আমাদের দেশ ভারতবর্ষে বিখ্যাত দেবদেবীর মন্দির অগণিত, সব জায়গায় তাঁদের জন্য ভোগের বন্দোবস্ত আছে। মহাতীর্থের চারধামের (রামেশ্বরম, বদ্রীনাথ, পুরী ও দ্বারকা) মধ্যে পুরীর জগন্নাথদেবের ভোগের মূল তফাৎ হলো- সর্বত্র ভোগকে বলা হয় প্রসাদ, কিন্তু একমাত্র পুরীর জগন্নাথদেবের ক্ষেত্রেই তা হয়ে উঠেছে ‘মহাপ্রসাদ’। কারণ এখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নিয়ে কোনো ভেদাভেদ নেই।

এই মহাপ্রসাদের এমনই বিশেষ মহিমা যে, একজন ব্যক্তির ফেলে যাওয়া অবশিষ্টাংশ অন্যজন পরম আনন্দে গ্রহণ করেন। হাজার হাজার ভক্তদের মধ্যে যখন মহাপ্রসাদ বিতরণ করা হয়, তখন সব বিভেদ যেন ছিঁড়ে খান খান হয়ে যায়। সবাই এক পরম আনন্দের অনুভূতি উপলব্ধি করে।

জগন্নাথদেবের ভোগ মহাপ্রসাদ কেন :

পুরীতে পাণ্ডাদের মুখে, ভগবান বিষ্ণুকে নিয়ে এক কাহিনী প্রচলিত আছে। কথিত আছে, ভগবান বিষ্ণু চারটি ধর্মীয় পীঠস্থানকে তাঁর দৈনন্দিন কাজকর্মের জায়গা হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। প্রথম যেখানে তিনি স্নান করেন তা হলো রামেশ্বর। দ্বিতীয় বদ্রীনাথ, যেখানে তিনি ধ্যানে বসেন; তৃতীয় হলো পুরী, যেখানে তাঁর আহারের স্থান এবং চতুর্থ হলো দ্বারকা, যেখানে তিনি বিশ্রাম নেন।

এখান থেকেই বোঝা যায়, ভগবানের কাছে এই জগন্নাথের ভোগ বা মহাপ্রসাদ ঠিক কতটা প্রিয়। মহাপ্রসাদ তৈরির রন্ধনশালা এক বিস্ময়- সাধারণ বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা মেলা দুষ্কর। হাজার কখনো লাখের উপর ভক্তের প্রসাদ তৈরি হয় এমন একটি পদ্ধতিতে, যা নিয়ে গবেষণাও কম হয়নি। পুরো পদ্ধতিই হলো সিদ্ধ করা আর মাধ্যম কিন্তু পুরোপুরি মাটির ভাঁড়, কলসি বা হাঁড়ি। জ্বালানি বলতে এখনও সেই বনের কাঠ; ভাত, ডাল, সব্জি, পায়েস সবই এভাবেই তৈরি হয়।

মহাপ্রসাদ তৈরির পদ্ধতি

দিনের পর দিন, বছরের পর বছর নিম্নলিখিত সাধারণ পদ্ধতি মেনেই পুরীতে জগন্নাথদেবের ভোগ তৈরি হয়ে আসছে। জলে চাল ভিজিয়ে কাঠের চুল্লিতে বসিয়ে অন্নভোগ তৈরি হয়। সবজি কেটে মাটির কলসির মধ্যে থরে থরে সাজিয়ে পরিমাণ মতো জল দিয়ে কাঠের চুল্লিতে বসিয়ে তৈরি হয়। সবজি। মহাপ্রসাদকে এখানে বলা হয় ‘অন্নব্রহ্ম’।

রান্না করার পর প্রথম তা জগন্নাথদেবেকে নিবেদন করা হয় কিন্তু তখনও তা মহাপ্রসাদে রূপান্তরিত হয় না। জগন্নাথদেবকে নিবেদনের পর তা দেবী বিমলাকে নিবেদন করা হলে, তা হয়ে ওঠে মহাপ্রসাদ। মহাপ্রসাদ যখন মন্দির। থেকে বাইরে ভক্তদের মধ্যে বিতরণের জন্য নিয়ে আসা হয়, তখন তার মধ্যে এক অদ্ভূত সুগন্ধ মিশে যায়; তাও এক অদ্ভূত রহস্য। ভক্তদের কাছে এই সুগন্ধ প্রভুর আশীর্বাদ স্বরূপ।

মহাপ্রসাদের প্রকারভেদ :

পুরীর মন্দিরে ভোগ নিবেদনের জন্য রয়েছে ৬টি নির্দিষ্ট সময়। জগন্নাথদেবের প্রাতঃরাশ হল ‘গোপালবল্লভ ভোগ’। তারপর ভোরে ভাত, পিঠা, ডালসহ প্রায় ১৩ রকমের ব্যঞ্জন দিয়ে যে ভোগ দেওয়া হয়, তার নাম ধূপ বা পঞ্চ উপচার। দ্বিপ্রাহরিক নৈবেদ্যই হল সব চাইতে জনপ্রিয়। এছাড়া মধ্যাহ্ন ধূপ, সন্ধ্যা ধূপ এবং সর্বশেষ নৈশভোজে পাস্তা ভাত নিবেদন করা হয়। মোট ছাপ্পান্ন রকমের ভোগ জগন্নাথদেবকে নিবেদন করা হয়।

জগন্নাথদেবের রন্ধনশালা :

জগন্নাথদেবের মন্দিরের চারটি মুখ্যদ্বার, দক্ষিণের দ্বার দিয়ে ঢুকলেই সামনে প্রশস্ত চাতাল। তারই ডানদিকের কোণ থেকেই রন্ধনশালার শুরু। পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো হোটেল বলা যায়- এই জগন্নাথদেবের রন্ধনশালাকে। এক সঙ্গে এক লক্ষ পূণ্যার্থীর রান্না অবলীলাক্রমে হয়ে যায় প্রতিদিন। ভিতরে রাঁধুনি বা পূজারি ছাড়া কারও প্রবেশাধিকার নেই।

দেওয়ালের দৈর্ঘ্য জুড়ে কিছুটা তফাৎ রেখে, কেটে কেটে তৈরি করা হয়েছে ঘুলঘুলি। এগুলি আসলে বাইরে থেকে উনুন ধরানোর কাঠ ভিতরে পাঠানোর জন্য তৈরি। কয়েকটি ঘুলঘুলিতে চোঙার মতো বস্তু লাগানো থাকে, যা ভিতরে জল পাঠানোর মাধ্যম। কিন্তু রান্নার জন্য প্রয়োজনীয় জল আসে রন্ধনশালার সংলগ্ন একটি প্রায় ১০০ ফুট গভীর কুয়ো থেকে। তার বাদিকে আরও একটি কুয়ো আছে। এই দুটি কুয়োর নাম গঙ্গা ও যমুনা। তাদের জল এতই সুস্বাদু যে খেলেই সব হজম হয়ে যায়। সারাদিন ধরে এই দুটি কুয়ো থেকে কেবলমাত্র জল তোলার কাজেই নিযুক্ত রয়েছেন অন্তত চল্লিশজন লোক।

রন্ধনশালার রাঁধুনি উপকরণসমূহ :

রন্ধনশালায় কমপক্ষে ৬০০ জন রাঁধুনি এবং তাঁদের হাতে জিনিসপত্র জুগিয়ে দেওয়ার জন্য রয়েছেন চারশো লোক। মোট এক হাজার খানেক লোক যারা বিশেষভাবে রান্নার কাজে যুক্ত তাদের প্রত্যেকের মুখে কাপড় বাঁধা থাকে। তারা যখন ভিতরে যাবেন, পথে কারও তাঁদের শরীর স্পর্শ করার অনুমতি নেই। রান্নাঘর থেকে ভোগ মন্দিরে নিয়ে যাওয়ার সময় যে ঘেরা রাস্তা রয়েছে সেখানে ভোগ যাওয়ার সময় গেট বাইরে থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

রন্ধনশালার চুল্লি

রন্ধনশালায় তিনধরনের চুল্লি আছে, একটি ভাত, একটি সবজি এবং অন্যটি পিঠে তৈরির জন্য। এক একটি ৪ ফুট × ২২ ফুট, গভীরতা ২ ফুটের। মোট চুল্লির সংখ্যা কমপক্ষে ২৫০টি। এক একটি চুল্লিতে ৯টি হাঁড়ি বসিয়ে খুব সহজেই রান্না হয়ে যায়। এই চুল্লিতেই হাঁড়ির উপর হাঁড়ি বসিয়ে কেবল আগুনের তাপেই সিদ্ধ করে ভাত, ডাল, সবজি ইত্যাদি রান্না হয় প্রতিদিন। কিন্তু রান্নায় তেলের কোন ব্যবহার নেই। সবজি ভর্তি কলসির মুখে ঠেসে ঠেসে নারকেল কুরো ভরে দেওয়া হয় কারণ, তাপে সিদ্ধ হওয়ার সময়, তেল বেরিয়ে খাবারে মিশে যায়।

জগন্নাথদেবের অতি প্রিয় জিনিস হল নারকেল, প্রতিদিন শুধু নারকেল আসে একটি ছোটো ট্রাক ভর্তি করে। প্রতিদিন কয়েক হাজার টাকার হাঁড়ি কলসি লাগে রান্নার কাজে। রান্নাতে আলু ব্যবহার করা হয় না কারণ তা জগন্নাথদেবের পচ্ছন্দ নয়।

রন্ধন কার্যে মহাপ্রসাদ নির্মাণে, সারাদিনে প্রায় ৩০ থেকে ৭০ কুইন্টাল চাল লাগে, যা আবার উৎসবের মরশুমে অন্ততপক্ষে ১০০ কুইন্টালে পৌঁছে যায়। জগন্নাথদেবের ভোগ বিক্রির জন্য, যে জায়গাটি আছে তার নাম ‘আনন্দবাজার’, যা মন্দিরের উত্তর-পূর্ব দিকে (ঈশান কোণে) অবস্থিত।

অতি সাধারণ পদ্ধতিতে অসাধারণ ভোগ ‘মহাপ্রসাদ’ নির্মাণের এই রন্ধনকার্য আজকের আধুনিক বিজ্ঞানের জগতে এক বড়ো বিস্ময়। মহাপ্রভুর রন্ধনশালা ও মহাপ্রসাদ ঈশ্বরের কৃপাধন্য একথা অনস্বীকার্য। জগন্নাথদেবের রন্ধনশালার সুবিশাল কর্মযজ্ঞে কোথাও যেন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় গীতার শ্লোকটি

‘অহং সর্বস্য প্রভবো মত্তঃ সর্বং প্রবর্ততে’।

–শ্লোক ৮, অধ্যায় ১০, শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা অর্থাৎ আমিই সমস্ত জগতের উৎপত্তির কারণ, আর আমার থেকেই সমস্ত জগৎ প্রবর্তিত হয়।

Loading