খুব শীঘ্রই শীত আসছে। এ সময় শিশুকে কীভাবে সুস্থ । শীত পড়ার আগে সাধারণ সর্দি-কাশি, অ্যাজমা বা হাঁপানি বাড়ে, ব্রংকাইটিস হয়, ঋতু পরিবর্তনের জন্য কিছু কিছু ভাইরাস জ্বরও হতে পারে। এই সময়কালে টনসিল ফুলে যায়, সাইনোসাইটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। শীতকালে বাতাসে আর্দ্রতা কমে যায়, বাতাসে ধুলাবালি বেশি ওড়ে, তাই সর্দি-কাশি, অ্যাজমা বা হাঁপানি, ব্রংকাইটিস ও ব্রংকিউলাইটিসের প্রকোপ বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ত্বকের বিভিন্ন চর্মরোগ ও অ্যালার্জি হয়।

শীতকাল অর্থাৎ ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। নভেম্বর থেকেই হালকা শীতের আমেজ অনুভব করা যায়। ঋতু পরিবর্তনের সময় রোগব্যাধির প্রকোপ স্বভাবতই অনেকটাই  বেড়ে যায়। ছোট শিশু ও বয়স্ক, যাদের বয়স ৬০-৭০ বছর, তাদের রোগব্যাধিতে বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যায়। শিশু ও বয়স্কদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকার ফলে তারা আক্রান্ত হন বেশি। শীতের শুরুতে এবং শীত চলে যাওয়ার সময়ে তাপমাত্রা পরিবর্তনের জন্য এই উপসর্গগুলি বেশি হয়। প্রায়ই দেখা যায়, দুই-তিন দিন নাক বন্ধ থাকে বা নাক দিয়ে জল ঝরে। তাই এ সময়টাতে ছোট বড়ো সবাইকে একটু সতর্ক থাকতে হবে।

যা করতে হবে।

শীত থেকে বাঁচতে হলে যথাসম্ভব গরম কাপড় পরতে হবে। বিশেষ করে বাচ্চাদের গরম কাপড় দিয়ে মাথা ঢাকতে হবে। কানে শীতের অনুভব বেশি লাগে, তাই কান ঢেকে রাখার চেষ্টা করতে হবে। ধুলাবালি থেকে যতদূর সম্ভব নিজেকে দূরে রাখুন। যাদের সুযোগ আছে তারা উষ্ণ গরম জল দিয়ে স্নান করবেন।  শোয়ার সময় লেপ অথবা কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখতে হবে। অন্যদিকে অতিরিক্ত গরম কাপড়ের জন্য যাতে ঘেমে না যায় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। শিশুরা যেন ধুলাবালিতে খেলতে না যায়, আইসক্রিমসহ অন্যান্য ঠান্ডা পানীয় বা খাবার যেন যেন না খায়। ঈষদুষ্ণ গরম জল খাওয়ান।

ফ্রিজের ঠান্ডা খাবার খাবেন না এবং শিশুদের দেবেন না, তাজা রান্না করা গরম খাবার খাওয়াই ভালো। ধূলিকণা থেকে বাঁচতে হলে মাস্ক পরা আবশ্যক, যতটা সম্ভব কম জনসমাগম ও ভিড়ের জায়গা যেমন শপিংমল, হাটবাজার বা বিয়েবাড়িতে শিশুদের না যাওয়াই ভালো। রাস্তা-ঘাটে জল ছিটাতে হবে যাতে ধুলাবালি ও জীবাণু অনেক কমে যাবে।

নবজাতক শিশুর যত্ন

নবজাতকের তাপ নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কম থাকে, তাই অল্প শীতেই তারা কাবু হয়ে যায়। যে বাচ্চা পূর্ণ ৩৭ সপ্তাহ মাতৃগর্ভে কাটিয়ে জন্ম নিয়েছে তার ক্ষেত্রে জটিলতা কম। সময়ের আগেই জন্ম নেওয়া শিশুদের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন।  মায়ের পেটে শিশু, উষ্ণ তাপমাত্রায় অবস্থান করে। তাই পৃথিবীর তাপমাত্রায় সে শীত অনুভব করে। শিশুর শরীরে তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা পুরোপুরি তৈরি হতেও সময় লাগে। শিশুকে উষ্ণ তাপমাত্রায় রাখতে উচিত। যদি ঘরের তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়, তবে সুতির কাপড় পরিয়ে কাঁথা দিয়ে মুড়ে রাখুন। এই মাত্রার নিচে হলে সোয়েটার ব্যবহার করা উচিত । বাচ্চা মায়ের বুকের দুধ খাওয়ার সময় সাধারণত ঘেমে যায়। তাই ওই সময় আঁটোসাটো ভাবে সোয়েটার পরাবেন না।। শীতে নবজাতক শিশুকে অবশ্যই হাতমোজা, পা’মোজা ও কানটুপি পরাতে হবে।

অবশ্যই মনে রাখবেন 

* বাচ্চাকে ঘন ঘন বুকের দুধ খাওয়াবেন। বুকের দুধে শিশুর রোগ প্রতিরোধ শক্তি বাড়ায়। ফলে শিশু সহজে ঠান্ডা, কাশি ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয় না।

* দিনে ঘরের জানালা খুলে রাখুন, রোদ ও  বাতাস ঘরে ঢুকতে দেওয়া ভালো, ঠান্ডা বাতাস এলেও ক্ষতি নেই। ঘরের মধ্যে ভিজা কাপড় শুকতে দেবেন না।

* শীতকালে বাচ্চাকে দোলনায় বা আলাদা মশারির নিচে না রেখে মায়ের কোলঘেঁষে শোয়াতে হবে। এতে বাচ্চা উষ্ণ থাকবে, মায়ের সঙ্গে আন্তরিকতা বাড়বে ও বুকের দুধ খাওয়াতে সুবিধা হবে।

* যদি পরিবারের কোনো সদস্যের বা কোনো আত্মীয়ের সর্দি, কাশি, ভাইরাল জ্বর ইত্যাদি থাকে, তবে তারা মা ও নবজাতক শিশুর কাছে আসবেন না।

* শিশুকে শীতকালে ঘরের বাইরে বিশেষ বের করবেন না। রোদে দিতে হলে জানালার পাশে বা ঘরের বারান্দা থেকে রোদ লাগান।

* নবজাতক শিশুকে জন্মের সঙ্গে সঙ্গে স্নান করানোর দরকার নেই। জন্মের ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত স্নান করানো উচিত নয়। এর মধ্যে শিশুর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা গড়ে উঠবে।

* বাচ্চার নাভি না শুকানো পর্যন্ত তাকে স্নান না করানোই ভালো। সপ্তাহে দুদিন স্নান করানোই যথেষ্ট। স্নান করানোর আগে ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে দিন । স্নানের জন্য প্রয়োজনীয় ঈষদুষ্ণ জল (৪৫ সে.), নরম কাপড় বা স্পঞ্জ, তোয়ালে, ভ্যাসলিন, ডায়াপার ইত্যাদি সব হাতের কাছে গুছিয়ে নিয়ে স্নান করাতে বসুন।

* নবজাতক শিশুর সামান্য কাশি বা হাঁচি হলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিন। তাই কাশি, শব্দ করে শ্বাস টানা, দুধ টেনে খেতে না পারা, শ্বাস নিতে কষ্ট বা পাঁজর নিঃশ্বাসের সঙ্গে বেঁকে যেতে থাকলে অতি দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

যা করা যাবে না

* শীতকালে নবজাতকের মাথার চুল কাটবেন না। গর্ভকালীন চুল অপবিত্র বলে অনেকে জন্মের পর চুল কামান। এর কোনো প্রয়োজন নেই। চুল মাথার তাপমাত্রা ধরে রাখে, চুল কামিয়ে দিলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারার সম্ভাবনা থাকে। শিশুর নাক বা মুখের ওপর কাপড়, লেপ, কম্বল ইত্যাদি চাপা দেবেন না।

* ঘরে কয়লা ও তুষের আগুন রাখবেন না যেন, এতে শিশুর ক্ষতি হতে পারে

* জন্মের পর ত্বকে এক ধরনের সাদা আবরণ দেখা যায়। অনেকেই এটি নোংরা ভেবে মুছে দেন বা স্নান করিয়ে ধুয়ে দেন। আসলে কিন্তু এ আবরণ নবজাতকের দেহের তাপমাত্রা ধরে রাখে, জীবাণু সংক্রমণ প্রতিরোধ করে এবং ত্বককে সুরক্ষা দেয়। তাই এটি সঙ্গে সঙ্গে মোছা উচিত নয়।

* শিশুর নাভিতে কিছু লাগানো নিষেধ। শীতে অনেকে বাচ্চার নাভিতে তেল মেখে রোদে শুইয়ে রাখেন। এতে নাভিতে সংক্রমণ হতে পারে।

* ডায়াপার ছয় ঘণ্টার বেশি কোনোভাবেই রাখা উচিত না। ডায়াপার থেকে র‌্যাশ হতে পারে, তাই আগে থেকে ভেসলিন বা জিংকসমৃদ্ধ ক্রিম লাগাতে হবে।

দেড় মাস থেকে এক বছর বয়সি শিশুর যত্ন

* শিশুকে প্রয়োজন অনুযায়ী উষ্ণ রাখুন। ঠান্ডা পরিবেশে রাখবেন না। স্যাঁতসেঁতে ঘরেও শিশুকে রাখা ঠিক নয়। শিশুকে মায়ের বুকের দুধ নিয়মিত খাওয়ান। ছয় মাসের বেশি হলে শিশুকে বুকের দুধের পাশাপাশি অন্য খাবার দিন। খিচুড়ির সঙ্গে ডিমের সাদা অংশ, লাল শাক, পালং শাক অল্প করে দিতে পারেন। কমলালেবুর রস খাওয়াবেন। এতে শিশুর রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বাড়বে।

* যেসব শিশু হামাগুড়ি দেয়, তারা যেন ঠান্ডা মেঝেতে হামাগুড়ি না দেয়। কার্পেট ব্যবহার না করাই ভালো। কারণ কার্পেটে ধুলো জমে থাকে এই  ধুলো থেকে অ্যালার্জি হয়। তাই মাদুর বা ম্যাট ব্যবহার করা ভালো।

এক থেকে ছয় বছর বয়সের শিশুর যত্ন

এ বয়সে শিশুরা খেলাধুলা ও দৌড়ঝাঁপ করে থাকে, তাই খুব বেশি গরম ও ভারী কাপড় পরার প্রয়োজন হয় না। সকালে স্কুলে যাওয়া ও বিকালে খেলতে যাওয়ার সময় পর্যন্ত উষ্ণতা নিশ্চিত করতে হবে। শিশুরা স্কুলে পরস্পরের মাধ্যমে সর্দি-কাশি, সহ  শীতকালের কিছু ছোঁয়াচে চর্মরোগে আক্রান্ত হয়। এ ব্যাপারে শিশুকে স্বাস্থ্যবিধি শেখাতে হবে। নিয়মিত লোশন লাগাতে হবে যেন ত্বক শুষ্ক হয়ে না যায়। শীতকালীন শাকসবজি ও ফল বেশি করে খেতে দিতে হবে।

Loading