অবিচ্ছেদ্য বৈবাহিক সুখী দাম্পত্য –

বশিষ্ঠ্য ও অরুন্ধতী

প্রফেসর ডক্টর কুশল সেন

অধ্যাপক (ফলিত সংখ্যাতত্ত্ব), Astrological Research Institute of Krishnamurti Paddhati (ARIKP)

সদস্য, মার্গদর্শক মন্ডল, ভারতীয় বৈদিক জ্যোতিষ সংস্থানম্‌, বারানসী

e-mail :  kooshoeg@gmail.com

সংস্কৃত ভাষায় ‘নীহারিকা’ শব্দের অর্থ ‘নক্ষত্র সংসার’ (Galaxy of Stars), নক্ষত্র শব্দটিকে পরিবর্ধিত করে অর্থব বেদে উল্লেখ করা হয়েছে – ‘ন ক্ষরতি’ অর্থাৎ যার কোনো ক্ষয় নেই। তাই নক্ষত্রকে বেদের পরিভাষায় স্থায়িত্বের পরিচায়ক হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। মানবজীবনের বৈদিক পরম্পরার সাথে যুক্ত ষোড়শ সংস্কার বিধিতে নক্ষত্রের একটি প্রামাণিক ভূমিকা আছে। তৈতিরীয় ব্রাহ্মণের প্রথম অধ্যায়ে, নক্ষত্রের প্রতি অর্চনাকে স্বর্গপ্রাপ্তির থেকেও মহত্বপূর্ণ বলা হয়েছে।

বৈদিক পরম্পরার সাথে যুক্ত ষোড়শ সংস্কার বিধির অন্যতম হল ‘বিবাহ’ । হিন্দু শাস্ত্র মতে বিবাহের সময় পাত্র-পাত্রী অগ্নিকে সাক্ষ রেখে, তার চারপাশে ধীর পদক্ষেপে চারবার প্রদক্ষিণ করে, যাকে সাতফেরা বলা হয়। এই বিশেষ মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে পাত্র-পাত্রী উভয়েই, উভয়ের পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের উপস্থিতিতে, মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে শপথ গ্রহণ করে যে, ‘তারা জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য ধর্মীয় বন্ধনে আবদ্ধ হল।’ এই সাতফেরা-এর মাধ্যমে বৈবাহিক জীবনের ধর্মীয় ও সামাজিক বন্ধন অটুট রাখার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। এই বৈদিক পরম্পরা সনাতন হিন্দু শাস্ত্র মতে প্রায় ৮০০০ বছরের পুরনো প্রথা।

এই অতি প্রাচীন প্রথা অনুসারে তার আনুসঙ্গিক আরেকটি প্রথা প্রচলিত ছিল যা এখন বিস্মৃতপ্রায়। এই বিস্মৃতপ্রায় প্রথা অনুযায়ী বিবাহিত বর-বধূকে রাত্রির আকাশে বশিষ্ঠ ও অরুন্ধতী নক্ষত্র দর্শন করানো হত বিবাহের পরে বৈবাহিক দাম্পত্য জীবনে শুভত্বের মাপকাঠি নির্ধারণ করে। বশিষ্ঠ ও অরুন্ধতী নক্ষত্রদ্বয়কে আরবী ভাষায় মিজার (Mizar) ও আলকর (Alcor) নামেও অভিহিত করা হয়। এই নক্ষত্রদ্বয় আবার প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রে সপ্তঋষিদের অন্যতম ছিলেন। পাশ্চাত্য দেশে এই নক্ষত্রদ্বয়কে আবার Big Dipper অথবা Ursa Major  নামে পরিগণিত করা হয়।

শাস্ত্রজ্ঞ ও পন্ডিত ঋষি বশিষ্ঠ তাঁর পত্নীর অরুন্ধতীর সাথে কুটীরে নিষ্ঠা ও সততার সাথে তাদের বৈবাহিক দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করেছিলেন যার লোকগাথা আজকের আধুনিক জনমানসেও বহুল প্রচারিত। মহাকাশের লক্ষাধিক দ্বৈত নক্ষত্রের মধ্যে প্রাচীন বৈদিক শাস্ত্রকারেরা কেবলমাত্র বশিষ্ট ও অরুন্ধতী নক্ষত্রদ্বয়কেই উপরোক্ত এই প্রাচীন পরম্পরার সাথে যুক্ত করার জন্য নির্বাচিত করেছিলেন। এর পিছনে রয়েছে পদার্থবিদ্যার মাধ্যাকর্ষণ শক্তির গূঢ় তত্ত্ব।

মহাকাশ তত্ত্বের নাক্ষত্রিক গবেষণায় আপাতদৃষ্টিতে বহুলাংশেই দেখা যায় যেকোনো দ্বৈত নক্ষত্রের ক্ষেত্রে তুলনায় আকৃতিতে বড় নক্ষত্রটি অপেক্ষাকৃত ছোট নক্ষত্রটিকে তার মাধ্যাকর্ষণ শক্তির দ্বারা নিজের দিকে আকৃষ্ট করে ফলতঃ ছোট নক্ষত্রটি তার নিজস্ব কক্ষপথে বড় নক্ষত্রটিকে কেন্দ্র করে তার চারপাশে পরিবৃত্ত করে। কিন্তু বশিষ্ট ও অরুন্ধতী নক্ষত্রের ক্ষেত্রে তা হয় না, বরঞ্চ এরা দুজনেই নিজস্ব কক্ষপথে দু’জনকে পরিভ্রমণ করে। তাই প্রচীন আর্যঋষিরা আদর্শ বৈবাহিক, সুখী দাম্পত্য জীবনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসাবে বশিষ্ট ও অরুন্ধতী নক্ষত্রদ্বয়কে বেছে নিয়েছিলেন। ষোড়শ সংস্কার বিধির অন্যতম বিবাহের ক্ষেত্রে তাই সনাতন হিন্দু শাস্ত্রে বিবাহের সাতফেরা সম্পন্ন হওয়ার পরে নব-বধূকে বশিষ্ট ও অরুন্ধতী নক্ষত্রদ্বয়কে চয়ন করেছিলেন। যাতে নবদম্পতি বুঝতে সমর্থ হন যে, তাদের বৈবাহিক দাম্পত্য জীবনে পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত।

এই অটুট বৈবাহিক সুখী দাম্পত্যের পরিপ্রেক্ষিতে ; বিবাহের সপ্তপদী বা সাতফেরার সপ্তম ফেরা বা সপ্তম পদক্ষেপে তাই বরবধূ একসঙ্গে উচ্চারণ করেন –

‘ওঁম্‌  সখী সপ্তপদী ভব’।

অর্থাৎ I promise you true friendship in all my life, অর্থাৎ আমি তোমার সাথে সারা জীবন বন্ধুত্বের অটুট বন্ধনে অঙ্গীকারবদ্ধ।

Loading