মূর্তি পূজোর প্রয়োজন কেন?
বিশ্ববাংলা সেরা সম্মান ২০১৮, মাদার টেরেজা স্মারক সম্মান ২০১৮,
বঙ্গরত্ন গৌরব সম্মান ২০১৮ দ্বারা অলংকৃত
আচার্য্য শিবু শাস্ত্রী
আচার্য্য, শাস্ত্রী, প্রাক শাস্ত্রী, রাষ্ট্রীয় সংস্কৃত সংস্থানম
(ভারত সরকারের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক দ্বারা পরিচালিত)
জ্যোতিষ ভারতী, জ্যোতিষ শাস্ত্রী, জ্যোতিষ আচার্য, তান্ত্রিকাচার্য্য,
জ্যোতিষ এশিয়াশ্রী উপাধি প্রাপ্ত (স্বর্ণপদক প্রাপ্ত)
যোগাযোগ – ৯৮৩০২৯২১৭৪
Email : acharyashibusastri@gmail.com
আমাদের শাস্ত্রে জগতের কারণ রূপে শূন্য। তাকে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যেমন হিন্দুদের পঞ্চভূত হচ্ছে – (১) মাটি বা পৃথিবী (ক্ষিতি) (২) জল (বরুন) (৩) বায়ু (মরুৎ) (৪) আগুন (তেজ) (৫) আকাশ (ব্যোম)। আবার বৌদ্ধ শাস্ত্র হতে পাই পঞ্চ স্কন্ধের নাম যেমন, রূপ, বেদনা, সজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান। এ আদি অনন্তকাল হতে বিদ্যমান। এবং স্বভাব এদের শূন্যাত্মক। কর্মবশে এই পঞ্চভূত বা পঞ্চ স্কন্ধকে একত্র করলে তখনই দৃশ্যমান জীবে পরিণত হয়।
নানা শাস্ত্রে পন্ডিতগণ বলে আসছেন সৃষ্টির আদি ও অকৃত্রিম উৎপত্তিস্থল একমাত্র শূন্য। এই শূন্যের অর্থ সৎ বিজ্ঞান ও মহাসুখ। যা সাধকগণ বলে এসেছেন চিৎ সদৃশ ও আনন্দ স্বরূপ। এই সুখের আশায় সাধকগণ সাধনা করেন। ঈশ্বর রয়েছেন মহাশূন্যে যা হৃদয়ে অবস্থান। আমরা সংসারী, সংসারের সব কর্তব্য পালনের মধ্যে দিয়ে ঈশ্বরকে ডাকতে হয়। কিন্তু সংসারীগণ ঈশ্বরকে মানতে চায় না। তাই লাগে একটি মাধ্যম। যেমন মানুষ নিজের মুখমন্ডল নিজে দেখতে পারে না। যদি দেখতে হয় তবে লাগে পুকুরের স্বচ্ছ জল আর আয়না, তাতে প্রতিবিম্ব দেখা যায়। আর ঈশর রয়েছেন অন্তরে, তাঁর রূপ ওই শূন্যকে অতি সহজে মন বসাতে চাইবে কেন। তাই তাঁর প্রতিবিম্ব স্বরূপ সাধক বা সাধারণ গৃহী সাধকগণ তাদের ইচ্ছা মতন সাধনার অনুভূতি স্বরূপ তাঁর মূর্তি স্থাপন করেছেন। সেই জন্য তন্ত্র সাধনায় বলা হয়েছে সাকার হতে নিরাকারে সাধনা। আমি এই সমগ্র ভারতের নানা তীর্থ স্থানে, শক্ পীঠে, এবং সাধন পীঠে গিয়ে দেখেছি কোনো শিলা খন্ডের মধ্যে ঈশ্বরের অবস্থান। আমার মনে হয়েছে তখনকার সিদ্ধ সাধকগণ ওই শিলার মধ্যে প্রকৃত শূন্যকে খুঁজে পেয়ে আনন্দ লাভ করেছেন। অবুঝ মন মানবে কেন। সাধারণ মানুষের মনের চাহিদা অনেক বেশি। তাই মূর্তি পূজোর প্রচলন হয়েছে। পন্ডিতগণের মতে মূর্তি হচ্ছে একটি প্রতীক বা নিদর্শণ। ধর্ম, সভ্যতা এবং দর্শনের উপর নির্ভর করে।
মূর্তির নানা রূপ সৃষ্টি হয়েছে। আজ আমরা দেখতে পাই এই বাংলায় দেব-দেবীর মূর্তিগুলি পাথরের, ধাতুর আর মাটির তৈরী, তা এক এক স্থানের সংস্কৃতি, ভাস্কর্য ও মানব মনের চাহিদা মত এক এক স্থানের দেব-দেবীর মূর্তিগুলির ছাঁচ ও শিল্পকলায় আলাদা হয়েছে। মানুষ সর্বদা সুন্দরের পূজারী। তাই শিল্পীকে দিয়ে সর্বদাই সুন্দর সুন্দর মূর্তি তৈরী করিয়ে স্থাপন করেছেন। মানুষের মন সর্বদাই সুন্দরের প্রতী আকৃষ্ট হয়। সেই জন্য নানা স্থানে মানুষের মনকে ঈশ্বরের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য সুন্দর সুন্দর মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রাকে সুষ্ঠ ধারায় বয়ে নিয়ে যেতে নানা আচার অনুষ্ঠানের সৃষ্টি হয়েছে। পরিবেশ ও মানব জীবনের বা শারীরিক উ্ন্নতির জন্য দেবতার ভোগ প্রসাদ ও নৈবেদ্য যেমন নানা ফল,মূল, নানা রন্ধন ব্যঞ্জন ব্যবহার হয়েছে। যেমন উত্তর ভারতে লুচি, হালুয়া, মূড়ি ও শুকনো নৈবেদ্য। আবার আমাদের বঙ্গদেশে আম, জাম, কলা, কাঁঠাল, খিচুড়ি, ভাত, ডাল, মাছ, মাংস ও নানা পিঠা, মিষ্টির নৈবেদ্য ইত্যাদি দিয়ে দেবতার ভোগের ব্যবস্থা আছে।
তন্ত্র শাস্ত্রের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দেহকে রক্ষা করা, পরিবেশ ও পরিবারকে রক্ষা করা, তাই দেহ উন্নতি বা ঠিক রাখতে, সমাজকে সুস্থ্য বা শুদ্ধ রাখতে যা প্রয়োজন তাই তন্ত্র পূজার উপকরণ, দেহের মধ্যেই বিরাজন করছেন ঈশ্বর কুন্ডলিনী শক্তির দ্বারায় তাঁকে জাগ্রত করতে হবে। তাতে মানব হয় উন্নত, শান্ত এবং পরিমাির্জত। যখন মানুষ নিরাকার (শূন্য) অনুভব করতে পারবে তখন মানব খন্ড খন্ড হবে মানব মনের কাম, লালসা, ক্রোধ, হিংসার, জয় হবে ভালোবাসার। আমার মনে হয় শিশু জন্মের পর পিতা-মাতাকে দেখে তাদের ভালোবাসে, তারপর পরিবারের লোকজনদের দেখে তাদের ভালোবাসতে শেখে। প্রথমে আকার দেখে ভালোবাসতে শেখে। সেই রকম নিরাকারে আসতে গেলে আকার সাধনার মধ্য দিয়ে আসতে হবে এটাই আমাদের সনাতন ধর্ম-এর নীতি। সেই জন্য নানা আচার রীতি-নীতি নিয়ম মেনে মূর্তি পূজার প্রয়োজন। সৃষ্টির মধ্যেই বেঁচে থাকেন স্র্ষ্টা। আজ নানা মন্দিরে বিভিন্ন ভাস্করের সৃষ্টি বেঁচে আছে মূর্তির মধ্যে। যেমন দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে মা ভবতারিনীর সঙ্গে জুড়ে রয়েছেন নবীন ভাস্করের নাম। তবে প্রথম মূর্তি যখন হয়েছিল তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত আছে। কেউ বলেন মথুরা ভাস্কর প্রথম মূর্তি তৈরী করেছিলেন। আবার কেউ বলেন বাংলা বা বিহারের ভাস্করগণ প্রথম মূর্তি তৈরী করেছিলেন। তা মুসলমান আক্রমণে অনেকাংশে ধ্বংস হয়েছে। হিন্দুদের দেবদেবীর যেমন মূির্ত পূজার প্রচলন রয়েছে ঠিক তেমন বৌদ্ধদের মধ্যে বজ্রযানে বিভিন্ন মূর্তি পূজা দেখা যায়। পন্ডিতগণের মতে এই বাংলায় মূর্তি পূজার প্রচলন হয়েছিল দূর্গা পূজার শুরু হতে। যতক্ষণ মানবমনে পরমাত্মা আর জীবাত্মাকে এক ভাবা যাবে না ততক্ষণ মানুষ এই দুইকে দুই মূর্তি দেখে থাকে। এটি একটি বৌদ্ধ গ্রন্থ হতে পাই যে অন্তরের ভাবনা শূন্য মূর্তি, অপর ভাবনাটি চিত্ত মূর্তি। তাই মূর্তি পূজার মাধ্যমে চিত্ত মূর্তির ভাবনাকে জয় করতে হয়। তারপর মিলেমিশে একক ভাবনার সৃষ্টি হয়। যেমন লবন, চিনি আর জল প্রথমে রূপে, স্বাদে আলাদা থাকে, যখন দুটি মিশে যায় তখন সরবত তৈরী হয়, তার বর্ণ-এর কিছুটা পরিবর্তন হয় স্বাদও হয় অপূর্ব। এবং শরীরে উপকার হয়। ঈশ্বর সাধনাও ঠিক তেমনই প্রথমে আচার, বিচার, নিয়ম নিষ্ঠা আর ভালোবাসার দ্বারাই মূর্তি পূজার মধ্য দিয়ে অন্তরের দেবতার কাছে পৌঁছাতে হয়। সেই জন্য মূর্তি পূজার প্রয়োজন। ‘জয় নীল তারা মায়ের জয়, নীল শিবানন্দ কয়।
‘‘ভোগ সুখ আর ধনের লোভে ছুটছে অবুঝ মন,
প্রকৃত সুখের সন্ধান করে কয় জন
অন্তরে ঈশ্বর জাগাও মূর্তিতে প্রতিবিম্ব দেখ
ভয়, কষ্ট, দুঃখ ভুলে আনন্দেতে মাতো’’