর্ভে  জন্মগ্রহণ করে অষ্টসিদ্ধ প্রাপ্ত হবে ও আর্য়ুবেদ শাস্ত্র প্রসারিত হবে। এরপর থেকে ধন্বন্তরী দেবতাদের চিকিৎসক হয়ে স্বর্গ  থেকে গেলেন এবং আর্য়ুবেদ শাস্ত্রের জনক হিসাবে খ্যাতিলাভ করেন। সেই থেকে কার্তিক মাসের ত্রয়োদশী তিথিকে ধনতেরাস বা ধনত্রয়োদশী হিসাবে পালন করা হয়।

ধনত্রয়োদশীতে ধন্বন্তরীর আরাধনা – ধন্বন্তরীর মূর্তির  সামনে বা ফটোর সামনে প্রদীপ, লালচন্দন বাটা, যেকোনো সাদা বা লাল ফুল, আতপ চাল এবং খুশিমতো গোটাফল দিয়ে তাঁর পূজার্চনা করা হয়। একটি ছোট জলচৌকির ওপর লাল কাপড় পেতে তার উপরে ধন্বন্তরী দেবের মূর্তি বা ফটো প্রতিস্থাপন করতে হবে, বিগ্রহের মুখ পূর্ব দিকে বা উত্তরদিকে রাখতে হবে। প্রথমে বিগ্রহের কপালে লাল চন্দনের ফোঁটা দিয়ে সামনে জলের গ্লাস রেখে মূর্তি  বা ফটোর হাতে ও পায়ের নীচে লাল মৌলি সূতো রেখে, যেকোনো স্টীলের বা পিতলের থালার উপর গব্যঘৃতের প্রদীপ জ্বালাতে হবে। নিম্নলিখিত মন্ত্রোচ্চারণ করা কর্ত্তব্য – ‘ওঁ ধন্বন্তরী দেবায়ঃ নমঃ’ (১০৮ বার) । এরপর ফুল ও আতপচাল, শ্বেতচন্দন বিগ্রহকে উৎসর্গ করা উচিত।

পঞ্জিকাতে ধনতেরাস – বেণীমাধব শীল বা বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকার কোনোটিতেই ধনতেরাস বা ধনত্রয়োদশী তিথিতে পূজার্চনা পালনের উল্লেখ না থাকলেও ১৪২৮ বঙ্গাব্দের (২০২১ সাল) ১৬ই কার্তিক (২রা নভেম্বর) দিবা ঘঃ- ১১:৩১ মিঃ থেকে কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথি শুরু এবং ১৭ কার্তিক (৩ নভেম্বর) দিবা-৯/২ মিঃ পর্য্যন্ত ত্রয়োদশী তিথি শেষ। এই সময়ের মধ্যেই ধনতেরাস এর পূজার্চ্চনা সম্পন্ন করা উচিত।

অন্যদিকে শাস্ত্রে বা পূরাণে ধনত্রয়োদোশীর উল্লেখ নেই। আবার আধুনিক শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিতেরা বলেছেন, শুধু ত্রয়োদোশী তিথিরই উল্লেখ নয়, শাস্ত্রে এই তিথিতে তৈজসপত্র দানের কথাও রয়েছে। তবে সারা ভারতেই এখন কালীপূজোর দুদিন আগে কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদোশী তিথিতে পালন করা হয় ধনতেরাস। পূজা করা হয় ফটোতে লক্ষ্মীদেবী, শ্রীগণেশ ও কুবের দেবতার। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, সম্পদ বৃদ্ধির চাবিকাঠি হিসাবে এই পূজার্চ্চনা করার রীতি।

টোটকা  – (১) ঘরের সঞ্চিত টাকা পয়সা পুরানো গয়না অথবা নতুন কেনা গয়না, অল্প ফুল, যেকোনো ধাতুর (সোনা/রূপা/কাঁসা/পিতল) জিনিস একটি থালাতে রেখে, তার মধ্যে একটি রূপোর কয়েন (লক্ষ্মী-গণেশ প্রতিকৃতি খোদাই করা) যাকে কুবের দেবতার প্রতীক হিসাবে পূজা (এই রূপার টাকা) করা হয়। পুজোর ফুল এবং এই রূপোর কয়েন সিন্দুক বা আলমারিতে রেখে দিতে হয়।

(২) বাজার থেকে দুটি নারকেল ঝাড়ু কিনে, একটি দিয়ে ঝাঁটা দিতে হবে এবং আরেকটি বাড়ির মধ্যে লুকিয়ে রাখতে হবে। এছাড়াও ঘরের ভিতরে ও দরজার সামনে সাদা (শুক্র), হলুদ (বৃহস্পতি), লাল (মঙ্গল) রঙের আধিক্য থাকা আলপনা দিতে হবে।

কুবের দেবতার মন্ত্র :-

ওঁ যক্ষায় কুবেরায় বিশ্ববরেণ্যায় ধনধান্যাধিপতয়ে

ধনধান্যসমৃদ্ধিং মে দেহি দাপয় স্বাহা।।

Loading