নিজস্ব প্রতিনিধি- রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যম পিটিআই (প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া) পরিবেশিত আলোকচিত্রে দেখা যাচ্ছে, একজন স্বাস্থ্যকর্মী দিল্লি ডিস্ট্রিক্ট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন (ডিডিসিএ) সদস্যদের কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে জরুরি ভিত্তিতে নিয়ে যাচ্ছেন। কারণ দিল্লির করোনাভাইরাসের কমিউনিটি সংক্রমণের পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, যা জ্বর, শুকনো কাশি ও নানাবিধ উপসর্গগত লক্ষণ সমেত দ্রুত ছড়াচ্ছে এবং প্রধানত ৩০ থেকে ৫০ বছর বয়সীদের ব্যাপকহারে আক্রান্ত করছে। বিশেষজ্ঞরা দিল্লির নাজুক ও অবনতিশীল পরিস্থিতিকে ‘ফোর্থ ওয়েভ অব করোনা পেন্ডামিক’ নামে অভিহিত করছেন।

দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল নাগরিকদের সতর্ক করে বলেছেন, ‘বর্তমানে চলমান করোনা প্রকোপ অতীতের চেয়ে বহুগুণে শক্তিশালী এবং অল্প ও মাঝ-বয়সীরা অকাতরে আক্রান্ত হচ্ছেন।’ দিল্লির প্রধান হাসপাতালগুলোতে রোগির সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। আক্রান্ত মানুষের তুলনায় চিকিৎসা সুবিধার অপ্রতুলতায় সঙ্কট বৃদ্ধি পাচ্ছে। তদুপরি, এইমস, সফদর জং, গঙ্গুরাম হাসপাতালের মতো প্রধান চিকিৎসা কেন্দ্রগুলো পরিস্থিতি সামাল দিতে নাস্তানাবুদ হচ্ছে। এদিকে বহু চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় পুরো অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে।

শুধু রাজধানী দিল্লিই নয়, সামগ্রিক ভাবে পুরো ভারতের করোনা পরিস্থিতিই ‘চরম মারাত্মক’ আকার ধারণ করেছে।  করোনা সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, যিনি দীর্ঘদিন পশ্চিমবঙ্গের চলমান নির্বাচনের প্রচারণায় বিজেপির তরফে ব্যাপকভাবে জনসংযোগের কাজ করছিলেন।।

ভারতে সংক্রমণ যেমন বাড়ছে, তেমনই সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর, করোনার নতুন একটি প্রজাতি (ডাবল মিউট্যান্ট স্ট্রেন) সংক্রমিত হয়েছে ১০টি রাজ্যে। যার মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গও। এ ছাড়া তালিকায় রয়েছে মহারাষ্ট্র, দিল্লি, গুজরাত, কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলো। যদিও, করোনার নতুন ঢেউয়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পিছনে শুধুমাত্র এই প্রজাতি কাজ করেছ, এমনটা বলা সম্ভব নয়। এই প্রজাতির ভাইরাসে রয়েছে দুটি প্রজাতির করোনা ভাইরাসের মিশ্রণ। একদিকে ই৪৮৪কিউ ও এল৪২৪আর ভাইরাস এর মিশ্রণে তৈরি হয়েছে এই তৃতীয় প্রজাতিটি। দিল্লিতে ব্রিটেনের করোনা প্রজাতি ও এই জাতীয় করোনা প্রজাতি যৌথ ভাবে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। পাঞ্জাবে করোনার নতুন ঢেউয়ে যারা আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের ৮০ শতাংশের শরীরে পাওয়া গিয়েছে ব্রিটেনের করোনা স্ট্রেন। কিন্তু মহারাষ্ট্রে বিপুল পরিমাণে নতুন প্রজাতির করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। হিসাব অনুসারে, ৬০ শতাংশ আক্রান্তই দুই ভাইরাসের প্রজাতি থেকে তৈরি তৃতীয় ভাইরাসের দ্বারা সংক্রমিত হয়েছেন।এদিকে, আরেক খবরে জানা গেছে,ভারতের ১৮টি রাজ্যের ৭০ থেকে ৮০ জেলায় ব্রিটেনের করোনা প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। সেই তুলনায় দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের প্রজাতি অপেক্ষাকৃত কম দেখা যাচ্ছে।

শুধু হাসপাতাল নয়, দেশজুড়ে করোনার প্রবল ঢেউয়ের জন্য জায়গা কমছে অন্ত্যেষ্টিস্থলেও। এই পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাস সংক্রমণে মৃতদের সৎকারের জন্য ধর্মীয় আচারের গণ্ডি পেরনোর জন্য খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর কাছে আবেদন জানিয়েছিল গুজরাতের আহমাদাবাদ প্রশাসন। শহরের ক্যাথলিক বিশপ তা সমর্থন করেছেন। কবর দেওয়ার পরিবর্তে করোনায় মৃতদের দেহ দাহ করার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি নিজেই।

আহমাদাবাদের ক্যাথলিক বিশপ অ্যাথানাসিয়াস রেথনা স্বামী চলতি সপ্তাহে নগর প্রশাসনকে জানিয়েছেন, করোনায় মৃতদের দেহ দাহ করা হলে তার আপত্তি নেই। কোভিড পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে নতুন ব্যবস্থা মেনে নেওয়ার জন্য শহরের ক্যাথলিক সমাজের কাছে বার্তাও দিয়েছেন তিনি। লিখিত আবেদন পাঠিয়েছেন, শহরের বিভিন্ন ক্যাথলিক চার্চের পরিচালক মণ্ডলীর কাছেও। গত ১২ এপ্রিল পাঠানো চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পূর্ণ সম্মানের সঙ্গে মৃতদের সৎকার আমাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ’!  করোনা সংক্রমণের প্রলয়ঙ্করী ঢেউয়ের অভিঘাতে দেশের অনেক শহরের মতোই আহমাদাবাদেও দৈনিক মৃত্যু দ্রুতগতিতে বাড়ছে। ফলে শ্মশান, কবরস্থানে দীর্ঘ লাইন পড়ছে। তাই সুষ্ঠভাবে সৎকার সম্পন্ন করা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। পাশাপাশি, অভিযোগ উঠেছে শহরের মর্গগুলেতে মৃতদেহ সংরক্ষণ নিয়েও সমস্যা দেখা দিয়েছে। আহমাদাবাদ শহরের পার্সি সমাজও করোনা পরিস্থিতিতে দাহ করার বিষয়টি বিবেচনা করছে বলে জানা গিয়েছে। প্রসঙ্গত, পার্সিদের ধর্মীয় পরম্পরা অনুযায়ী, মৃতদের দেহ শকুন ও চিলের খাদ্য হিসেবে শহরের পাশে কোনও উঁচু জায়গায় পাঁচিল ঘেরা মিনারের উপর রেখে আসা হয়, যাকে ‘টাওয়ার অব সাইলেন্স’ বলা হয়। এদিকে চলমান কুম্ভমেলায় লক্ষ লক্ষ হিন্দু সাধু-সন্ন্যাসী ও সাধারণ নাগরিকের অংশগ্রহণের ফলে করোনা সংক্রমণের গতি প্রবলতর হয়েছে। উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, মধ্য প্রদেশের বিভিন্ন শহরে করোনায় ক্রমবর্ধিষ্ণু মৃত্যুর ঘটনায় অব্যাহত রয়েছে প্রজ্বলিত চিতা, যেখানে একের পর এক মৃতদেহ আসছে এবং সেগুলোকে দাহ করতে হচ্ছে। একাধিক মিডিয়া করোনা বিস্তারের পটভূমিতে ভারতে মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছে। বলা হচ্ছে, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগাভাগির সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও রাজনৈতিক হিংসার কারণে যে লোকক্ষয়, আতঙ্ক ও বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, সামনে তেমনি মানবিক বিপর্যয় আসতে পারে করোনাজনিত মহামারির ক্ষয়ক্ষতির কারণে।

Loading