১০৮ এর সার্বিক তাৎপর্য

প্রফেসর ডক্টর কুশল সেন

অধ্যাপক (ফলিত সংখ্যাতত্ত্ব), Astrological Research Institute of Krishnamurti Paddhati (ARIKP)

সদস্য, মার্গদর্শক মন্ডল, ভারতীয় বৈদিক জ্যোতিষ সংস্থানম্‌, বারানসী

e-mail :  kooshoeg@gmail.com

সংখ্যা হল সম্পূর্ণরূপে গণিতে সীমাবদ্ধ একটি স্পন্দনভিত্তিক বিষয় যার উপরেই গোটা ফলিত জ্যোতিষশাস্ত্র (Applied Astrology) ফলপ্রসু। ভারতীয় বৈদিক জ্যোতিষও সম্পূর্ণভাবে সংখ্যার উপরেই নির্ভরশীল। মহির্ষ পরাশর তাঁর রচিত কালজয়ী জ্যোতিষগ্রন্থ ‘পরাশরী হোরা’তে বলেছিলেন ; ‘বিশ্বব্রহ্মন্ডের’ যাবতীয় সৃষ্টি একটি গণিতের সুদৃঢ় ছন্দে বাঁধা।

সংখ্যা ও সংখ্যাতত্ত্ব আসলে কি?

বৈশেষিক দর্শন অনুসারে,পদার্থবাচক চব্বিশটি গুণের মধ্যে অন্যতম একটি সংখ্যা। ‘সংখ্যা’র সজ্ঞা নিরুপনে বলা হয়েছে – বস্তু বিশেষের মধ্যে যে গুণের অস্তিত্বের জন্য আমরা ১, ২ ….. ৮,৯ প্রভৃতি রূপের গণনা করি তাই হল ‘সংখ্যা’র সজ্ঞা নিরুপণে বলা হয়েছে – বস্তুবিশেষের মধ্যে যে গুণের অস্তিত্বের জন্য আমরা ১, ২ … ৮,৯ প্রভৃতিরূপে গণনা করি তাই হল ‘সংখ্যা’। কিন্তু সংখ্যাশাস্ত্র অনুসারে, সংখ্যা শব্দের একটি গূঢ় অর্থ হল ‘আত্মতত্ত্বকথন’, তাই সংখ্যাতত্ত্ব হল ‘আত্মতত্ত্ব’ (Self Theory)।   গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে, সংখ্যাই সমস্ত পার্থিব সত্তার মৌলিক সত্য এবং সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অখন্ড সংজ্ঞানিরূপণের ক্ষেত্রে একটি ছন্দময় পদ্ধতি।

কিন্তু সংখ্যাতত্ব বা নিউমারোলজি অলৌকিক বিজ্ঞানের একটি সাংকেতিক ভাষা বা আমাদের বৈজ্ঞানিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের পরিধিকে বিস্তৃত করে। সভ্যতায় ভাষার প্রচলনের সাথে সাথে, সম্পের্ক জটিলতা, নতুন সম্ভাবনা এবং সৃষ্টিশিলতা বয়ে আনে। সংখ্যার মাধ্যমেই মানুষের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং সংখ্যারই ছন্দপতনে মানুষের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে। বৃহত্তর জীবনের পরিসরে, ভবিষ্যত পরিকল্পনা রূপায়ণে সংখ্যাতত্ত্ব একাধারে যেমন মানুষকে শক্তি প্রদান করে ; অপরপক্ষে মানুষের দুর্বলতা প্রশমণে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণেও অগ্রনী ভূমিকা গ্রহণ করে।

সংখ্যার ক্রমবিকাশে ১, ৮ এবং শূন্য সংখ্যার তাৎপর্য :

এক (১) হল ঈশ্বর বা পরমাত্মার স্বরূপ অর্থাৎ ঈশ্বর একমেব অদ্বিতীয়ম, এক সংখ্যা হল সকলের আত্মা, যার মধ্যে আমরা বেঁচে আছি এবং আমাদের জীবনসত্ত্বাকে খুঁজে পাই। এক (১) সবচেয়ে শক্তিশালি সংখ্যা যা রবি গ্রহের প্রতীক, রবি বা সূর্য্য হল আমাদের সৌরমন্ডলের কেন্দ্রে অবস্থিত ও সকল শক্তির যাবতীয় উৎস। ১ সংখ্যা প্রথম মৌলিক সংখ্যা যা সূচিত করে অদম্য ইচ্ছাশক্তি, অসীম সাহসিকতা, চূড়ান্ত অভিমান, প্রবল উচ্চাকাঙ্খা, অফুরন্ত উদ্যোগ ও সর্বোপরি একমুখীনতা।

রহস্যময় সংখ্যা আট(৮) আধ্যাত্মিকতার সূচক। অষ্টম গর্ভের সন্তানরা সর্বদা কৃতী হয় এবং সমাজে যুগযুগান্ত ধরে সমাদৃত হন। কালিকাপুরাণ অনুসারে, দুর্গাপূজোর পদ্ধতিতে দেবীর প্রতীক নবপত্রিকাকে যখন আটটি মন্ত্রপুত কলজের জলে স্নান করানো হয়, তখন মালব বা মালবী, ললিত, বিভাস, ভৈরব, কেদার, বরাটী, বসন্ত ও ধানেত্রী এই আটটি রাগের প্রয়োগ করা হয়। ঊর্ধ্বদিক ও অধঃদিক বাদ দিলে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, ঈশান, অগ্নি, নৈঋত ও বায়ু – এই আটটি দিক বাস্তশাস্ত্র অনুসারে মানুষের পারিপার্শ্বিক অবস্থান, জীবনযাপন, সুখ-সমৃদ্ধি ও মানসিক শান্তি প্রদানে মুখ্য ভূমিকা প্রদান করে। যেকোনো তান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অগরু, তগর, গোরচনা, কস্তুরী, শ্বেতচন্দন, রক্তচন্দন, সিঁদুর, ও কেশর এই আট প্রকারের অষ্টগন্ধ ব্যবহৃত হয়। দেবীদুর্গার অষ্টমাতৃকার আটটি রূপ – কৌশিকী, চন্ডীকা, শিবদূতী, ব্রাহ্মণী, ঐন্দ্রী, কৌমারী, বারাহী, এরা সবাই মিলে রক্তবীজকে হত্যা করেছিলেন। পতঞ্জলী বর্ণিত যোগ সাধনায় সিদ্ধিলাভ করলে, আট রকম ফল সাধকের জীবনে করায়ত্ত হয়। এগুলি হল – অনিমা, মহিমা, গরিমা, লঘিমা, প্রাপ্তি, প্রকাম্য, ইশিত্ব ও বশিত্ব।

শূন্যের (০) মাহাত্ম্য বর্ণনায় বিখ্যাত দার্শনিক এল.হগবেন বলেছিলেন, শূন্যের আবষ্কার, গণনার ক্ষেত্রে, মানুষের বুদ্ধিমত্তাকে কারাগারের বেড়াজাল থেকে মুক্তি দিয়েছিল। ভারতীয় পন্ডীতজ্ঞ পিঙ্গলা খ্রীষ্টপূর্ব ২০০ শতকে মর্স কোডের সমকক্ষ ‘বাইনারি সংখ্যা’ (Binary Number) এর তাৎপর্য ব্যাখ্যাতে প্রথম শূন্য ব্যবহারের কথা বলেছিলেন। বাইনারি সংখ্যা হল গণিত ও কম্পিউটারের ক্ষেত্রে ; ব্যবহৃত এক পদ্ধতি যেখানে কেবলমাত্র শূন্য(০) ও এক (১) ‌এর ব্যবহারই সীমিত। পিঙ্গলাই প্রথম ইংরাজী শব্দ Zero (0) এর পরিবর্তে সংস্কৃত শব্দ শূন্য (০) ব্যবহারের কথা বলেছিলেন। খ্রীষ্টীয় ৫০০ শতকে আর্যভট্ট প্রথম শূন্যকে সংখ্যার সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন। খ্রীষ্টীয় ৫০০ শতকে আর্যভট্ট দ

শমিক স্থানের মান নির্ধারণের একটি অঙ্ক হিসাবে শূন্যের অবতারণা করে বলেছিলেন, ‘স্থানাত স্থানম দশগুণাম স্যাৎ’। অর্থাৎ একটি স্থান থেকে অন্য স্থানটির মান তার পূর্ববর্তী স্থানের দশগুণ। খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতকে রচিত ‘ব্রহ্মস্ফুট সিদ্ধান্ত’ নামক গ্রন্থটিতে প্রথম শূন্য ব্যবহারের গাণিতিক তিনটি স্বতঃসিদ্ধ লিপিবদ্ধ হয়েছিল। সেগুলি হল (১) শূন্য একটি সংখ্যা (২) শূন্য কোনো সংখ্যার ঠিক পরেরও সংখ্যা নয়, (৩) শূন্য বা কোনো সংখ্যার যে ধর্ম আছে তা তাদের পরবর্তী ক্রমের সংখ্যাগুলিতেও বিদ্যমান হবে। বীজগণিতের সিদ্ধন্ত রচনায়, গণিতজ্ঞ ভাস্করাচার্যই প্রথম বলেছিলেন (১) যেকোনো সংখ্যার সাথে শূন্য (০) যোগ করলে, অথবা কোনো সংখ্যা থেকে শূন্য (০) বিয়োগ করলে মূল সংখ্যাটির কোনো পরিবর্তন হয় না। (২) তেমনই কোনো সংখ্যাকে শূন্য (০) দ্বারা গুণ করলে গুণফল শূন্য এবং কোনো সংখ্যাকে শূন্য(০) দ্বারা বিভাজিত করলে ভাগফল অসীম বা infinity হবে। মার্কন্ডেয় পুরানের অন্তর্গত ‘শ্রী শ্রী চন্ডী’র শ্রীদেব্যর্থশীর্ষম – এ উল্লেখিত রয়েছে দেবতাগণ সম্মিলিতভাবে দেবী দূর্গার কাছে বিনীতভাবে দেবীর প্রকৃত স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে বলেছিলেন। তখন দেবী বলেছিলেন ‘শূন্যানাং শূন্যসাক্ষিণী’ অর্থাৎ অসীম শূন্যের মধ্যেও দেবীর অস্তিত্ব বিরাজমান। সংখ্যার ক্রমান্বয়ে ও ক্রমবিকাশে শূন্য (০) এর দুটি রূপের প্রচলন বহু প্রাচীনকাল থেকেই চালু ছিল। (১) বিন্দু (dot) এবং (২) বৃত্ত (circle)। আবার ভারতীয় ও পাশ্চাত্য উভয় সংখ্যাতত্ত্বেই শূন্য (০) প্রকৃত পক্ষে বিরাট, বিশাল ও অসীমত্বের প্রতীক। George Ifrah রচিত ‘Universal Science of Numbers’ শূন্যকে ‘স্বর্গ’ ও মর্তের যোগসূত্র’ বলে ব্যাখ্যা করেছে। অর্থববেদের শূণ্য সংকেত, সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার স্বরূপ হিসেবে বর্ণনা করেছে। ভারতীয় গণীতের প্রাচীন বক্‌সালি পুঁথি (Bakshali Manuscript) যা খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০তে রচিত হয়েছিল। তাকেই শূন্যের অস্তিত্বের সর্বাপেক্ষা প্রাচীনতম লিখিত সূত্র হিসাবে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। এই পুঁথি Oxford University এর Science Museum এর বডলেয়িয়ান লাইব্রেরিতে বর্তমানে সংরক্ষিত আছে। এই পুঁথিতে শূন্য বিন্দু (.) আকারে বর্ণিত  হয়েছিল।

১০৮ সংখ্যার প্রকৃত মাহাত্মা ঃ  ইসলাম ধর্মে যেমন ৭৮৬ সংখ্যাটিকে পবিত্র মানা হয় তেমনি হিন্দুধর্মে ১০৮ সংখ্যাটিকে অতি পবিত্র মানা হয়। দুর্গাপুজোতে ১০৮টি পদ্ম লাগে, দেবীর গলায় ১০৮ বেলপাতার মালা পরানো হয়, নারায়ণ পূজোতে ১০৮টি তুলসিপাতা চড়ানো হয় কিংবা জপের মালাতে ১০৮টি রুদ্রাক্ষ থাকে, বিভিন্ন মন্দিরের সন্ত সমাজে মহামন্ডলেশ্বরের নামের আগে ‘শ্রীশ্রী ১০৮’ দিয়ে শুরু হয়। হিন্দুধর্ম মতে ১০৮ সংখ্যাটি দ্বারা ব্রহ্মকে প্রকাশ করা যায়। তাই হিন্দুধর্মে ১০৮ সংখ্যাটির এতো মাহাত্ম্য। বাংলা ভাষার বর্ণমালার অক্ষরের সাংখ্যিক স্পন্দন অনুসারে ব্রহ্ম = ব+র+হ+ম = ২৩+২৭+৩৩+২৫=১০৮। প্রাচীন সংস্কৃত ভাষাতে ৫৪টি অক্ষর ছিল ৫৪x২=১০৮(প্রতি বর্ণের পুং লিঙ্গতে ও স্ত্রীলিঙ্গ অর্থাৎ শিব ও শক্তি বর্তমান)। প্রাচীন মুহূর্ত শাস্ত্রানুসারে ; সময়কে ১০৮টি উপলব্ধিতে বিভাজিত করা হয়েছিল। ৩৬ অতীত, ৩৬ বর্তমান, ৩৬ ভবিষ্যৎ। হিন্দুধৰ্মে পঞ্চ দেবদেবী যারা শাস্ত্রানুসারে সর্বাগ্রে পূজিত (গণেশ, বিষ্ণু, শিব, কৌশিকী বা চন্ডী এবং সূর্য্য বা আদিত্য) প্রত্যেকেরই অষ্টোত্তর শতনাম সংকীর্তন করা হয়ে থাকে। শ্রীকৃষ্ণ সর্বদা ১০৮ গোপিনীর সাথে লীলাখেলায় রত থাকতেন।

১০৮ কে সংস্কৃতে বলা হয় ‘হর্ষদ সংখ্যা’ কারঁণ এই সংখ্যাকে তার সংখ্যা সমষ্টি দিয়ে বিভাজিত করা যায়। ১+০+৮=৯, আবার ১০৮¸৯=১২। এখানে ৯ (নবগ্রহ), ১২(কালপুরুষচক্রের বারটি রাশি)।

আয়ুর্বেদ ও যোগশাস্ত্র মতে, মানবদেহে মোট ১০৮টি পথ ধরে চালিকাশক্তি (energy) এসে হৃদপিন্ডকে সচল রাখে। কালজয়ী মহাকাব্য মহাভারতে প্রত্যেকটিতেই ১৮টি অধ্যায় আছে, এমনকি শ্রীরামচরিত মানস ৯ দিনে পাঠ সম্পূর্ণ করতে হয় ; যাকে ‘নবান্ন পরায়ন’ বলা হয়। নটরাজের তান্ডবের থেকে প্রেরিত হয়ে ‘ভারত নাট্যম’-এর সৃষ্টি। সেই নৃত্যশাস্ত্রে ১০৮টি হস্ত ও পদ্মমুদ্রা আছে। সারা ভারতে তন্ত্রপীঠের সংখ্যাও ১০৮।

ধর্মীয় রীতিতে বৈচিত্র থাকলেও হিন্দু, বৈষ্ণব, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন ও ইসলাম ধর্মে জপমালার পুঁথির সংখ্যা সর্বক্ষেত্রেই ১০৮টি। কেন ১০৮টি পুঁথি জপমালাতে থাকে তার একটি সুন্দর ব্যাখ্যা বৌদ্ধ ধর্মে রয়েছে। তাতে বলা হয়েছে একটি সূত্র ৬x৩x২x৩=১০৮, অর্থাৎ ৬ হল মানুষের ছয়টি ইন্দ্রিয় (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক ও চিন্তা); ৩ হল একত্রভাবে ত্রিকাল (অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত) ; ২ হল হৃদয়ের ২টি অবস্থা (নির্মল ও কলুষিত) এবং তিন হল মানুষের মনের অবস্থা (ইচ্ছা, অনিচ্ছা ও উদাসীনতা)। জপের মূল উদ্দেশ্য সাধন হল ইন্দ্রিয়গুলিকে নিয়ন্ত্রিত করে, মনের পরিচালনা এবং কালের ঊর্র্ধে নিজের হৃদয়কে প্রতিস্থাপন করা।

Loading